bayur-sonchoy-kajer-fole-sristo-vumirup
Madhyamik

বায়ুর সঞ্চয় কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ

ভূগোল দশম শ্রেণি – বহির্জাত প্রক্রিয়া ও তাদের দ্বারা সৃষ্ট ভূমিরূপ (পর্ব – 7)

আগের পর্বে আমরা বায়ুর কাজের ধারণা সম্পর্কে জেনেছি। এই পর্বে আমরা বায়ুর সঞ্চয় কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ সম্পর্কে আলোচনা করবো।


এই ভিডিও থেকে দেখে নাও বায়ুর সঞ্চয়কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা↓

1. বালিয়াড়ি

বাতাসের দ্বারা পরিবাহিত বালুকণা যখন ভূমিতে সঞ্চিত হয়ে দীর্ঘ ও উঁচু বালির স্তুপ গঠন করে তখন তাকে বালিয়াড়ি বলা হয়। বালিয়াড়ি বায়ুপ্রবাহের সাথে আড়াআড়ি বা সমান্তরালে গঠিত হয়। অনেক ক্ষেত্রেই বালিয়াড়িগুলি স্থান পরিবর্তন করে থাকে।

রাজস্থানের থর মরুভূমিতে এরকম অনেক চলমান বালিয়াড়ি দেখা যায় যাদের ‘ধ্রিয়ান’ বলা হয়।

বায়ুর প্রবাহের দিক অনুসারে বালিয়াড়ির প্রকারভেদ

বায়ুর প্রবাহের দিক অনুসারে বালিয়াড়ির দুই ধরণের হয়। সেগুলো হল –

ক. তির্যক বালিয়াড়ি

বায়ুপ্রবাহের সাথে আড়াআড়িভাবে গঠিত অনেকটা একফালি চাঁদের মতো আকৃতিবিশিষ্ট বালিয়াড়িকে তির্যক বালিয়াড়ি বলা হয়। এই বালিয়াড়িগুলি অপ্রতিসম হয়ে থাকে। এদের প্রতিবাদ ঢালটি মৃদু ঢাল বিশিষ্ট হয়ে থাকে ও অনুবাদ ঢালটি খাড়া হয়ে থাকে।

উদাহরণস্বরূপ বার্খান হলো একটি তির্যক বালিয়াড়ি।

বার্খান বায়ুপ্রবাহের সাথে আড়াআড়িভাবে গঠিত হয়ে থাকে এবং অর্ধচন্দ্রাকৃতি হয়ে থাকে।

বার্খান
বার্খান [Image by Daniel Mayer, source en.wikipedia, licensed under CC BY-SA 3.0]

বার্খানের উচ্চতা 15 – 30 মিটার ও বিস্তার 5 – 200 মিটার হতে পারে। বার্খান-এর প্রতিবাদ ঢাল উত্তল হয়ে থাকে ও অনুবাদ ঢাল অবতল হয়ে থাকে। ক্রমশ বর্ধমান বারখনগুলি একে অপরের সাথে জুড়ে বার্খানয়েড গঠন করে। একে মেগা বারখান ও বলা হয়।

বার্খানের বৈশিষ্ট্য

● এরা আকৃতিতে প্রতিসম হয়ে থাকে।
● বার্খানের সিং দুটি বায়ু প্রবাহের দিকের সাথে সমান্তরালে অবস্থান করে।
● দৈর্ঘ্য প্রস্থের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বার্খান বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। বায়ুপ্রবাহের দিকে বার্খান বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় হয়। তাই বার্খানের দিকটি বেশি দীর্ঘ হয়ে থাকে।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

jump magazine smart note book


খ. অনুদৈর্ঘ্য বালিয়াড়ি বা সিফ বালিয়াড়ি

বায়ুপ্রবাহের সমান্তরালে গঠিত দীর্ঘ সংকীর্ণ শৈলশিরার মতো আকৃতির বালিয়াড়িকে অনুদৈর্ঘ্য বা সিফ বালিয়াড়ি বলা হয়। বছরের বেশিরভাগ সময় নিয়মিত বায়ুপ্রবাহের ফলে এই বালিয়াড়ি সৃষ্টি হয়। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বায়ু প্রবাহের অভিমুখ পরিবর্তন হলে দুদিক থেকে বায়ু প্রবাহিত হয়ে বালিয়াড়িগুলিকে তলোয়ারের মত আকৃতি প্রদান করে। এই জন্য এই বালিয়াড়িকে সিফ (আরবি অর্থ তলোয়ার) বালিয়াড়িও বলা হয়।

