genetic-problems
Madhyamik

সাধারণ জিনঘটিত রোগ | বংশগতি

জীবনবিজ্ঞানদশম শ্রেণি – বংশগতি (চতুর্থ পর্ব)

আগের পর্বগুলিতে আমরা বংশগতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ (একসংকরদ্বিসংকর জনন) নিয়ে আলোচনা করেছি। এই পর্বে আমরা জিনঘটিত কয়েকটি রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

jump magazine smart note book

থ্যালাসেমিয়া

এই রোগ সম্পর্কে বিশদে জানার আগে আমরা থ্যালাসেমিয়া শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে সম্পর্কে জেনে নেব।

গ্রীক শব্দ thalasa থেকে thalasemia শব্দের উৎপত্তি; thalasa শব্দের অর্থ হল সমুদ্র। ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলিতেই এই অসুখ প্রথম আবিষ্কৃত হওয়ায় এই অসুখের এই রকম নামকরণ করা হয়েছে।  

থ্যালাসেমিয়া কাকে বলে?

যে রোগে অটোজোমে অবস্থিত প্রচ্ছন্ন জিনের পরিব্যাক্তির ফলে হিমোগ্লোবিনের গ্লোবিন চেনের গঠন ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় রক্তাল্পতা, প্লীহার অস্বাভাবিক গঠন ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায় তাকে থ্যালাসেমিয়া বলে।

থ্যালাসেমিয়া রোগের কারণ কি?

থ্যালাসেমিয়ার কারণ হল অটোজোমে অবস্থিত প্রচ্ছন্ন জিনের পরিব্যক্তি।

হিমোগ্লোবিন ‘হিম’ অর্থাৎ আয়রণ আর ‘গ্লোবিন’ নামক প্রোটিন দ্বারা তৈরি। ‘গ্লোবিন’ প্রোটিনটি দুটো আলফা(α) আর দুটো বিটা( β) পলিপেপটাইড চেন দিয়ে  তৈরী ।

hemoglobin-structure
হিমোগ্লোবিনের গঠন [চিত্র সৌজন্য – getbodysmart.com]
α গ্লোবিন পলিপেপটাইড চেনটির গঠন নিয়ন্ত্রিত হয় চারটি স্বাভাবিক জিন দ্বারা । দুটি HbA1 এবং দুটি HbA2 (এই জিন চারটির, দুটি পিতার থেকে এবং দুটি মাতার থেকে প্রাপ্ত হয়)।

α গ্লোবিন চেনের গঠন নিয়ন্ত্রনকারী জিন দুটির অবস্থান 16 নং সমসংস্থ ক্রোমোজোম জোড়ায়।

Himoglobin

16 নম্বর সমসংস্থ ক্রোমোজোম জোড়ায় অবস্থিত α গ্লোবিন পলিপেপ্টাইড চেনটির গঠন নিয়ন্ত্রণকারী চারটি স্বাভাবিক জিন।

β গ্লোবিন চেনটি দুটি স্বাভাবিক জিন HbB বা β জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যার একটি মাতার থেকে অন্যটি পিতার থেকে সন্তান লাভ করে।

অবস্থান – β গ্লোবিন পলিপেপটাইড চেন গঠন নিয়ন্ত্রিত কারী জিনটি 11নং সমসংস্থ ক্রোমোজোম জোড়ায় অবস্থিত।

থ্যালাসেমিয়ার প্রকারভেদ

থ্যালাসেমিয়াকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়; α থ্যালাসেমিয়া ও β থ্যালাসেমিয়া।

আবার এই দুই প্রকার থ্যালাসেমিয়াকে তাদের তীব্রতা অনুযায়ী  আরো দুই ভাগে ভাগ করা হয়।

α থ্যালাসেমিয়ার মেজর

যদি দুইয়ের অধিক জিনের মধ্যে অস্বাভাবিকতা দেখা যায় তবে তীব্র থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ লক্ষ্য করা যায়। একে α থ্যালাসেমিয়ার মেজর বলা হয়।

