ghonibhobon-odhokkhepon
Madhyamik

ঘনীভবন ও অধঃক্ষেপণ

ভূগোলদশম শ্রেণি – বায়ুমণ্ডল (দ্বাদশ পর্ব)

আগের পর্বে আমরা জলচক্রের ধারণা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজকের পর্বে আমরা ঘনীভবন ও অধঃক্ষেপণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

যে প্রক্রিয়ায় জলীয় বাষ্প গ্যাসীয় অবস্থা থেকে তরলে, আবার তরল থেকে কঠিন অবস্থায় পরিণত হয়, তাকে ঘনীভবন বলা হয়।

ঘনীভবন প্রক্রিয়া

বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা এবং বায়ু শীতলীভবনের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। বাতাস যখন শিশিরাঙ্কের কাছাকাছি পৌঁছে যায়, তখন ঘনীভবন সৃষ্টি হয়।
ঘনীভবনের বিভিন্ন রূপ জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়, তখন বিভিন্ন রূপ ধারণ করে।
যেমন –

• শিশির

সম্পৃক্ত বায়ুর যখন অতিরিক্ত শীতলীভবনের শিশিরাঙ্কের কাছে পৌঁছে যায়, তখন জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে ছোট ছোট ক্ষুদ্র কণার আকারে গাছের পাতা ও ঘাসের উপর জলবিন্দুর আকারে জমা হয়, একই শিশির বলা হয়। এই শিশির যখন আরো ঠান্ডা জমে বরফে পরিণত হয়, তখন তা তুহিন নামে পরিচিত হয়।

• কুয়াশা

জলীয়বাষ্প যখন ঘনীভূত হয়ে অতি ক্ষুদ্র জলকণা রূপে ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি ধূলিকণা, কার্বন কণা ও লবণকে আশ্রয় করে বাতাসে একস্থান থেকে অন্যস্থানে ভেসে বেড়ায়, তখন তাকে কুয়াশা বলা হয়। শান্ত বায়ুস্তর এবং শীতল আবহাওয়া কুয়াশা তৈরির জন্য উপযুক্ত।

• ধোঁয়াশা

ধোঁয়াশা হল ধোয়া এবং কুয়াশার সংমিশ্রণ। শীতকালে যখন ভূপৃষ্ঠ খুব তাড়াতাড়ি তাপ বিকিরণ করে শীতল হয়ে পড়ে, তখন ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ু শীতল ও ভারী হয়ে উপরের দিকে আর উঠতে পারে না। এই শীতল বায়ু যানবাহন ও কলকারখানা থেকে নির্গত হওয়া ধোঁয়া এবং ধূলিকণার সাথে মিশে বায়ুতে ভাসতে থাকে, একে ধোঁয়াশা বলা হয়।

• মেঘ

ঘনীভবনের ফলে উৎপন্ন জল বিন্দু কনার বিশাল পুঞ্জ যখন বায়ুমণ্ডলের উর্দু স্টরে ভেসে বেড়ায়, তখন তাকে বলা হয়। মূলত জলীয় বাষ্পপূর্ণ আর্দ্র বায়ু যখন হালকা হয়ে উপরের দিকে প্রসারিত হয়, তখন বায়ুমণ্ডলের শীতলতার কারণে তা সহজেই শিশিরাঙ্কের পৌঁছে যায়। এই অবস্থায় বায়ু মধ্যস্থ জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয় এবং জল বিন্দু বা তুহিন কণায় পরিণত হয়ে মেঘের সৃষ্টি করে।

• মেঘাচ্ছন্নতা

আকাশ যখন মেঘ আবৃত থাকে, তখন তাকে মেঘাচ্ছন্নতা বলা হয়। মেঘাচ্ছন্নতার পরিমাপ সাধারণত অক্ষাংশে পরিমাপ করা হয়। যেখানে আকাশকে আটটি ভাগ করে তার সাপেক্ষে মেঘাছন্নতা পরিমাপ করা হয়। আবহাওয়া মানচিত্রে অক্ষাংশের মাধ্যমেই কোনো স্থানের মেঘাচ্ছন্নতা বোঝানো হয় করা হয়।

অধঃক্ষেপণ

বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্প যখন ঘনীভূত হয়ে তরল এবং কঠিন অবস্থায় পরিণত হওয়ার পর মধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে ভূপৃষ্ঠে নেমে আসলে, তখন তাকে অধঃক্ষেপণ বলা হয়।

