borjyer-dharona-ebong-poribesher-upor-probhab
Madhyamik

বর্জ্যের ধারণা এবং পরিবেশের উপর প্রভাব

ভূগোলদশম শ্রেণি – বর্জ্য ব্যবস্থাপনা (প্রথম পর্ব)

আজকের পর্বে আমরা বর্জ্যের ধারণা এবং পরিবেশের উপর প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

বাড়ি বা বিদ্যালয় বা হাসপাতাল বা অন্য যে কোনো জায়গায় পরিবেশ পরিস্কার ও পরিছন্ন হওয়া অবশ্যই দরকার। এজন্য প্রতিদিন এইসব জায়গায় যত আবর্জনা জমে, সব পরিষ্কার করা হয়। কোনো জিনিস ব্যবহার করার পর বা কোনো খাবারের অবশিষ্ট অংশ ফেলে দেওয়া হলে, তাকে আবর্জনা বা বর্জ্য বলে।

এইসব আবর্জনা নানান রকমের হয়, যেমন – খাবারের অবশিষ্ট অংশ, ফলের খোসা, বীজ, আঁটি, কাগজের ঠোঙা, পলিথিন, খাবারের খালি প্যাকেট, মোড়ক কাগজ, জলের পাউচ বা বোতল। এইরকম বিদ্যালয়েও নানানরকম আবর্জনা থাকে। শ্রেণীকক্ষে ফেলে দেওয়া কাগজের টুকরো, চক বা পেন্সিলের টুকরো, ভাঙা চেয়ার বা টেবিল, ভাঙা বেঞ্চের স্তূপ, বিকল কম্পিউটার বা টিউবলাইট ইত্যাদি।

এছাড়াও রোজকার দিনের যাতায়তের পথে আমরা নিত্য ব্যবহৃত জিনিসের ফেলে দেওয়া অংশ আবর্জনা বা বর্জ্য ফেলার জায়গায় দেখে থাকি। এই আবর্জনাগুলোকে আলাদা করে পরিষ্কার করা হয়, যেমন – খাবার বা ফলের খোসা বা এরকম পচনশীল বস্তুকে আমরা জৈব বর্জ্য পদার্থ বলে থাকি। আবার জলের বোতল, প্লাস্তিকের জিনিস বা পলিথিন যেগুলো কখনই পচে যায় না, সেগুলো অজৈব বর্জ্য পদার্থ।


jump magazine smart note book


বর্জ্য কাকে বলে?

বর্জ্য পদার্থের এই ধারণা থেকেই বর্জ্য কাকে বলে তা সহজেই জানা যায়। সাধারণত পরিত্যক্ত বা ফেলে দেওয়া কঠিন, তরল, গ্যাসীয় পচনশীল বা অপচনশীল পদার্থ যা ব্যবহারকারীর কাছে আপাতভাবে কোনো প্রয়োজনে লাগে না, তাকে বর্জ্য বলে। সাধারণভাবে প্রতিদিনের আবর্জনা ও জঞ্জালরূপে ফেলে দেওয়া সবরকম দ্রব্যকে বর্জ্য বলে।

বর্জ্যের প্রকারভেদ

ক্ষেত্রবিশেষ ব্যবহার এবং পরিত্যক্ত জিনিসের প্রকৃতি অনুসারে বর্জ্য পদার্থ মূলত পাঁচ প্রকারের হয়। যথা –

ক। কঠিন বর্জ্য – সাধারণত শহরে ময়লা ফেলার স্থানে যেসব পরিত্যক্ত পদার্থ স্তূপ আকারে পড়ে থাকে, তাদের কঠিন বর্জ্য বলে। খাবারের অংশ, গৃহস্থালির দ্রব্য, নির্মাণকাজের বর্জ্য, পরিত্যক্ত যন্ত্রাংশ ইত্যাদি হল কঠিন বর্জ্য।

খ। তরল বর্জ্য – যে-কোনো অব্যবহারযোগ্য তরল পদার্থই হল তরল বর্জ্য। যেমন – গ্রিজ, মেশিনে ব্যবহৃত মোবিল, ব্যবহৃত রঙ ইত্যাদি।

গ। গ্যাসীয় বর্জ্য – সাধারণত কলকারখানা, যানবাহন, গবেষণাগার থেকে যেসব গ্যাস নির্গত হয়, তাদের গ্যাসীয় বর্জ্য বলে।

