varoter-bohumukhi-nodi-porikolpona-jol-songrokkhon
Madhyamik

ভারতের বহুমুখী নদী পরিকল্পনা ও জল সংরক্ষণ

ভূগোলদশম শ্রেণি – আঞ্চলিক ভূগোল (নবম পর্ব)

আগের পর্বে আমরা ভারতের হ্রদ ও উপহ্রদ সম্পর্কে আলোচনা করেছি এই পর্বে আমরা ভারতের বহুমুখী নদী পরিকল্পনা ও জল সংরক্ষণ সম্পর্কে জেনে নেবো।

যে পরিকল্পনার মাধ্যমে নদীর উপর বাঁধ দিয়ে জলাধার বা ব্যারেজ নির্মাণ করে সেই জল দিয়ে যখন বিভিন্ন উদ্দেশ্য সাধন করা হয় ও পাশাপাশি নদী অববাহিকায় বসবাসকারী জনগণের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সাধন করা হয়, তখন তাকে বহুমুখী নদী পরিকল্পনা বলা হয়।


ভারতের বহুমুখী নদী পরিকল্পনা ও জল সংরক্ষণ ভিডিও ক্লাস↓


বহুমুখী পরিকল্পনার উদ্দেশ্য

বহুমুখী পরিকল্পনার উদ্দেশ্য হল বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলসেচ, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, মৎস্যচাষ, পর্যটন, নৌ-পরিবহন, পানীয় জলের যোগান, শিল্পক্ষেত্রে জলের যোগান ইত্যাদি।

এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অংশের পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখার সাথে ওই অঞ্চলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রচেষ্টা করা হয়।


jump magazine smart note book


ভারতের প্রধান নদী উপত্যকা পরিকল্পনা

ভারতের প্রধান নদী উপত্যকা পরিকল্পনাগুলি হল –

1. পাঞ্জাবের বিপাশা ও শতদ্রু নদীর উপর নির্মিত ভাকরা-নাঙ্গাল পরিকল্পনা হল ভারতের বৃহত্তম বহুমুখী নদী পরিকল্পনা।

2. ঝাড়খন্ড পশ্চিমবঙ্গের দামোদর নদীর উপর গড়ে ওঠা দামোদর উপত্যকা পরিকল্পনা।

3. ওড়িশার মহানদীর উপর হিরাকুদ পরিকল্পনা।

4. বিহারের কোশি নদীর উপর কোশি পরিকল্পনা।

5. উত্তর প্রদেশ বিহারের যৌথ উদ্যোগে গড়ে ওঠা গণ্ডক নদীর উপর গণ্ডক পরিকল্পনা।

6. অন্ধপ্রদেশ ও কর্নাটকের তুঙ্গভদ্রা নদীর উপর তুঙ্গভদ্রা পরিকল্পনা।

7. মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রে নর্মদা নদীর উপর নর্মদা উপত্যকা পরিকল্পনা।

8. তেলেঙ্গানার কৃষ্ণা নদীর উপর নাগার্জুন সাগর পরিকল্পনা।

9. রাজস্থান মধ্যপ্রদেশের চম্বল নদীর উপর চম্বল নদী পরিকল্পনা।

দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন

দামোদর নদীকে পশ্চিমবঙ্গের দুঃখ বলা হত, কারণ প্রত্যেক বছর এর নিম্ন উপত্যকায় ভয়ংকর বন্যায় জনজীবন বিপর্যস্ত হত।

দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন তৈরির কারণ

এই নদীর উচ্চ অববাহিকা অঞ্চলে খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ।
এই অঞ্চলের বন্যা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কৃষির উন্নতি ও খনিজ সম্পদের সাহায্যে শিল্পের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা তৈরি করার জন্য দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন এই নদী পরিকল্পনা তৈরি করেছিল, যা ‘দামোদর উপত্যকা পরিকল্পনা’ নামে পরিচিত।
এই পরিকল্পনার উজ্জ্বল সম্ভাবনার জন্য এই উপত্যকাকে বহুমুখী নদী উপত্যকা পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

DVC এর পাঞ্চেত বাঁধের চিত্র (Baranwalalok71, Licensed under, CC BY-SA 4.0)

দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন পরিকল্পনার উদ্দেশ্য

আমেরিকার টেনেসি উপত্যকা পরিকল্পনার অনুকরনে 1948 সালে দামোদর উপত্যকা পরিকল্পনা গৃহীত হয়।

এই পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্যগুলি হল –

● খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ দামোদর উপত্যকায় জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে ধাতব শিল্পের উন্নতি।

● জলাধারের জলসেচের কাজে ব্যবহার করে কৃষিকাজের উন্নতি সাধন ও পতিত জমি পুনরুদ্ধার।

কৃষিক্ষেত্রে জলসেচ ব্যবস্থা

● নিম্ন উপত্যকায় বন্যা ও ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ।

● নৌ-পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন।

● জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও মৎস্য চাষ।

● পর্যটন শিল্পের উন্নতি।

● সংলগ্ন অঞ্চলে বনভূমির সৃজনের মাধ্যমে মৃত্তিকা ক্ষয় ও পরিবেশ দূষণ রোধ।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন পরিকল্পনা থেকে প্রাপ্ত সুবিধা

