insolation
Madhyamik

ইনসোলেশনের ধারণা

ভূগোলদশম শ্রেণি – বায়ুমণ্ডল (তৃতীয় পর্ব)

আগের পর্বে আমরা বায়ুমণ্ডলের স্তরবিন্যাস সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজকের পর্বে আমরা ইনসোলেশনের ধারণা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

সূর্যের পৃষ্ঠতলের উষ্ণতা হল 6000°C। সূর্যের আলোক বলয় থেকে নির্গত শক্তি প্রবল বেগে তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ রূপে পৃথিবীতে পৌঁছায়, একেই ইনসোলেশন বলে।

এই তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের গতি হল সেকেন্ডে 297000 কিলোমিটার বা 186000 মাইল। এই আলোক শক্তি তাপ শক্তিতে রূপান্তরিত হয় এই কারণে একে সূর্য রশ্মির তাপীয় ফল বলা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সৌর বিকিরণের 200 কোটি ভাগের মাত্র এক ভাগ পৃথিবীতে এসে পৌঁছায়।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

ইনসোলেশন যে সকল নিয়ন্ত্রক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় সেগুলি হল সূর্যালোকের স্থায়িত্ব, দিনের দৈর্ঘ্য, সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে দূরত্ব, সূর্যের উন্নতি কোণের পরিমাণ, সৌর কলঙ্ক ও বায়ুমন্ডলের স্বচ্ছতা।

তাপের সমতা

পৃথিবীতে প্রতিদিন সৌরতাপ এসে পৌঁছায় কিন্তু তাতেও পৃথিবীর গড় উষ্ণতা সামগ্রিকভাবে বৃদ্ধি পায় না, তাই সমান থাকে। এইভাবে তাপের সমতা বজায় থাকে। পৃথিবীতে প্রত্যেকদিন যে পরিমাণ সৌর বিকিরণ ক্ষুদ্র তরঙ্গ রূপে পৃথিবী পৃষ্ঠ ও বায়ুমন্ডলে পৌঁছায় তারা বেশির ভাগটাই দীর্ঘ তরঙ্গ রূপে পুনঃবিকিরণ ঘটে মহাশূন্যে ফিরে যায়। এই অকার্যকর পুনর্বিকিরিত সৌরতাপকে অ্যালবেডো বলে।  অ্যালবেডো বরফ পৃষ্ঠে সর্বাধিক (70-90%) এবং মাটি ও উদ্ভিদের উপর সর্বনিম্ন হয়।

সূর্যরশ্মির ক্রমাগত পৃথিবীতে আগমন হলেও পৃথিবীর উষ্ণতা ক্রমযৌগিক হারে বাড়ে না। প্রত্যেকদিন আগত সৌর রশ্মির 35% অ্যালবেডো রূপে মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যায়। অ্যালবেডো বাদে বাকি 65% শতাংশ সৌর বিকিরণ দিনের বেলা বায়ুমণ্ডল ভূপৃষ্ঠ উত্তপ্ত করে তোলে।

এই 65% সৌর বিকিরণকে কার্যকরী সৌর বিকিরণ বলা হয়। কার্যকরী বিকিরণের মধ্যে অধিকাংশ অংশ রাতের বেলা বৃহৎ তরঙ্গ রূপে মহাশূন্যে ফিরে যায় ও তাপের সমতা বজায় রাখে। এই কার্যকরী সৌর শক্তির 65% এর মধ্যে 14% জলীয় বাষ্প গ্যাস ধূলিকণার দ্বারা বায়ুমণ্ডল শোষণ করে। 51% এর মধ্যে 34% সরাসরি ভূপৃষ্ঠে এসে পড়ে এবং 17% বিচ্ছুরিত রশ্মি গ্রহণ করে পৃথিবী পৃষ্ঠ গরম হয়ে ওঠে। এই 51% শক্তি পুনরায় মহাশূন্যে হয়ে বিলীন হয়ে যায়। যার মধ্যে 19% বাষ্পীভবনের ফলে, 9% বায়ুর পরিচলন স্রোতের ফলে এবং বাকি 30% বৃহত্তর মহাশূন্যে ফিরে গিয়ে পৃথিবীর তাপের সমতা বজায় রাখে।