কলকারখানা থেকে নির্গত গ্যাসীয় বর্জ্য

ঘ। বিষাক্ত বর্জ্য – যেসব বর্জ্য থেকে জল, বাতাস দূষিত হয়। মানুষের স্বাস্থ্যহানি ঘটে বা মৃত্যু হয়, তাকে বিষাক্ত বর্জ্য বলে। এইসব বর্জ্য কঠিন বা তরল দুইই হতে পারে। বিভিন্ন রাসায়নিক ধাতু বা প্যাথজেন থেকে এইরকম বর্জ্য তৈরি হয়। পারমানবিক কেন্দ্র থেকেও অনেকসময় বিশাক্ত বর্জ্য নির্গত হয়। মূলত কলকারখানা, রাসায়নিক পরীক্ষাগার, কৃষিক্ষেত্র, হাসপাতাল এইসব জায়গা থেকে বিষাক্ত বর্জ্য জলে বা বাতাসে মেশে।

ঙ। বিষহীন বর্জ্য – যেসব বর্জ্য কোনোরকম বিষক্রিয়া তৈরি করে না এবং প্রাণীদের কোনোরকম হানি ঘটায় না অথবা পরিবেশে কোনো সংকটজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে না, সেগুলিকে বিষহীন বর্জ্য বলা যায়। যেমন – শুকনো পাতা, গাছের অংশ, ডালপালা ইত্যাদি।

বর্জ্যের উৎস

বিভিন্ন প্রকারের যেসব বর্জ্যের নাম আমরা জানলাম, এবার জানবো সেগুলোর উৎস অর্থাৎ কোন কোন জায়গা থেকে কি কি বর্জ্য বা আবর্জনা পাওয়া যায়।

• গৃহস্থালির বর্জ্য

বাড়ি থেকে সাধারণত পচনশীল ও অপচনশীল কঠিন বা প্রায় কঠিন বর্জ্য পদার্থ আসে। যেমন –
ক) প্রতিদিনের শাকসবজি, মাছ, মাংস, ফলমূল ইত্যাদির উচ্ছিষ্ট, খোসা, খাদ্যের অব্যবহৃত অংশ, ভাঙা কাপ প্লেট, বোতল, ছেঁড়া কাপড়, ভাঙা আসবাবপত্র, কাগজের টুকরো, খালি প্যাকেট, পলিথিন ইত্যাদি।
খ) প্রায় কঠিন বর্জ্য হিসেবে মানুষের মলমূত্রের মিশ্রণ।
গ) ব্যবহৃত যে-কোনো যন্ত্রের নষ্ট হয়ে যাওয়া অংশ।

স্তূপীকৃত গৃহস্থালি বর্জ্য

• শিল্প বর্জ্য

শিল্প বর্জ্য তরল, গ্যাসীয়, কঠিন, বিপজ্জনক বা বিষক্রিয়াযুক্ত হতে পারে। এগুলি নির্ভর করে শিল্পের প্রকৃতির ওপর। যেমন – ট্যানারি, রাসায়নিক কারখানা থেকে তরল কাদার মত বর্জ্য পদার্থ নির্গত হয়। ভারী বৃহদায়তন শিল্প কারখানা থেকে পিচ্ছিলকারক বর্জ্য নির্গত হয়। কঠিন বর্জ্য হিসেবে ধাতুর উনশ, ছাই, স্যান্ডপেপার, কাগজের প্যাকেট ইত্যাদি নির্গত হয়। এছাড়া রাসায়নিক দ্রাবক, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, রঙ ইত্যাদি কঠিন বর্জ্য পাওয়া যায়। কলকারখানা থেকে নির্গত গ্যাসও একধরনের বর্জ্য।


• কৃষিজ বর্জ্য

কৃষিজ বর্জ্যের অধিকাংশই পচনশীল ও জৈব। ধানের তুষ, ছিবড়ে, গোবর, আখের ছিবড়ে। এছাড়া রাসায়নিক সার, কীটনাশক, গাছের অবশিষ্ট অংশ ইত্যাদি।

• চিকিৎসা সংক্রান্ত বর্জ্য

হাসপাতাল এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হওয়ার পর যেসব দ্রব্য ফেলে দেওয়া হয়, সেগুলি চিকিৎসা সংক্রান্ত বর্জ্য। এই বর্জ্য আবার দুই প্রকারের হয়, যথা – সংক্রামক এবং অসংক্রামক। ছুঁচ, সিরিঞ্জ, গজ, ব্যান্ডেজ, ব্যবহৃত মাস্ক ও গ্লাভস, বর্জিত ওষুধ, অপারেশনজনিত জিনিস প্রভৃতি সংক্রামক বর্জ্য পদার্থের মধ্যে পড়ে। অপরদিকে ওষুধের ফয়েল, শিশি, থালা, প্লাস্টিকের গ্লাস, বাটি এগুলো অসংক্রামক বর্জ্য হিসেবে পরিচিত।