অনুদৈর্ঘ্য বালিয়াড়ি বৈশিষ্ট্য

● এই বালিয়াড়িগুলি সমান্তরাল ও দীর্ঘ হয়ে থাকে।
● এদের প্রস্থ উচ্চতার ছয় গুণ পর্যন্ত হতে পারে। ইরানে এই বালিয়াড়িগুলি প্রায় 210 মিটার অব্দি হয়ে থাকে।
● দুটি সমান্তরাল অনুদৈর্ঘ্য বালিয়াড়ির মাঝে বালিহীন করিডোরকে হামাদা বলা হয়। এই হামাদা দুটি বালিয়াড়িকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে থাকে। সাহারা মরুভূমিতে এইবালি বিহীন করিডোরগুলিকে গাসি ও গউড বলা হয়।

2. লোয়েস

বায়ুর বহন কার্যের ফলে পরিবাহিত কোয়ার্টজ, অভ্র, ক্যালসাইট, ডলোমাইট, ফেল্ডস্পার ও অন্যান্য খনিজ গঠিত হলদে বা ধূসর হলদে রং-এর বালিকণার সঞ্চয়কে লোয়েস বলা যায়। মধ্য এশিয়ার গোবি মরুভূমির লয়েশ দার উত্তর পশ্চিম চীনের হোয়াংহো নদী উপত্যকায় লোয়েস সমভূমি গড়ে উঠেছে।

বায়ু ও জলধারার মিলিত কার্যের ফলে গঠিত ভূমিরূপ

মরুভুমিতে বায়ু ও জলের মিলিত কাজের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপগুলির উৎপত্তির মূল কারন হল মরু অঞ্চলের স্বল্প অথচ তীব্র বৃষ্টিপাত। মরু অঞ্চলে বায়ুর কাজ চলে সারাবছর। কিন্তু জল ও বায়ুর মিলিত কাজ চলে বছরের খুব স্বল্প পরিসর সময়ের মধ্যে।

মরুভুমিতে বায়ু ও জলের মিলিত কাজের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপগুলির উৎপত্তির মূল কারন হল মরু অঞ্চলের স্বল্প অথচ তীব্র বৃষ্টিপাত। মরু অঞ্চলে বায়ুর কাজ চলে সারাবছর। কিন্তু জল ও বায়ুর মিলিত কাজ চলে বছরের খুব স্বল্প পরিসর সময়ের মধ্যে।
বায়ু ও জলধারার মিলিত কাজের ফলে গঠিত ভূমিরূপগুলি হল নিম্নরুপঃ

1. পেডিমেন্ট

মরু অঞ্চলে উচ্চভূমি থেকে নিম্নভূমির মিলনস্থলে সংগঠিত স্বল্প ঢাল যুক্ত ভূমিরূপ হল পেডিমেন্ট। ইহা ক্ষয় ও সঞ্চয় কাজের মিলিতি রুপ ।
অনেকগুলি পেডিমেন্ট একসাথে মিলিত হয়ে গঠিত হয় পেডিপ্লেন। পেডিমেন্টের পিছনে কিছু অনুচ্চ টিলা দেখা যায় যা ‘ইন্সেলবারজ’ নামে পরিচিত।


jump magazine smart note book


2. পলল ব্যজনি:

উচ্চভুমি থেকে জলধারার দ্বারা বয়ে আনা নুড়ি কাঁকর বালি উচ্চভূমির পাদদেশে সঞ্চিত হয়ে যে ত্রিকোনাকার ভূমিরূপ গঠিত করে তা পলল ব্যজনি নামে পরিচিত।

3. প্লায়া

মরু অঞ্চলের পাহাড় ঘেরা আবনমিত ভুমিতে জল সঞ্চয়ের ফলে যে লবনাক্ত হ্রদ তৈরি হয় তা প্লায়া নামে পরিচিত।

উপগ্রহ চিত্রের সাহায্যে প্লায়া

এই প্লায়া দক্ষিণ আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া তে ‘প্যান’, দক্ষিণ আমেরিকায় ‘স্যালিনা’ ও আরবে ‘শট’ বা ‘সবখা’ নামে পরিচিত।

4. বাজাদা

প্রবল বর্ষণের ফলে প্লায়া ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে গঠিত পলি সঞ্চিত সমভুমিকেই বলা হয় বাজাদা।

বাজাদা [image by NachoBen, licensed under CC BY-SA 4.0]

5. ওয়াদি

মরু অঞ্চলে সল্পমেয়াদি বর্ষণের ফলে উৎপন্ন নদীখাত ওয়াদি নামে পরিচিত। এই নদীখাত বছরের অধিকাংশ সময়ে শুষ্ক থাকে। কোন স্থায়ী নদী ওয়াদির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়না।

ওয়াদি [Image by Olga Ernst, licensed under CC BY-SA 4.0]

মরু অঞ্চলের প্রসারণ ও প্রতিরোধের উপায়

প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট কারণে যখন উৎপাদনশীল ব্যবহারযোগ্য জমি সম্পূর্ণরূপে ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে ওঠে তখন তাকে মরুভূমি বলা হয়। ভূমির এই রূপান্তরকেই মরুকরণ বলা হয়। সাধারণত মরু অঞ্চলের সংলগ্ন শুষ্ক বা প্রায় শুষ্ক অঞ্চলে এই মরুকরণ হয়ে থাকে। UNESCO-FAO অনুসারে ভূমির জৈবিক ক্ষমতা ধ্বংস বা হ্রাস হওয়ার ফলে মরুভূমির অনুরূপ যে পরিবেশ সৃষ্টি হয় তাকে মরুকরণ বলা হয়।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