সুতরাং তাপের সমতা = কার্যকরী সৌর বিকিরণ – পুনঃবিকিরিত শক্তি

বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হওয়ার পদ্ধতি

বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বায়ুমণ্ডল উত্তপ্ত হয়, সেগুলো নিচে আলোচনা করা হল,

A. বিকিরণ

কোনো মাধ্যম ছাড়াই যখন তাপমাত্রা এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে পরিবাহিত হয়, তাকে বিকিরণ বলা হয়। উত্তপ্ত ভূপৃষ্ঠ থেকে দীর্ঘ তরঙ্গ রূপে তাপ বায়ুমণ্ডলকে এই পদ্ধতির মাধ্যমে উত্তপ্ত করে থাকে। মেঘমুক্ত পরিষ্কার আকাশের তারা বিকিরণ দ্রুত গতিতে সম্পন্ন হয়।

বিকিরণ পদ্ধতিতে সূর্য থেকে পৃথিবীতে তাপ সঞ্চারিত হয়

B. পরিবহন

এই পদ্ধতিতে পদার্থের উষ্ণতর অংশ থেকে শীতলতর অংশে তাপ প্রবাহিত হয় কিন্তু পদার্থের অণুগুলোর কোনো স্থান পরিবর্তন হয় না, একেই পরিবহন বলা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন স্তর থেকে উপরের বায়ুস্তর তাপ পরিবাহিত হয়। পরিবহন প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়ে থাকে।

পরিবহন প্রক্রিয়ায় তাপ সঞ্চারিত হয় কঠিন পদার্থে

C. পরিচলন

উপর থেকে নিচে শীতল বায়ু ও নিচ থেকে উপরে উষ্ণ বায়ুর একইসঙ্গে চক্রাকার আবর্তনের ফলে যে সঞ্চালন প্রক্রিয়া সৃষ্টি হয়, তাকে পরিচালন বলা হয়। এই প্রক্রিয়া নিরক্ষীয় অঞ্চলে বেশি দেখা যায়।

পরিচলন পদ্ধতিতে তরল পদার্থ উত্তপ্ত হয়

D. অ্যাডভেকশন

ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে বায়ু প্রবাহের ফলে উষ্ণ অঞ্চল থেকে শীতল অঞ্চলে তাপের প্রবাহকে অ্যাডভেকশন বলা হয়। গ্রীষ্মকালীন তাপপ্রবাহ যেমন ‘ লু ‘ এর ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটে।

E. তাপীয় শোষণ

বায়ুমণ্ডল অবস্থিত ধূলিকণা জলীয়বাষ্প কার্বন-ডাই-অক্সাইড সূর্য রশ্মিকে সরাসরি গ্রহণ করতে পারে। একে তাপীয় শোষণ বলা হয়। এই প্রক্রিয়ায় বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

F. অন্যান্য পদ্ধতি

এই সকল পদ্ধতি ছাড়াও পদার্থের তেজস্ক্রিয়তার ফলে সৃষ্ট তাপ, আগ্নেয়গিরি, প্রস্রবণ, লীন তাপ সংযোজন ইত্যাদি স্থানীয়ভাবে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বাড়াতে সক্ষম হয়।

তাপের পরিমাপ

বায়ুর উষ্ণতা মাপক যন্ত্রের নাম হল থার্মোমিটার। 1782 সালে জেমস সিক্স থার্মোমিটার আবিষ্কার করেন। বিশেষভাবে তৈরি থার্মোমিটারের মাধ্যমে দিনের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন উষ্ণতা মাপা সম্ভব হয় যা গরিষ্ঠ ও লঘিষ্ঠ থার্মোমিটার নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে উষ্ণতা সেন্টিগ্রেড ও ফারেনহাইট স্কেলে মাপা যায়।

