সহজে ব্যাকরণ সিরিজ (দ্বাদশ পর্ব) – কারকের ধারণা
বন্ধুরা কেমন আছ? আশা করছি সকলেই অনেক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় ছিলে এই ক্লাসের। আসলে তোমরা সকলেই চাও ব্যাকরণটা বুঝতে, বাংলা ভাষাটা আরো ভালো করে জানতে সেটা আমাদের জানা। কিন্তু পড়তে গিয়ে হোঁচট যাতে না খেতে হয় সেইজন্যেই আমাদের এই প্রয়াস – সহজে ব্যাকরণ সিরিজ। তাহলে চলো আজ ঝট করে আমরা বুঝে নিই ব্যাকরণের একটা সহজ অধ্যায়- কারক। তোমাদের মনে হতেই পারে ওরে বাবা কারক! কী কঠিন! কিন্তু সেই জন্যেই তো আজকের ক্লাস। কারক মোটেও কঠিন নয়। আর দেরি নয়, চলো ক্লাস শুরু করে ফেলি।
দেখো বন্ধুরা কারক মানে কী আগে তো সেটা জানতে হবে। কারক মানে হল যে করে। এখন প্রশ্ন হল করবে টা কী? আর করবেই বা কোথায়? না না এখানে বাড়ির জন্য বাজার-হাট করা, চাকরি করা, রান্না করা, পুজো করার কথা বলছি না। এই করা হল বাক্যের মধ্যে সমস্ত পদের সঙ্গে ক্রিয়াপদের সম্পর্ক স্থাপন করা। ক্রিয়া ছাড়া তো সেভাবে বাক্য হয় না। ক্রিয়া বা verb হল বাক্যের একেবারে মাথা।
মানে ধরো একটা বাক্য হল একটা অফিস আর তার বস (Boss) হল ক্রিয়াপদ। এখন একজন কেরানি আছে যে অন্য সমস্ত কর্মচারীদের ফাইলপত্র এনে জমা করে বসের ঘরে। তা বাক্যের মধ্যে সেই অন্যান্য কর্মচারীগুলি হল বাক্যের পদগুলি আর কেরানির কাজটা সামলায় এই কারক-ভায়া। তাহলে সহজ ভাষায় বুঝে ফেলি।
বাক্যের মধ্যে অনেকগুলি শব্দ থাকে যাদের আমরা পদ বলি, সেই পদগুলির সঙ্গে ক্রিয়াপদের সম্পর্ক স্থাপন করে যে তাকেই কারক বলা হয়।
ফলে কারকের ভালো মানে হল ‘অন্বয়’ বা সম্পর্ক। সংস্কৃত ব্যাকরণে বলা হয়েছে ‘ক্রিয়ান্বয়ী কারকম’। অঈ একই কথা – ক্রিয়ার সঙ্গে যে সম্পর্ক স্থাপন করে তাই হল কারক। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ালো কীভাবে বুঝবো কোনটা কোন কারক? খুব সহজ।
কারকের ভাগসমূহ
কারক প্রধানত ছয় প্রকার – কর্তৃকারক, কর্মকারক, করণ কারক, নিমিত্ত কারক, অপাদান কারক এবং অধিকরণ কারক। তবে আরো দুইটি কারক রয়েছে কিন্তু যদিও তাদের প্রকৃত অর্থে কারক বলা যাবে না। সে দুইটি হল – সম্বন্ধ পদ এবং সম্বোধন পদ।
তাহলে যদি প্রশ্ন হয় কারক কয় প্রকার বলতে হবে ছয় প্রকার। কেন ঐ দুটিকে কারক বলছি না? শোনো তাহলে। কারক মানে কী বলা হয়েছে? ক্রিয়ার সঙ্গে যার সম্পর্ক আছে। ঐ সম্বন্ধ পদ বা সম্বোধন পদের আসলে ক্রিয়ার সঙ্গে কোনো সম্পর্কই নেই, তাই এদের কারক বলা হয় না। আশা করি বুঝতে পেরেছো তোমরা। মূল কারকে ঢোকার আগে এই দুটি নিয়ে কিছু কথা বলে নিই। নীচের বাক্যটা খেয়াল করো।
রামের বাড়িটা বিক্রি হয়ে যাবে।
সম্বন্ধ পদ
এই বাক্যে ক্রিয়াপদ হল ‘বিক্রি হয়ে যাবে’। এখন কী বিক্রি হবে? বাড়িটা। কার বাড়ি না রামের। তাহলে দেখো বন্ধুরা রাম হল মূল কর্তা। তার সঙ্গে এর জুড়ে গেছে যার সঙ্গে আদতে ক্রিয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। কর্তা হল বাড়ি। রাম নয় কিন্তু। তাই এই বাক্যে ‘রামের’ হল সম্বন্ধ পদ। আরো একটা টিপস দিই তোমাদের। সম্বন্ধ পদ চেনার উপায় হল – ‘এর’ যুক্ত থাকবে পদের সঙ্গে।
সম্বোধন পদ
এরপরে সম্বোধন পদটা কী জেনে নিই। নামটা খেয়াল করো – ‘সম্বোধন’। অর্থাৎ কাউকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলা, ডাকা বা লেখা ইত্যাদি। যেমন ধরো –
আরো পড়ো→ সর্বনাম | বিশেষণ | ক্রিয়া | ধাতু
‘ওহে জগবন্ধু কোথায় চললে?’