মরুভূমির প্রসারের কারণসমূহ

1. জলবায়ু পরিবর্তন: মরুভূমি অঞ্চলের আবহাওয়া অত্যন্ত রুক্ষ ও শুষ্ক হওয়ার দরুন যান্ত্রিক আবহবিকার বেশি হয় ফলে উৎপন্ন বালি ও পাথর চূর্ণ সহজেই বায়ু দ্বারা বাহিত হয়ে সংলগ্ন এলাকায় সঞ্চিত হয়ে মরুভূমির প্রসার ঘটে।

2. লবণ সঞ্চয়: শুষ্ক অঞ্চলে অতিরিক্ত বাষ্পীভবনের কারণে মাটিতে অবস্থিত লবণ কৈশিক প্রক্রিয়ায় মাটির উপরে উঠে আসে ও লবণের পুরু আস্তরণ তৈরি করে। এরফলে উদ্ভিদ জন্মাতে পারেনা ও ভূমি চাষ আবাদের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে এই স্থানটি মরুভূমিতে পরিণত হয়ে যায়।

3. বায়ু ও জলধারার দ্বারা ক্ষয়: মরুভূমি অঞ্চলে প্রবল বৃষ্টি ভূমির উপরের স্তরের মাটি ধুয়ে অপসারিত করে নিচের শিলাময় স্তর উন্মুক্ত করে তোলে। এছাড়া মরুভূমিতে শিলার প্রচন্ড পরিমাণে যান্ত্রিক আবহবিকারের কারণে ক্ষয় হয় ও প্রবল অবাধ বায়ুপ্রবাহের দ্বারা তা অনেক দূর অব্দি বিস্তৃত হয়। এভাবেই মরুভূমির প্রসার ঘটে।

4. অবাধ পশুচারণ: অতিরিক্ত পশুচারণের ফলে ভূমি ক্রমশ উদ্ভিদ শূন্য হয়ে পড়ে। ফলে পার্শ্ববর্তী মরুভূমি অঞ্চল থেকে বাহিত বালি সহজেই সেই অংশ আবৃত করে ফেলে।
5. নির্বিচারে বৃক্ষচ্ছেদন: জ্বালানি এবং অনান্য কারণে নির্বিচারে গাছ কাটার জন্য পরবর্তীকালে এই উদ্ভিদহীন অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হয়।

6. অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জলসেচ ও কৃষিকাজ: শুষ্ক মাটির উপযুক্ত ফসল চাষ ( যেমন – মিলিত জাতীয় শস্য) এর বদলে অন্য ফসলের চাষ করলে ভৌমজলের অতিরিক্ত উত্তোলন হয় ফলে মাটি শুষ্ক হয়ে পড়ে। ভৌমজলের সাথে সাথে কৈশিক প্রক্রিয়ায় লবণ উপরে উঠে আসলে ভূমি লবণাক্ত ও অনুর্বর হয়ে ওঠে।

থর ও সাহারা মরুভূমির প্রসার

এসব কারণের জন্য ভারতের থর মরুভূমি পূর্বদিকে প্রায় আরাবল্লী পর্বত পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে। রাজস্থানের প্রায় 67% এলাকা আজকে মরুকরণের শিকার। উপগ্রহ চিত্র অনুযায়ী আফ্রিকার সাহারা মরুভূমিও দক্ষিণে বছরে প্রায় পাঁচ কিমি করে প্রসারিত হচ্ছে।

সাহারা মরুভূমি

মরুভূমির প্রসার প্রতিরোধের উপায়

মরুকরণ রোধের জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলে মরুকরণ অনেকাংশে আটকানো সম্ভব হয়। সেগুলো হল –

● শুষ্ক জলবায়ু সহ্য করতে পারে এরকম উদ্ভিদ মরুভূমির সীমায় রোপণ করা।
● বিভিন্ন উদ্ভিদ রোপণের মাধ্যমে শেল্টার বেড তৈরি করতে হবে যা তীব্র গতিতে প্রবাহিত বায়ুকে প্রতিহত করতে পারবে।
● নির্বিচারে বৃক্ষচ্ছেদন বন্ধ করতে হবে ও নতুন বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
● অবাধ পশুচারণ ও অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ বন্ধ করতে হবে।
● জমির চরিত্র অনুযায়ী কৃষি পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।
● ভৌমজলের যথাযথ ব্যবহার ও উত্তোলন করতে হবে।
● মাটির আদ্রতা বজায় রাখতে জাতীয় নদী অববাহিকা কর্মসূচি অবলম্বন করতে হবে।

অধ্যায় সমাপ্ত।


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X-Geo-1g