● বন্যা নিয়ন্ত্রণ

দামোদর পরিকল্পনা বাঁধ ও জলাভূমিগুলি স্থাপনের ফলে নিম্ন উপত্যকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে।

● জলসেচ এবং কৃষির উন্নয়ন

জলাধারগুলি থেকে সেচ খাল কাটা হয়েছে, যার মাধ্যমে জলসেচ প্রক্রিয়ার উন্নতি সাধন করা গেছে এবং বহু ফসলি কৃষি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।

● বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন

তিলাইয়া, কোনার, পাঞ্চেত প্রভৃতি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে এবং অনেকগুলি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। এই বিদ্যুৎ পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড, বিহারে সরবরাহ করা হচ্ছে।

● শিল্প

এই অঞ্চল প্রাপ্ত সম্পদ ও উৎপন্ন বিদ্যুতের জন্য দুর্গাপুর, আসানসোল, রানীগঞ্জ প্রভৃতি শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠেছে।

● মৎস্য চাষ

জলাধারগুলিতে স্থায়ীভাবে সারা বছর জল থাকায় এখানে মৎস্য চাষ করা হয়, যা স্থানীয় মানুষের জীবিকা নির্বাহের একটি পথ নির্মাণ করেছে।

● অন্যান্য

এই পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে। যেমন – দুর্গাপুর খাল কলকাতার সাথে দুর্গাপুরের জলপথে সংযুক্তি ঘটিয়েছে।

জল সংরক্ষণ

মানবজীবনে স্বাদু জলের চাহিদা সবথেকে বেশি। কিন্তু ভয়ের ব্যাপার এই যে দিন দিন স্বাদু জলের পরিমাণ ফুরিয়ে আসছে, তাই আগামী প্রজন্মের জন্য জল সম্পদের সংরক্ষণ করা অতি প্রয়োজন।

জল সংরক্ষণের গুরুত্ব

মূলত যে কারণে জল সংরক্ষণের প্রয়োজন সেগুলি হল –

● ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য পর্যাপ্ত জলের যোগান সুনিশ্চিত করা।

● কৃষি কাজে জলের চাহিদা পূরণ করা।

● পানীয় জল হিসাবে স্বাদু ও স্বাস্থ্যকর জলের যোগান বজায় রাখা।

● শিল্প ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জলের যোগান বজায় রাখা।

জল সংরক্ষণের পদ্ধতি

● প্রয়োজনের অতিরিক্ত জল যেন ব্যবহার না করা হয়।

একবার ব্যবহৃত জলকে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিশোধন করে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে হবে। শিল্পের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে এই পদ্ধতি কার্যকর করতে হবে।

● বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা, জলবিভাজিকা ও নদী অববাহিকা উন্নয়নের মাধ্যমে জল বন্টন ও জলের ব্যবহারকে সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

● সুপরিকল্পিত কৃষি ব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রয়োজনে মাটি থেকে অতিরিক্ত জলের শোষণ প্রতিরোধ।

● সরকার থেকে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। যেমন – পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘জল ধরো জল ভরো’ পরিকল্পনা।

নদী অববাহিকা বা জলবিভাজিকা উন্নয়ন

জনগণের উন্নয়নের উদ্দেশ্যে জলবিভাজিকা বরাবর জলসম্পদ, মৃত্তিকা ও বনভূমি সংরক্ষণ ও তার যথাযথ ব্যবহারের পরিকল্পনা এবং রূপায়নের ব্যবস্থাকে জলবিভাজিকা উন্নয়ন বলা হয়।

জলবিভাজিকাগুলিকে শুষ্ক অঞ্চলে বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চলের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থাপনা করা হয়।

শুষ্ক অঞ্চলে জলবিভাজিকার গৃহীত ব্যবস্থাগুলি হল –

● খরার সময় জলের উপর ঢাকা দিয়ে বাষ্পীভবন প্রতিরোধ করা।

● জলের অনুস্রাবন প্রক্রিয়া বন্ধ করার জন্য নদীখাতকে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো।

● শুষ্ক কৃষি পদ্ধতি অবলম্বন করে কৃষি কাজ করা।

● বর্ষার শুরুতে মাটিতে লাঙ্গল দিয়ে রাখা যাতে বৃষ্টির জল ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়ে।

● ঢালের পাদদেশে গর্ত তৈরি করে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করা।

