bakya
Study (পড়াশোনা)

বাক্য – সহজে ব্যাকরণ

সহজে ব্যাকরণ সিরিজ (চতুর্থ পর্ব) – বাক্য


আজ আমরা বাক্য নিয়ে কিছু কথা বলবো।

দেখো আমরা সারাদিনে সকলের সঙ্গে যা যা বলি, তার প্রতিটিই আসলে বাক্য। বাক্য ছাড়া মনের ভাব প্রকাশ করা যায় না। ছোটো ছোটো শব্দ দিয়ে একেকটা বাক্য গড়ে তুলি আমরা। একেকটি ইঁট বসিয়ে বসিয়ে যেমন বাড়ি তৈরি হয়, তেমনই শব্দ দিয়ে তৈরি হয় বাক্য। এখন যদি জিজ্ঞেস করো যে ব্যাকরণের ভাষায় বাক্য কাকে বলবো, তাহলে বলতে হয়

এক বা একাধিক পরস্পর সম্পর্কযুক্ত পদ পাশাপাশি বসে যখন অর্থপূর্ণভাবে মনের ভাব প্রকাশ করে, তখন তাকে বলে বাক্য।

এবার একটা উদাহরণ দেখা যাক – বাবা একটা উপহার এনেছে।

এখানে বাবা, একটা উপহার, আনা এই শব্দগুলি নির্দিষ্ট নিয়মে বাক্যে পদ হিসেবে বসে অর্থ তৈরি করেছে। তবে একের বেশি পদ থাকলেই যে বাক্য তৈরি হতে পারে তা নয়, একটি পদ দিয়েও বাক্য তৈরি হয়। যেমন

১) তুমি কি খেয়েছো?

– হ্যাঁ / না।

এখানে বক্তা বলতে চেয়েছে ‘হ্যাঁ আমি খেয়েছি। / না আমি খাইনি।’ কিন্তু একটি মাত্র শব্দেই সম্পূর্ণ বাক্যের অর্থ প্রকাশ পেয়েছে। 

২) মা তোমায় কী দিলেন ?

– উপহার। (এখানেও একই শর্তে বাক্য তৈরি হল)

একটা কথা মনে রাখা দরকার, যেকোনো শব্দই যখন বাক্যে প্রযুক্ত হয়, তখন তা পদে পরিণত হয়। সংক্ষেপে এভাবে মনে রাখো –

শব্দ + বিভক্তি / অনুসর্গ = পদ

যেকোনো বাক্য গড়ে ওঠে তিনটি বিষয় নিয়ে – কর্তা, কর্ম ও ক্রিয়া।

ইংরাজিতে যেমন বাক্য তৈরির প্রক্রিয়াটা এরূপ Subject -Verb – Object , অর্থাৎ প্রথমে কর্তা, তারপর ক্রিয়াপদ এবং সবশেষে কর্ম বসে। কিন্তু বাংলায় বাক্যের গঠন একটু আলাদা, এখানে ক্রিয়াপদটি বসে সকলের শেষে। তবে এটা সাধারণ ধর্মমাত্র, ক্ষেত্রবিশেষে এই গঠন পরিবর্তিত হয়ে থাকে।


আরো পড়ুন → ধ্বনির ধারণা |   বর্ণ

সাধারণত সকল প্রকার বাক্যের দুটি প্রধান অংশ থাকে – উদ্দেশ্য এবং বিধেয়।

যদিও ইংরাজিতে তিনটি অংশ দেখা যায় – subject, verb & object। বাংলায় বাক্যের বিধেয় অংশের মধ্যেই verb ও object মিশে থাকে।

ধরা যাক একটা বাক্য এরকম – ‘তপন জানতো তার ছোটো মেসো একজন লেখক।’ এখানে কর্তা বা subject হল ‘তপন’, ক্রিয়া বা verb হল ‘জানতো’ আর কর্ম বা object হল ‘তার ছোটো মেসো একজন লেখক’। এখন বাংলায় বাক্যকে ভাঙতে দিলে আমরা লিখবো এভাবে –

উদ্দেশ্য : তপন

বিধেয় : জানতো তার ছোটো মেসো একজন লেখক।

আশা করি তোমরা বুঝতে পেরেছো। এখন বাক্যকে আমরা মূলত দুভাবে বিভক্ত করতে পারি। প্রথমত অর্থের ভিত্তিতে এবং দ্বিতীয়ত গঠনের ভিত্তিতে। বন্ধুরা নীচের তালিকাটা খেয়াল করো।

orther-vittite-bakyer-srenibivag

প্রথম রেখাচিত্রের কথায় আসি।

অর্থের ভিত্তিতে বাক্যকে যেভাবে ভাগ করা হয়েছে সেখানে আমরা দেখবো ইংরাজি ভাষার বাক্যের শ্রেণির সঙ্গে এর অনেকটাই পার্থক্য রয়েছে। ইংরাজি ভাষায় যেখানে বাক্যকে পাঁচভাগে ভাগ করা হয় অর্থের ভিত্তিতে যেমন – বিবৃতিমূলক (assertive), প্রশ্নবোধক (interrogative), আদেশ / অনুরোধমূলক (imparetive), প্রার্থনাসূচক (optative) এবং বিস্ময়সূচক (exclamatory), সেখানে বাংলায় কিছু কিছু শ্রেণিভেদ আলাদা।

jump-magazine-subscription

নির্দেশক বাক্য বলতে আসলে হ্যাঁ-বাচক বা না-বাচক বাক্যকে বোঝায়। উত্তর নির্দেশ করে যে প্রকার বাক্য তাই হল নির্দেশক বাক্য। ইংরাজির বিবৃতিমূলক বাক্যের মতোই এই নির্দেশক বাক্য কোনো ঘটনা বা ভাবের বর্ণনা দেয়।