থ্যালাসেমিয়া মেজর ক্রোমোজোম

যদি হিমোগ্লোবিন গঠন নিয়ন্ত্রণকারী চারটি জিনই অনুপস্থিত থাকে, তবে শিশু মাতৃগর্ভেই মারা যায়, তাঁকে হাইড্রপস ফিটালিস  বলে।

α থ্যালাসেমিয়ার মাইনর

যদি একটি বা দুটি জিনের মধ্যে অস্বাভাবিকত্ব দেখা যায়, তবে মৃদু থ্যালাসেমিয়া (অর্থাৎ রোগ লক্ষণ তত তীব্র নয়) দেখতে পাওয়া যায়।

থ্যালাসেমিয়া মাইনর ক্রোমোজোম

β থ্যালাসেমিয়া

β থ্যালাসেমিয়া মেজর – 11নং সমসংস্থ ক্রোমোজোম জোড়ায় অবস্থিত, দুটি সমসংস্থ ক্রোমোজোমেরই β পলিপেপ্টাইড শৃঙ্খল গঠন নিয়ন্ত্রণকারী জিনের ত্রুটি থাকার ফলে দুটি গ্লোবিন চেনের সংশ্লেষেই ত্রুটি থাকে। তার ফলে এই রোগটি হয়। একে Cooley’s anemia ও বলা হয়।এই অসুখে তীব্র রক্তপ্লতা, প্লীহা ও যকৃতের আকার বৃদ্ধি , হৃদবৈকল্য ইত্যাদি দেখা যায়।

β থ্যালাসেমিয়া মাইনর –    11নং সমসংস্থ ক্রোমোজোম জোড়ার  একটি  ক্রোমোজোমে যদি β গ্লোবিন  সংশ্লেষকারী জিনের গঠনে ত্রুটি থাকে তাহলে β থ্যালাসেমিয়া মাইনর রোগটি  দেখা যায়। এই ধরণের রোগীদের RBC সংখ্যা স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিকের থেকে 20% কম হয়।

থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণঃ

  • হিমোলাইটিক অ্যানিমিয়া – হিমোগ্লোবিন উৎপাদনের ত্রুটির জন্য রক্তাল্পতা দেখা যায়।
  • RBC আকারে ছোট – হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ায় RBC আকার ছোট হয়।
  • যকৃৎ ও প্লীহার বৃদ্ধি – প্লীহায় প্রচুর RBC নষ্ট হয়। এই বিনষ্ট অংশ অপসারিত না হওয়ায় প্লীহার আয়তন বৃদ্ধি পায় একে প্লীনোমেগালি বলে।
  • হাড়ের অস্বাভাবিক গঠন – অস্থিমজ্জা প্রশস্ত হয় বলে প্রধানত করোটি ও মুখমণ্ডলের হাড় প্রস্থে বাড়ে। অস্থি দুর্বলও হয়।
  • অতিরিক্ত লোহা দেহে সঞ্চয় – রক্তাল্পতার কারণে বার বার রক্ত সঞ্চারণ করতে হয়। খুব অল্প সময়ে লোহিত কণিকা বিনষ্ট হওয়ার ফলে লোহা হিমোসিডারিন হিসেবে দেহে জমা হয়।
  • লোহা মূত্র দিয়ে নির্গত হওয়ার ফলে মূত্রের রং কালচে হয়

থ্যালাসেমিয়ার প্রতিকার

থ্যালাসেমিয়া রোগের কোন চিকিৎসা নেই। কিন্তু সন্তান জন্মের পূর্বে পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগের উপস্থিতি নির্ণয় করা যায়।