থার্মোমিটার

উষ্ণতা পরিমাপ সমূহ

উষ্ণতা হল আবহাওয়া ও জলবায়ুর অন্যতম মূল উপাদান। কোনো স্থানের আবহাওয়া ও জলবায়ু সম্পর্কে সম্যক ধারণা করার জন্য উষ্ণতাকে চার ভাগে বিবেচনা করা হয়। সেগুলি হল সর্বোচ্চ উষ্ণতা, সর্বনিম্ন উষ্ণতা, গড় উষ্ণতা ও উষ্ণতার প্রসর। উষ্ণতার দৈনিক চরিত্র জানতেও এই পরিমাপগুলিকে ব্যবহার করা হয়।

সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা

দিনের উষ্ণতা বাড়তে বাড়তে যে মানের পর থেকে সেটা আবার কমতে শুরু করে অর্থাৎ যে মানের পর আর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় না সেই মানটি হল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। একই ভাবে যে মানের পর উষ্ণতা কমতে কমতে তারপর আবার বাড়তে শুরু করে অর্থাৎ যার পর থেকে তাপমাত্রা হ্রাস পায় না সেই মানটি হল সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। দিন মাস বছরের সাপেক্ষে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা পরিমাপ করা হয়।

দৈনিক গড় তাপমাত্রা

একটি দিনের গড় তাপমাত্রা বলতে বোঝায় সেই দিনের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার গড় মান।
দৈনিক গড় তাপমাত্রা = (কোনো দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা + ওই দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা) ÷ 2

মাসিক গড় তাপমাত্রা

কোনো মাসের প্রতিদিনের গড় তাপমাত্রা কে যোগ করে সে যোগফলকে মাসের দিন সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে যে মান পাওয়া যায় তাকেই মাসিক গড় তাপমাত্রা বলা হয়।

অর্থাৎ, মাসিক গড় তাপমাত্রা = দৈনিক গড় তাপমাত্রার সমষ্টি ÷ মাসের দিন সংখ্যা

বার্ষিক গড় তাপমাত্রা

কোনো বছরের প্রত্যেক মাসের গড় তাপমাত্রার সমষ্টিকে 12 দিয়ে ভাগ করলে যে তাপমাত্রা পাওয়া যায় তাকে বার্ষিক গড় তাপমাত্রা বলা হয়।

সুতরাং, বার্ষিক গড় তাপমাত্রা= 12 মাসের গড় তাপমাত্রার সমষ্টি ÷ 12
নিচের সারণি থেকে খুব সহজেই এই মানগুলি নির্ণয় করা যায়।

সরণির মান অনুযায়ী বার্ষিক গড় তাপমাত্রা হল = 323.2°C ÷ 12 = 26.9°C
বার্ষিক উষ্ণতার প্রসর = 35.6°C – 17.9°C = 17.7°C

তাপমাত্রার প্রসর

সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্যকে তাপমাত্রার প্রসর বলা হয়। কোন দিনে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য কে সেই দিনের দৈনিক উষ্ণতার প্রসর বলে। একইভাবে কোনো মাসের মাসিক সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্যকে সেই মাসের মাসিক উষ্ণতার প্রসর বলা হয়।

বছরের মধ্যে উষ্ণতম ও শীতলতম মাসের মধ্যে গড় তাপমাত্রা পার্থক্যকে বার্ষিক তাপমাত্রার প্রসর বলা হয়।

বৈশিষ্ট্য: পৃথিবীতে তাপমাত্রার প্রসার নিরক্ষীয় অঞ্চলে সবথেকে কম উচ্চ অক্ষাংশে সবথেকে বেশি হয়। আবার একই অক্ষাংশে অবস্থিত মহাদেশের উপর উষ্ণতার প্রসর বেশি মহাসাগরের উপর উষ্ণতার প্রসর কম হয়।
গুরুত্ব: তাপমাত্রার প্রসর নির্ণয়ের গুরুত্ব অপরিসীম কারণ জীবজগতের উপর তাপ সংক্রান্ত স্বস্তিবা অস্বস্তির মাত্রা, এর দ্বারা বোঝা সম্ভব হয়।

পরবর্তী পর্ব → বায়ুমণ্ডলে উষ্ণতার তারতম্য


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।



Join JUMP Magazine Telegram


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।

JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X-geo-2-c