● জলাশয়গুলিকে গভীর করে বৃষ্টির জল দ্বারা ভৌম জলস্তরের বৃদ্ধি ঘটানো।

● পুকুর কেটে বৃষ্টির জল ধরে রাখা।

বৃষ্টিবহুল অঞ্চলে জলবিভাজিকার গৃহীত ব্যবস্থাগুলি হল

● ধারণ অববাহিকা অঞ্চলে সিঁড়ির মত ধাপ কেটে জল ধরে রাখার জায়গা তৈরি করা।

● নদীতে আড়াআড়িভাবে ছোট ছোট বাঁধ তৈরি করে জল ভান্ডার গড়ে তোলা।

● ভূমিধস প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা।

● ধারণ অববাহিকায় গাছ লাগিয়ে মাটির ক্ষয় প্রতিরোধ এবং বৃষ্টির জল যাতে ভৌমজল স্তর বৃদ্ধি করতে পারে সেই দিকে দৃষ্টিপাত করা।

● নদীখাতগুলোকে পরিষ্কার রাখা যাতে সঠিক জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা বজায় থাকে।

বৃষ্টির জল সংরক্ষণ

জলসম্পদ সংরক্ষণের অন্যতম কার্যকরী পদ্ধতি হল বৃষ্টির জল সংরক্ষণ। বৃষ্টির জলকে বিভিন্নভাবে সংরক্ষণ করা যায় এবং সেই সঙ্গে ভৌম জলস্তরকে পূরণ করা সম্ভব হয়।

বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করার কিছু উপায় হল –

● মাটিতে 2 থেকে 3 মিটার গভীর গর্ত খোঁড়া।

● প্রবেশ্য শিলাস্তরের উপর ছোট ছোট নানা কাটা।

● 200 থেকে 300 মিটার ব্যাসের গভীর কূপ খনন করা।

● নলকূপের পাইপের মধ্যে দিয়ে জল ভূগর্ভে ঢুকিয়ে ভৌমজলের ভাণ্ডার পূরণ করা।

● বাড়ির ছাদে বৃষ্টির জলকে পাইপের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা এবং ভূগর্ভস্থ জলাধারে সঞ্চয় করা। এই সংরক্ষিত বৃষ্টির জল পরবর্তীকালে জামাকাপড় ধোঁয়া, স্নান, বাসন মাজা, গাড়ি ধোয়া, বাগান তৈরি প্রভৃতি বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যায়।

বর্তমানে তামিলনাড়ু, মধ্যপ্রদেশ, ছত্রিশগড় রাজস্থান ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন রাজ্যে বৃষ্টির জল সংরক্ষণের উদ্যোগ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

জল সংরক্ষণে তামিলনাড়ুর অগ্রণী ভূমিকা

2001 সালে তামিলনাড়ু সরকার বৃষ্টির জল সংগ্রহ করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল এবং এর ফলে সমগ্র রাজ্যে ভৌমজলের ভাণ্ডার অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে যায়।


jump magazine smart note book


বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করার জন্য একটি বিশেষ কাঠামো তৈরি হয়েছে এবং তা বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। এছাড়া এই শহরের পুরনো বাড়িগুলোকে সংস্কার করে বৃষ্টির জল সংগ্রহের উপযোগী করা হয়েছে।

এই পর্যন্ত শহরের পঞ্চায়েত এলাকার 23.92 লক্ষ বাড়ির মধ্যে 22.94 লক্ষ বাড়িতে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করা হয়।

বৃষ্টির জল সংরক্ষণের উদ্যোগ সফল করার জন্য সরকার যে সমস্ত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সেগুলি হল –

● পরিবেশ সংরক্ষণ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচার চালানো।

● বিভিন্ন NGO ও সমাজ কল্যাণ সংস্থাগুলি দ্বারা সচেতনতা বৃদ্ধি।

● বৃষ্টির জল সংরক্ষণের গুরুত্ব বুঝিয়ে রাস্তায় হোর্ডিং নির্মাণ।

● বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার।

● বৃষ্টির জল সংরক্ষণের কাঠামো নির্মাণে সরকারি দপ্তর থেকে বোঝানোর ব্যবস্থা এবং এই কাঠামো নির্মাণে সরকার থেকে সহায়তা প্রদান।

জল সংরক্ষণের ফলাফল

● এই রাজ্যের চেন্নাই শহরের ভৌম জলের ভাণ্ডার প্রায় 50% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।

● রাস্তায় বর্ষায় জল জমার পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে এর ফলে সারা রাজ্যে বন্যার প্রকোপ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।

● পানীয় জল ও সেচের জন্য জলের সমস্যা অনেকাংশে মিটেছে।

● সংরক্ষিত জল কৃষিকার্যে প্রয়োগের ফলে কৃষির বিকাশ ঘটেছে।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → ভারতের জলবায়ু

লেখিকা পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রাক্তনী শ্রেয়সী বিশ্বাস। পড়াশোনা এবং লেখালিখির পাশাপাশি, ছবি আঁকা এবং বাগান পরিচর্যাতেও শ্রেয়সী সমান উৎসাহী।



এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X-Geo-5-a-9