বংশে থ্যালাসেমিয়ার ইতিহাস থাকলে প্রাক বিবাহ ‘জেনেটিক কাউন্সেলিং’ করা আবশ্যক। এক মাত্র এই ‘জেনেটিক কাউন্সেলিং’ – এর মাধ্যমেই থ্যালাসেমিয়া রোধ করা সম্ভব।

হিমোফিলিয়া

‘X’ ক্রোমোজোমে অবস্থিত প্রচ্ছন্ন জিনবাহিত যে রোগের ফলে আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে রক্ত তঞ্চিত হয় না তাকে হিমোফিলিয়া বলে।

hemophilia

হিমোফিলিয়ার প্রকারভেদ

প্রধানত হিমোফিলিয়াকে তিনভাবে ভাগ করা যায়।

হিমোফিলিয়া A বা ক্লাসিক হিমোফিলিয়া

এই প্রকার হিমোফিলিয়ায় রক্ত তঞ্চনের সাহায্যকারী ফ্যাক্টর VIII  অর্থাৎ অ্যান্টি হিমোফিলিক ফ্যাক্টর উৎপন্ন হয় না।

queen-vicoria

এই প্রকার হিমোফিলিয়া রানী ভিক্টোরিয়ার বংশধরদের মধ্যেও দেখা গেছে। তাই এই ধরণের হিমোফিলিয়াকে রয়্যাল বা রাজকীয় হিমোফিলিয়া বলা হয়।

হিমোফিলিয়া B বা ক্রিস্টমাস রোগ

এই প্রকার হিমোফিলিয়ায় রক্ত তঞ্চনের জন্য প্রয়োজনীয় ফ্যাক্টর IX বা খ্রিসমাস ফ্যাক্টর উৎপন্ন হয় না।

হিমোফিলিয়া C

এটি একপ্রকার অটোজোম অবস্থিত জিন ঘটিত হিমোফিলিয়া, এই ক্ষেত্রে রক্ত তঞ্চনের ফ্যাক্টর XI বা প্লাজমা থ্রম্বোপ্লাস্টিন অ্যান্টিসিডেন্ট অনুপস্থিত থাকে।

হিমোফিলিয়ার বংশানুসরণ

তিনটি সম্ভাব্য বংশানুসরণ দেখানো হল।

হিমোফিলিয়ার বংশানুসরণ-1
Case – 1
হিমোফিলিয়ার বংশানুসরণ-2
Case 2
হিমোফিলিয়ার বংশানুসরণ-3
Case – 3

বর্ণান্ধতা

X ক্রোমোজোমে অবস্থিত প্রচ্ছন্ন জিনের পরিব্যাক্তির কারণে যদি কোন ব্যাক্তি লাল সবুজ বর্ণ চিনতে পারে না বা এই সমস্ত রঙের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না, তবে এই ধরণের রঙ সনাক্তকরণের অক্ষমতাকে বর্ণান্ধতা বলে।

আমরা জানি যে, রঙিন বস্তু আমরা রেটিনায় অবস্থিত কোন কোশ দ্বারা দেখতে পাই।

cone for colour vision
রেটিনা এবং তার মধ্যে উপস্থিত কোন ও রড কোশ

রেটিনায় তিন ধরণের কোন কোশ (Cone Cells) আছে – S কোন, M কোন, L কোন। এগুলি অবস্থিত ফোভিয়া সেন্টালিসে, এখানে রড কোশ (Rod Cell) অনুপস্থিত।