যেমন – রমা মেধাবী ছাত্রী। এই ভাব ইতিবাচক হলে তা হ্যাঁ-বাচক বা অস্ত্যর্থক বাক্য আর ভাব যদি নেতিবাচক হয় তাহলে তাকে বলা হয় না-বাচক বা নঞর্থক বাক্য।

যেমন – শিক্ষক মহাশয় আমাদের পড়ান। (হ্যাঁ-বাচক)

আমি বাড়ির কাজ করিনি। (না-বাচক)

ওরা পড়াশোনা করে না। (না-বাচক)

পৃথিবীতে এক ভাগ স্থল আর তিনভাগ জল। (হ্যাঁ-বাচক)

এ প্রসঙ্গে একটি কথা অবশ্যই মনে রেখো তোমরা। ‘না’ আর ‘নি’ এই বিভক্তিদুটি একইভাবে বসে না শব্দের সঙ্গে। ‘নি’ বসে শব্দের সঙ্গে সন্ধিযুক্ত হয়ে আর ‘না’ বসে পৃথকভাবে অনুসর্গের মতো।

ইংরাজির মতো বাংলাতেও যে বাক্যের দ্বারা বক্তার মনের ভাব বা ইচ্ছা বা প্রার্থনা প্রকাশ পায় তাকে ব্যাকরণের ভাষায় প্রার্থনাসূচক বাক্য বলা হয়। যেমন – ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।

প্রশ্নবোধক বাক্য তো সবাই জানো তোমরা।

এই প্রকার বাক্য চিনবে শুধুমাত্র জিজ্ঞাসা চিহ্ন দিয়ে। ‘কাল তুমি স্কুলে গিয়েছিলে?’ কিংবা ‘তোমার নাকি মেয়ের বিয়ে?’ এরকম প্রশ্ন করা হলে বাক্যকে প্রশ্নবোধক বাক্য বলা হয়ে থাকে। ইংরাজির imparetive এবং optative sentence এর মতোই আদেশ, উপদেশ, অনুরোধ বা পরামর্শ যে প্রকার বাক্যে প্রকাশ পায় তার নাম অনুজ্ঞাসূচক বাক্য।

যেমন – দয়া করে শান্ত হোন।

রৌদ্রে দৌড়িও না।

বয়স্কদের সম্মান করবে।

আবার যে প্রকার বাক্যে দেখবে বন্ধুরা রাগ, দুঃখ, আনন্দ, কষ্ট, ঘৃণা, ভয়ের মতো মনের ভাব প্রকাশ পায় তা আসলে বিস্ময়সূচক বা আবেগসূচক বাক্য। এই বাক্য চেনার জন্য বিস্ময়চিহ্ন থাকবে বাক্যের শেষে। উদাহরণ দেখো তোমরা – আহা কী দেখিলাম! জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না।

বাব্বা! কত্ত দেমাক তোর।

হায়! অমলবাবু অকালেই চলে গেলেন।

বুঝতেই পারছো কীভাবে একেক রকম অর্থ প্রকাশ পাচ্ছে বলে বাক্যের শ্রেণি আলাদা হয়ে যাচ্ছে। অর্থগুলি বুঝে যেকোনো বাক্যের দিকে খেয়াল করলে সহজেই এই শ্রেণিগুলি আলাদা আলাদা করে চিনে নিতে পারবে তোমরা। এখন শুধু অভ্যাসের পালা।

তবে দুটি ভাগ বাকি আছে যেগুলি একটু আলাদা। প্রথম হল শর্তসাপেক্ষ বাক্য। কিছু কিছু বাক্যের মধ্যে একপ্রকার শর্ত থাকে মানে একটি বক্তব্যের উপর অপরটি নির্ভরশীল হলে তাকে বলে শর্তসাপেক্ষ বাক্য। যেমন –

যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।

যেমন ধারা স্বভাব, তার তেমন ধারা কথা।

তুমি আগে এসো, তারপরে আমি যাবো।

আর দ্বিতীয়টি হল সন্দেহবাচক না সংশয়াত্মক বাক্য। এই প্রকার বাক্যে বক্তার মনের সন্দেহ ও সংশয় ফুটে ওঠে। নীচের উদাহরণগুলিতে দেখতে পাবে হয়তো, বোধহয়, যেন, এই বুঝি-র মতো কিছু নির্দেশক পদ থাকে বাক্যে। যেমন –

