abhivyakti
Madhyamik

অভিব্যক্তি ও অভিব্যক্তির মতবাদ

জীবনবিজ্ঞানদশম শ্রেণি – অভিব্যক্তি [Abhivyakti]

অভিব্যক্তির ধারণা

যে মন্থর (ধীর) প্রক্রিয়ায় ধারাবাহিক পরিবর্তন ও রূপান্তরের মাধ্যমে আদিমতম সরল এককোশী জীব থেকে নতুন ও অপেক্ষাকৃত জটিল জীবের সৃষ্টি হয়েছে, সেই ঘটনাকে বলা হয় অভিব্যক্তি বা বিবর্তন। ইংরেজিতে একে ‘evolution’ বলা হয়।

জীবনের উৎপত্তি (Origin of life)

বিজ্ঞানীদের মতে জীবের উৎপত্তি হঠাৎ করে হয়নি। অসংখ্য জৈব রাসায়নিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে প্রাণের উৎপত্তি ঘটেছে। ওপারিন ও হ্যালডেন নামক দুজন বিজ্ঞানীর মতে জীবের উৎপত্তির পেছনে জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাঁদের এই মতবাদটি “জীবনের জৈব রাসায়নিক উৎপত্তি সংক্রান্ত প্রকল্প”নামে পরিচিত।

সব তত্ত্বগুলির মধ্যে ওপারিন ও হ্যালডেন-এর ‘রাসায়নিকভাবে প্রানের উৎপত্তি’ তত্ত্বকেই সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

রাসায়নিকভাবে প্রাণের উৎপত্তি

1924 খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ান বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ওপারিন তাঁর লেখা ‘অরিজিন অফ লাইফ অন আর্থ ‘(The origin of life on earth) বইয়ের মাধ্যমে এবং ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হ্যালডেন; ‘র‍্যাশনালিস্ট অ্যানুয়াল’ নামক জার্নালে স্বতন্ত্রভাবে প্রাণের রাসায়নিক উৎপত্তি সম্বন্ধে মতবাদ প্রকাশ করেন। দুই বিজ্ঞানীর মতবাদ প্রায় একই ধরনের হওয়ার কারণে এই মতবাদ ওপারিন-হ্যালডেন মতবাদ নামে পরিচিত হয়। তাদের এই মতবাদটিকে ‘জীবনের জৈব রাসায়নিক উৎপত্তি সংক্রান্ত প্রকল্প’ও বলা হয়।

ওপারিন-হ্যালডেন মতবাদটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে, সেগুলি হল-

a) প্রাক আদি-যৌগ সময়ের পরিবেশ এবং আদি যৌগগুলির উৎপত্তিঃ

b) সরল জৈব অণুর সৃষ্টি

c) জটিল জৈব অণুর সৃষ্টি

সংগঠিত কোশ বা আদি প্রাণীর সৃষ্টি
jump magazine plus

প্রথম আদি কোশ বা প্রোটোসেল

প্রায় 370 কোটি বছর আগে পলিনিউক্লিওটাইড থেকে তৈরি হয় নিউক্লিক অ্যাসিড। প্রথম সৃষ্ট নিউক্লিক অ্যাসিড ছিল RNA। এই RNA হল আদি জেনেটিক মেটেরিয়াল।

কোয়াসারভেট বা মাইক্রোস্ফিয়ারের সঙ্গে নিউক্লিক অ্যাসিড যুক্ত হয়েই তৈরি হয়েছিল প্রথম আদি কোশ বা প্রোটোসেল।

সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা আরও কমে যখন 50 ডিগ্রী সেন্ট্রিগ্রেড হয় তখন প্রোটোসেলের অন্তর্গত কলয়েড বস্তু মিলিতভাবে সাইটোপ্লাজম তৈরী করে। এই সাইটোপ্লাজম ছিল নগ্ন RNA যুক্ত অর্ধভেদ্য পর্দা দ্বারা আবৃত। প্রোটোসেল ছিল স্ব-প্রজননশীল। এর থেকে তৈরি হয়েছিল এককোশী জীব।

যদিও আদি যৌগগুলির সামগ্রিকভাবে একসাথে থেকে সংগঠিত হয়ে ওঠার সঠিক পদ্ধতি আজও অজানা। প্রোটোসেলের উৎপত্তি ও তাঁর বিবর্তনকে একত্রে বায়োজেনি বলে।


দশম শ্রেণির অন্যান্য বিভাগগুলি পড়ুন –ভৌতবিজ্ঞান | গণিত | জীবনবিজ্ঞান

অভিব্যক্তির মুখ্য ঘটনাবলি

অভিব্যক্তি একটি মন্থর ও জটিল প্রক্রিয়া। অভিব্যক্তিকে আমরা বেশ কয়েকটি ধাপের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে পারি।