এখানে ‘ওহে’ পদটার সঙ্গে আদতে বাক্যের ক্রিয়ার কোনোই সম্পর্ক নেই। তাই এইটাকে বলা হয় সম্বোধন পদ। চেনার উপায়? খুব সোজা। যা দিয়ে কাউকে ডাকা হবে সেইটেই সম্বোধন পদ। আর যেহেতু এই দুটি প্রকৃত কারক নয়, তাই এদের অকারক বলে।
এটা কিন্তু মাথায় রাখতে হবে তোমাদের। সম্বন্ধ পদ আর সম্বোধন পদকে বলা হয় অকারক। তাহলে এবারে আমরা অকারক থেকে কারকে ঢুকবো। আগেই বলেছি কারক ছয়টা। কীভাবে প্রতিটি কারক আলাদা করে চিনবো তার সহজ থেকে সহজতর উপায় সকলে জানতে চাও তোমরা। কীভাবে এতগুলো কারক একবারে মনে রাখা যায়? তাহলে দেখো তো বন্ধুরা এই পদ্ধতিটা তোমাদের কাজে লাগে কিনা! প্রথমে যেটা করতে হবে তা হল যে কোনো বাক্যের ক্রিয়াপদটি খুঁজে বের করতে হবে। তারপর তাকে উপযুক্ত মনে করে নীচের ছয় রকম প্রশ্ন করে ফেলতে হবে। প্রত্যেক প্রশ্নের উত্তরে একটা করে কারক পাওয়া যাবে। খুবই সহজ। প্রশ্নগুলো হল –
১) কে / কাকে? – কর্তৃকারক
২) কী – কর্মকারক
৩) কী দিয়ে / দ্বারা? – করণ কারক
৪) কী জন্য? / কীসের নিমিত্ত – নিমিত্ত কারক
৫) কোথা থেকে? – অপাদান কারক
৬) কোথায় / কখন / কীভাবে? – অধিকরণ কারক
তোমাদের প্রাথমিক কাজ হল এই প্রশ্নগুলোকে মনে রাখা। চলো তাহলে একটা উদাহরণ দিয়ে দেখে নিই। হর্ষবর্ধন প্রতি বছর কুম্ভমেলায় মন্ত্রীদের সাহায্যে সকল দরিদ্র প্রজাকে কোষাগার থেকে ধন-সম্পদ দান করতেন।
এই বাক্যটার মজা হল এতে ছয় রকম কারকই আছে। চলো ঝটপট ছয়টা প্রশ্ন করে ফেলি আর ছয়টা কারককে খুঁজে নিই। তার আগে ক্রিয়াপদটা খুঁজতে হবে যে। এই বাক্যে ক্রিয়াপদ হল ‘দান করতেন’।
১) কে দান করতেন? – হর্ষবর্ধন – কর্তৃকারক
২) কী দান করতেন? – ধন-সম্পদ – কর্মকারক
৩) কাদের সাহায্যে দান করতেন? – মন্ত্রীদের দ্বারা – করণ কারক
৪) কাদের জন্য দান করতেন? – দরিদ্র প্রজার জন্য – নিমিত্ত কারক
৫) কোথা থেকে দান করতেন? – কোষাগার থেকে – অপাদান কারক
৬) কোথায় দান করতেন? – কুম্ভমেলায় – অধিকরণ কারক
আবার,
৭) কখন দান করতেন? – প্রতি বছর – অধিকরণ কারক
তাহলে এবার আশা করি খুব সহজেই তোমরা কারক কীভাবে চিনতে হবে তা বুঝে গেছো। ঠিক এই প্রশ্নের ফর্মুলা মেনে কারক নির্ণয় করলেই সবই সঠিকভাবে করতে পারবে তোমরা। খালি একটা বিষয়ে একটু গুলিয়ে যায় অনেকের। সেটা হল ‘কী’ তে কর্তৃকারক নাকি ‘কে’ তে? এই জন্য তোমাদের একটা সহজ ছড়া মনে রাখতে হবে।
‘কে’-তে কর্তা, ‘কী’-তে কর্ম,
এর নাম কর্তা-কর্ম।
আরো পড়ো→ ধ্বনির ধারণা | বর্ণ | বাক্য | সন্ধি
বুঝতে পারছো আশা করছি। ‘কে’ দিয়ে প্রশ্ন করলে কর্তা মানে কর্তৃকারক আর ‘কী’ দিয়ে প্রশ্ন করলে হবে কর্মকারক। এই প্রাথমিক ধারণার পাশাপাশি আমাদের কিন্তু আরো কিছু কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে মনোনিবেশ করতে হবে বন্ধুরা। এই যে কর্তৃকারক, কর্মকারক, করণ কারক বা অধিকরণ কারক এগুলোর কিন্তু ভাগ আছে। মানে প্রকারভেদ আছে।
তবে আজকের সহজে ব্যাকরণের ক্লাস এইখানেই ছুটি। পরের ক্লাসে চলে আসবো তোমাদের কারকের এই প্রকারগুলি বোঝাতে। তাই আজকের মতো টাটা বন্ধুরা।
দ্বাদশ পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব – কারকের প্রকারভেদ
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখাটি, অডিও, ভিডিও বা অন্য কোন ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লেখক পরিচিতিঃ
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
karok-1