• পুরসভার বর্জ্য

পৌরসভা শহরের গৃহস্থালি, হাসপাতাল বা বিদ্যালয় থেকে যেসব বর্জ্য সংগ্রহ করে থাকে, সেগুলিকে পুরসভার বর্জ্য বলে।

বর্জ্য সংরক্ষণ ও পরিছন্নতার সুবিধের জন্যে এগুলিকে বেশ কিছু ভাগে ভাগ করা যায়, যথা – জীববিশ্লেষ্য বর্জ্য, এটি মূলত খাদ্য ও পানীয়ের বর্জ্য, গাছপালার অংশ কাগজ ইত্যাদি। পুনঃচক্রি বর্জ্য, এই মূলত কাগজ, কাঁচ, বোতল, নির্দিষ্ট কিছু প্লাস্টিক, ব্যাটারি, যন্ত্রাংশ, ধাতু ইত্যাদি। বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিন বর্জ্য, টিভি, কম্পিউটার, লাইট, ইলেকট্রিক তার ইত্যাদি। বিষাক্ত বর্জ্য, এগুলি মূলত রঙ, রাসায়নিক দ্রব্য, সার, স্প্রে ক্যান, কেমিক্যাল মিশ্রণ ইত্যাদি। মিশ্র বর্জ্য গুলি হল, কাপড়, প্লাস্টিকের খেলনা, পরিত্যক্ত বাক্স ইত্যাদি।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

• তেজস্ক্রিয় বর্জ্য

পারমাণবিক জ্বালানি, পারমাণবিক বোমা তৈরির সময় ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম প্রভৃতি বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় খনিজ পদার্থ থেকে নির্গত হয় গ্যাসীয় বা কঠিন বর্জ্য। এই ধরণের তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থগুলির প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী। তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা অনুযায়ী এই বর্জ্যগুলি তরল থেকে কঠিন আকারের হয়। কঠিন তেজস্ক্রিয় বর্জ্যগুলিতে মৌল থাকে জেগুলির বিকিরণ পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর। অনেকসময় তরল তেজস্ক্রিয় বর্জ্যগুলি পারমাণবিক কারখানা লাগোয়া জলের উৎসে মিশে গিয়ে বিকিরণ ঘটিয়ে থাকে।

• জৈব ও অজৈব বর্জ্য

যে-কোনো ধরণের গাছপালা অংশ, পশুপাখির মৃতদেহ, জৈবসার এগুলিকে জৈব বর্জ্য বলা হয়। অপরদিকে প্লাস্টিক দ্রব্য, ধাতু যন্ত্রাংশ এগুলি অজৈব বর্জ্যের তালিকাভুক্ত।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

পরিবেশের ওপর বর্জ্যের প্রভাব

বর্জ্য পদার্থের সঞ্চয় এবং সঠিকভাবে পরিছন্নতার অভাবে পরিবেশের ওপর প্রভাব পড়ে। বিভিন্ন ধরণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবগুলি হল –
• হাসপাতালের সংক্রামক বর্জ্যের ফলে কৃমি, টিটেনাস, টাইফয়েড, ইত্যাদি জলবাহিত ও বায়ুবাহিত রোগের সৃষ্টি হয়।
• কলকারখানা, হাসপাতাল থেকে নির্গত বর্জ্য জলে মিশে জলবাহিত বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে। এই দূষিত জল ভৌমজল স্তরে পৌঁছে গিয়ে সেই জলও দূষিত করে তোলে ফলে পানীয় জলের সমস্যা দেখা দেয়।

মেডিকেল বর্জ্য

• বর্জ্য পদার্থ পচনের ফলে বাতাসে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়। এছাড়া ক্ষতিকর ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয় এই পচনের ফলে, যা থেকে বাহুবাহিত রোগ সৃষ্টি হয়।
• কৃষি জমিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক জমির উর্বরতা হ্রাস করে দেয়। কলকারখানা থেকে নির্গত ধাতব বর্জ্য (আর্সেনিক) এবং প্লাস্টিক মাটিতে মিশে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
শহরাঞ্চলে হাইড্রেনগুলির মুখে বর্জ্য বিশেষ করে প্লাস্টিক জমা হয়ে জলনিকাশি ব্যবস্থায় সমস্যার সৃষ্টি করে।
• বর্জ্য ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টগুলি থেকে নির্গত তাপ এবং দুর্গন্ধ আশপাশের পরিবেশকে দূষিত করে তোলে। এছাড়া নির্গত ছাই অনেকসময় মাটির উর্বরতা নষ্ট করে দেয়।

সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও ভাগীরথী হুগলী নদীর উপর বর্জ্যের প্রভাব


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X-geo-4-a