মরে গেছে হয়তো।

এই বুঝি ট্রেন ছেড়ে দিলো।

তমাল বোধহয় জিততে পারবে।

মনে হচ্ছে যেন সকলেই মৃত।

অর্থের ভিত্তিতে বাক্যকে এভাবেই ভাগ করা হয়েছে।

এবারে চলে আসি বাক্যের গঠনের ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগে।

আমরা আগেই বলেছি বাক্যে কর্তা-কর্ম ও ক্রিয়া থাকে আর এই ক্রিয়াপদ মূলত দু-প্রকার – সমাপিকা ক্রিয়া আর অসমাপিকা ক্রিয়া।

যে ক্রিয়া বাক্যের অর্থ সম্পূর্ণ করে তাকে সমাপিকা ক্রিয়া বলে। একটি বাক্যে একটিমাত্র সমাপিকা ক্রিয়া থাকবে।

আর যে ক্রিয়া বাক্যের অর্থকে সম্পূর্ণ করে না তা হল অসমাপিকা ক্রিয়া। একটি বাক্যে একাধিক অসমাপিকা ক্রিয়া থাকতে পারে।

এই সমাপিকা আর অসমাপিকা ক্রিয়ার ভিত্তিতেই বাক্যকে সরল, জটিল, যৌগিক এইভাবে ভাগ করা হয়।

সরল বাক্যে আমরা দেখব একটি মাত্র সমাপিকা ক্রিয়া থাকে এবং একাধিক অসমাপিকা ক্রিয়া থাকতে পারে। যদি বাক্যে একের বেশি সমাপিকা ক্রিয়া থাকে তাকে জটিল বাক্য বলা হয়। এই জটিল বাক্যের মধ্যে ছোটো ছোটো উপবাক্য থাকে অর্থাৎ এগুলি বাক্যের অংশ যেখানে একটি করে সমাপিকা ক্রিয়া থাকে। এই উপবাক্যগুলি একে অপরের উপর নির্ভরশীল হয়।

সবশেষে যৌগিক বাক্যে দুটি বা তার বেশি সরলবাক্য কিছু সংযোজক অব্যয় (যথা – এবং, আর, ও, নতুবা, কারণ, কিন্তু) দ্বারা যুক্ত অবস্থায় থাকে। এবারে মন দিয়ে উদাহরণগুলি খেয়াল করো।

১) মধুজা কলেজে পড়ছে। (সরল)

২) আমি অঙ্কটি করে শিক্ষককে দেখালাম। (সরল)

৩) মধু ফিরে এলে, পার্থ বাইরে যাবে। (জটিল)

৪) যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। (জটিল)

৫) যদি আজ বৃষ্টি হয়, তবে স্কুলে যাবো না। (জটিল)

৬) শ্রীতমা মেধাবী কিন্তু গরীব। (যৌগিক)

খেয়াল করে দেখো তোমরা সরল বাক্যদুটি প্রথমটিতে একটি সমাপিকা ক্রিয়া ‘পড়ছে’ আর দ্বিতীয়টিতে একটি সমাপিকা ক্রিয়া (দেখালাম) আর একটি অসমাপিকা ক্রিয়া (করে) রয়েছে।

অন্যদিকে জটিল বাক্য তিনটির প্রতিটিতেই একটি করে সমাপিকা ক্রিয়া (যাবে, হয়, যাবো না) রয়েছে আর অসমাপিকা ক্রিয়া (এলে) রয়েছে শুধু প্রথমটিতে। ৪ ও ৫ নং বাক্যদুটি আসলে শর্তসাপেক্ষ বাক্য।

এখানে দুটি ভাগ রয়েছে যেগুলি একে অপরের উপর নির্ভরশীল এবং ‘যেখানে…সেখানে’, ‘যদি…তবে’ ইত্যাদি দিয়ে যুক্ত আছে বাক্যাংশগুলি। তাই এগুলিকে জটিল বাক্য বলা হয়েছে। শেষ বাক্যটি যৌগিক বাক্য কারণ ‘কিন্তু’ এই সংযোজক অব্যয়ের দ্বারা দুটি অংশ যুক্ত হয়ে বাক্য তৈরি হয়েছে।

আরো উদাহরণ দেওয়া যেত বন্ধুরা কিন্তু তোমাদের অভ্যাসের উপর ছেড়ে দিলাম সেই ভার। তোমরা বইপত্র দেখে উদাহরণ খুঁজে খুঁজে অভ্যাস করো, চিনতে শেখো কোনটা কোন বাক্য। তবেই তো এই সহজে ব্যাকরণের ক্লাস সার্থক হবে।

চতুর্থ পর্ব সমাপ্ত।  পরবর্তী পর্ব → সন্ধি


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখাটি, অডিও, ভিডিও বা অন্য  কোন ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতিঃ

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



এছাড়া,পড়াশোনা সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ের আলোচনায় সরাসরি অংশগ্রহন করতে যুক্ত হতে পারেন ‘লেখা-পড়া-শোনা’ ফেসবুক গ্রূপে। এই গ্রুপে যুক্ত হতে ক্লিক করুন এখানে।