আলোক সুবেদি এই কোন কোশে প্রোটিন ‘ফটো অপসিন’ আছে, যা বংশগত ভাবে সঞ্চারনশীল।

লাল সংবেদী কোন কোশ – এই প্রকার কোন কোশে এরিথ্রোলোব রঞ্জক ( ফটো অপসিন I) থাকে।

সবুজ সংবেদী কোন কোশ – এই প্রকার কোন কোশে ক্লোরোলোব রঞ্জক ( ফটো অপসিন II) থাকে।

নীল সংবেদী কোন কোশ –এই প্রকার কোন কোশে সায়ানোলোব রঞ্জক ( ফটো অপসিন III) থাকে।

এই বিভিন্ন রঞ্জকের উপস্থিতির কারণেই বিভিন্ন রং চেনা সম্ভব হয়।

পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, লাল সবুজ বর্ণান্ধতা –তারপর নীল – হলুদ বর্ণান্ধতা। সম্পূর্ণ বর্ণান্ধ ব্যাক্তি  অর্থাৎ যে ব্যাক্তি কোন রঙ দেখতে পায় না যার শুধুমাত্র সাদা কালো দৃষ্টি  আছে অর্থাৎ তিনি শধু সাদা কালো রঙই দেখতে পান।

জন ডালটন লাল বর্ণের সাপেক্ষে বর্ণান্ধ ছিলেন। সেই জন্য বর্ণান্ধতাকে ডালটনিজমও বলে।

jump magazine smart note book

বিভিন্ন প্রকার বর্ণান্ধতা

প্রোটোনোপিয়া

এই প্রকার বর্ণান্ধতায় বর্ণান্ধ ব্যাক্তি লাল রঙ চিনতে পারেন না। এই প্রকার বর্ণান্ধতাকে প্রোটোনোপিয়া বলে। এই প্রকার বর্ণান্ধ ব্যাক্তিকে ‘প্রোটোনোপ’ বলে।

ডিউটেরানোপিয়া (Deutaranopia)

এই প্রকার বর্ণান্ধতায় বর্ণান্ধ ব্যাক্তি সবুজ রঙ চিনতে পারেন না। এই প্রকার বর্ণান্ধ ব্যাক্তিকে ‘ডিউটেরানোপ’ বলে।

ট্রাইটানোপিয়া

এই প্রকার বর্ণান্ধতায় বর্ণান্ধ ব্যাক্তি নীল রঙ চিনতে পারেন না। এই প্রকার বর্ণান্ধ ব্যাক্তিকে ‘ট্রাইট্রোনোপ’ বলে। এই রোগের জন্য দায়ী জিনটি ‘7’ নম্বর ক্রোমোজোমে (অটোজোম) অবস্থিত।

visibitity of colourblindness people

বর্ণান্ধতা বংশানুসরণ

তিনটি সম্ভাব্য বংশানুসরণ দেখানো হল।

[স্বাভাবিক জিন XC বর্ণান্ধতার জিন হল Xc]

বর্ণান্ধতার বংশানুসরণ-1a
Case 1

 

বর্ণান্ধতার বংশানুসরণ-3a
Case 2
বর্ণান্ধতার বংশানুসরণ-2a
Case 3

বর্ণান্ধতার টেস্ট

বর্ণান্ধতার বোঝা যাবে কিভাবে? জাপানি চক্ষু বিশারদ সিনবু ইসিহারা (Shinobu Ishihara) এই সমস্যার সমাধান করেন। তার আবিষ্কৃত কার্ডের মাধ্যমে বর্ণান্ধতার পরীক্ষা করা সম্ভব হয়। বিজ্ঞানীর নাম অনুসারে এই কার্ডের নাম ইসিহারা কার্ড রাখা যায়।

ishihara card
ইসিহারা কার্ড

একটা পরীক্ষা তোমরা নিজেরাই করতে পারো, উপরের কার্ডটি ভালোভাবে দেখ।  যারা এই কার্ডের নম্বর সঠিক পড়তে পারবে তাদের দৃষ্টি স্বাভাবিক।

 অধ্যায় সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → অভিযোজন

অন্যান্য বিভাগগুলি পড়ুন

দশম শ্রেণি – ভৌতবিজ্ঞান

দশম শ্রেণি – বাংলা

দশম শ্রেণি – গণিত

দশম শ্রেণি – জীবনবিজ্ঞান



Join JUMP Magazine Telegram


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –

X-LSc-3D