  • প্রথমে, মহাকাশে বিভিন্ন রকম বিস্ফোরণের মাধ্যমে পৃথিবীর সৃষ্টি হয়।
  • তারপর তা থেকে ধীরে ধীরে বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জীবের উৎপত্তি ঘটে।
  • প্রথমদিকে এককোশী কেমোহেটরোট্রফ এরপরে এককোশী কেমোঅটোট্রফ জীবের সৃষ্টি হয়।
  • পরবর্তী ক্ষেত্রে কিছু এককোশী ব্যাকটেরিয়া সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় নিজেদের খাদ্য তৈরি করতে সক্ষম হয় এবং এর ফলে পরিবেশে প্রথম মুক্ত অক্সিজেনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
  • এই মুক্ত পরিবেশে তখন বহুকোশী জীবের উৎপত্তি হয়।
  • এরপর আস্তে আস্তে মাছের মত কিছু মেরুদন্ডী প্রাণী এবং বেশ কিছু অমেরুদন্ডী প্রাণীর উৎপত্তি ঘটে।
  • তারপর স্থলে থাকা বেশ কিছু উদ্ভিদের বিবর্তন ঘটে (যেমন – বীরুৎ, গুল্ম ও বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ)।
  • পৃথিবীতে নতুন নতুন বাসস্থানের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল।
  • এরপর আস্তে আস্তে আরো উন্নত ধরনের মেরুদন্ডী প্রাণীদের উদ্ভব ঘটে (যেমন – উভচর)।
  • উভচর প্রাণীরা তারপর ডাঙ্গায় উঠে এসে সেই পরিবেশের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিয়ে সৃষ্টি করে সরীসৃপ প্রাণীর। তারপর সেই সরীসৃপ থেকে পক্ষী ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর সৃষ্টি হয়।

দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

জৈব বিবর্তনের বা অভিব্যক্তির মতবাদ

অভিব্যক্তির ফলে নতুন প্রজাতির বা একটা প্রজাতি থেকে অন্য একটি প্রজাতির সৃষ্টি হয় সেটা আমরা জানলাম। এই বিবর্তনের জন্য প্রত্যেকটি প্রজাতিকে বেশ কিছু কৌশল আয়ত্ত করতে হয়েছে। সেই সব কৌশল সৃষ্টির সম্পর্কে বিভিন্ন তত্ত্বের কথা প্রচলিত আছে। তাদের মধ্যে বিজ্ঞানী ল্যামার্ক ও ডারউইনের তত্ত্বটি বিশেষভাবে প্রচলিত আছে, এখন আমরা এই তত্ত্ব দুটি সম্পর্কে জানব।

ল্যামার্কের তত্ত্ব বা ল্যামার্কনিজম (Lamarckism)

ফরাসী প্রকৃতিবিদ জ্যাঁ ব্যাপ্তিস্ত পিয়ের অ্যান্টনি দ্য মঁয়ে ল্যামার্ক (১৭৪৪- ১৮২৯) সর্বপ্রথম অভিব্যক্তি সম্পর্কিত তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যেগুলি তাঁর লেখা ‘ফিলোজফিক জুওলজিক’ (১৮০৯) নামক বইতে লিপিবদ্ধ করা আছে।

ল্যামার্কবাদের প্রতিপাদ্য বিষয়

  • পরিবেশের প্রভাব
  • অঙ্গের ব্যবহার ও অব্যবহারের সূত্র
  • অর্জিত বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকার সূত্র
  • নতুন প্রজাতির উৎপত্তি

ডারউইনের তত্ত্ব বা ডারউনিজম (Darwinism)

চার্লস রর্বাট ডারউইন (1809-1882) প্রাকৃতিক নির্বাচনবাদের (Natural selection) মাধ্যমে অভিব্যক্তির ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে এইচ এম বিগল (H M Beagle) জাহাজে করে দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল বরাবর বিভিন্ন দ্বীপে গবেষণামূলক কাজ করেন এবং ভ্রমণের সময় বিভিন্ন দ্বীপ থেকে নমুনা সংগ্রহ করেন।

ডারউইনের ভ্রমণ করা দ্বীপগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত গ্যালাপাগোস্ আইল্যান্ড। ডারউইনের সমস্ত মতবাদ ‘অরিজিন অফ স্পিসিস বাই মিনস অফ ন্যাচারাল সিলেকশন’ (1859) নামক বইতে প্রকাশিত হয়। ডারউইনের কাজে টি এস ম্যালথাস, আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেসের গবেষণার এবং ভূতাত্ত্বিক চালর্স লয়েলের কাজের প্রভাব ছিল। ডারউইনের মতবাদকে ডারুইনিজম বলে। বিবর্তন সম্পর্কীয় তাঁর মতবাদ ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ নামে পরিচিত।

ডারউইনবাদের ব্যাখ্যা

  • অত্যধিক প্রজনন হার
  • সীমিত খাদ্য ও বাসস্থান
  • অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম
  • প্রাকৃতিক নির্বাচন

ডারউইনের মতবাদের স্বপক্ষে প্রমাণ

ইন্ড্রাস্টিয়াল মেলানিজম হল প্রাকৃতিক নির্বাচনের একটি বাস্তব উদাহরণ, যা ডারউইনের মতবাদের স্বপক্ষের প্রমাণ। যুক্তরাজ্যে হালকা এবং গাঢ় রঙের মথ ছিল। লাইকেনের রঙ হালকা ছিল, তাই গাঢ় রঙের মথ শিকারিদের চোখে পড়ত বেশি। তাই তাদের সংখ্যা কমে যেতে লাগল। তখন বেশি পরিমাণে হালকা রঙের মথ দেখা যেত। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের সময় চারিদিকে ধুলোময় পরিবেশ হয়ে যাওয়ায় হালকা রঙের মথগুলো গাঢ় রঙের হয়ে গেছিলো এবং কিছু হালকা রঙের মথ শিকারীদের চোখে পড়ে। যার ফলে হালকা রঙের মথ কমে গেছিলো। কিন্তু ১৯৫৬ সালে ক্লিন এয়ার অ্যাক্ট (Clean Air Act) পাস হওয়ার পর পরিবেশ আগের মতো পরিষ্কার হয়ে যাওয়ায় গাঢ় রঙের মথগুলি আবার শিকারীদের চোখে পড়ে এবং শিকারে পরিণত হয়েছিল। এইভাবে প্রকৃতির সাথে পরিবর্তনই হল প্রাকৃতিক নির্বাচন।

ডারউইনের মত অনুসারে ‘জিরাফের লম্বা গলার’ বিবর্তনের ব্যাখ্যা

ডারউইনের মতে জিরাফের পূর্বপুরুষদের বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের গলা দেখতে পাওয়া যেত। প্রথম দিকে যখন জিরাফেরা ঘাস, বীরুৎ জাতীয় উদ্ভিদকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করত, তখন তাদের লম্বা গলার প্রয়োজন হতো না। কিন্তু পরবর্তীকালে যখন এই স্বল্প দৈর্ঘ্যের উদ্ভিদের ঘাটতি হয়েছিল তখন তারা উঁচু গাছের পাতা খেতে বাধ্য হয়েছিল। যার ফলে দীর্ঘ গ্রীবার প্রয়োজন হয়েছিল।

এই সময় স্বল্প গ্রীবা দৈর্ঘ্যের জিরাফগুলি না খেতে পেয়ে মারা যায় এবং শুধুমাত্র দীর্ঘ গ্রীবা দৈর্ঘ্যের জিরাফরাই বেঁচে থাকতে সক্ষম হয়েছিল এবং জননের মাধ্যমে এই বৈশিষ্ট্য বংশানুক্রমে সঞ্চারিত হতে থাকে। তার ফলে একসময় খর্ব গ্রীবা যুক্ত জিরাফদের অবলুপ্তি ঘটে। প্রাকৃতিক নির্বাচনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, দীর্ঘ গ্রীবা যুক্ত জিরাফগুলি প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছিল।

ডারউইনবাদের ত্রুটি

বর্তমানে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করলে ডারউইনের মতবাদের বেশ কিছু ত্রুটি দেখা যায়। যেমন –

  • ডারউইন যে প্রকরণের কথা বলেছিলেন সেই প্রকরণ কিভাবে সৃষ্টি হয় তা সম্পর্কে তিনি কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।
  • ডারউইনের মত অনুসারে উন্নত প্রকরণ বিশিষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলি বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হয়। কিন্তু বংশগত রোগগুলি ক্ষতিকর হলেও তা জনিতৃ জনু থেকে অপত্য জনুতে সঞ্চারিত হয়। যার ব্যাখ্যা ডারউইনের মতবাদ দিয়ে করা যায় না।
  • ডারউইন যোগ্যতমের বেঁচে থাকার কথা বললেও তাদের আবির্ভাব সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।
  • ডারউইন প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রতি বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। কিন্তু অভিব্যক্তির আসল কারণ হলো প্রকরণ যার সম্পর্কে তিনি খুব বেশি ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।

ল্যামার্কবাদ ও ডারউইনবাদ-এর মধ্যে পার্থক্য

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → অভিব্যক্তির মতবাদ স্বপক্ষে প্রমাণ


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X-Lsc-4a