অধঃক্ষেপণের বিভিন্ন রূপগুলি হল বৃষ্টিপাত, তুষারপাত, শিলাবৃষ্টি ঝিরঝির বৃষ্টি ইত্যাদি।

অধঃক্ষেপণের প্রক্রিয়া

বাতাস যখন হয় তখন তার আপেক্ষিক আর্দ্রতা বেড়ে যায়। তবে ধূলিকণা এবং সমধর্মী কণার দ্রবণ প্রভাবের জন্য আপেক্ষিক আর্দ্রতা 100% পৌঁছানোর আগেই এই এদের আশ্রয় করে জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে জল কণায় পরিণত হতে শুরু করে এবং একে সাথে যুক্ত হয়ে আরো বড় বড় জলকণায় রূপান্তরিত হতে থাকে। মেঘের মধ্যে অবস্থানকারী এই ভারী জল বিন্দু যখন অনেক বড় হয়ে যায় তা তখন আর ভেসে থাকতে না পেরে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে ভূপৃষ্ঠে নেমে আসে, একেই অধঃক্ষেপণ বলা হয়।

অধঃক্ষেপণের বিভিন্ন রূপ

অধঃক্ষেপণের বিভিন্ন রূপগুলো সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হল।

• বৃষ্টিপাত

জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে যখন কমপক্ষে 0.5 মিলিমিটার যুক্ত জলবিন্দু ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়, তখন তাকে বৃষ্টিপাত বলা হয়।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

• ঝিরঝির বৃষ্টি বা গুড়ি বৃষ্টি

জলীয়বাষ্প ঘনীভূত হয়ে 0.5 মিলিমিটারের কম ব্যাস যুক্ত জলকণা রূপে ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়, তখন তাকে ঝিরিঝিরে বৃষ্টি বা গুড়ি বৃষ্টি বলা হয়।

• তুষারপাত

জলকণা ঘনীভূত হয়ে যখন পেঁজা তুলোর মত নরম বা সূক্ষ্ম বরফ কণা আকারে ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়, তখন তাকে তুষারপাত বলা হয়।

• স্লিট

বৃষ্টির ফোঁটা অতি শীতল বায়ুস্তর ভেদ করে আসার সময় জমাট বেঁধে বরফ কণার আকারে ভূপৃষ্ঠে পতিত হলে, তখন তাকে স্লিট বলা হয়।

• শিলাবৃষ্টি

জলকণার অধিক শীতলীকরণের ফলে যখন তা কঠিন বরফের টুকরো পরিণত হয় এবং বৃষ্টির সাথে ঝরে পড়ে, তখন তাকে শিলাবৃষ্টি বলা হয়। কালবৈশাখী ঝড়ের সময় কিউমুলোনিম্বাস মেঘ থেকে এই বৃষ্টির সৃষ্টি হয়।

কিউমুলোনিম্বাস মেঘ

বৃষ্টিপাতের শ্রেণীবিভাগ: বৃষ্টিপাতকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা –
• পরিচলন বৃষ্টিপাত
• শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত এবং
• ঘূর্ণবাত বা সীমান্ত বৃষ্টিপাত

পরিচলন বৃষ্টিপাত

সূর্যের তাপে ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন উষ্ণ ও আর্দ্র বাতাসে উপরের দিকে উঠে যখন শীতল ও ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টিপাত ঘটায়, তখন তাকে পরিচলন বৃষ্টিপাত বলে।

পরিচলন বৃষ্টিপাতের প্রক্রিয়া

নিরক্ষীয় অঞ্চলে দিনের বেলা প্রবল সূর্যতাপে ভূপৃষ্ঠ এবং সংলগ্ন জলভাগ থেকে জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু উষ্ণ এবং হালকা হয়ে উপরে উঠে যায় এবং লীনতাপ ত্যাগ করে শীতল ঘনীভূত হয়। জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু দ্রুত উত্থান ঘটে বজ্রগর্ভ কিউমুলোনিম্বাস মেঘ সৃষ্টি করে। এই মেঘ থেকে বজ্রবিদ্যুৎ সহ প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। নিরক্ষীয় অঞ্চলে প্রতিদিন বিকেল বেলা 3 টা থেকে 4টের মধ্যে বৃষ্টিপাত হওয়ার জন্য একে Four o’Clock Rain ও বলা হয়। নিরক্ষীয় অঞ্চলে প্রতিদিন দুপুরে এবং মধ্য অক্ষাংশীয় অঞ্চলে গ্রীষ্মকালের শুরুতে এই বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে।

পরিচলন বৃষ্টিপাত

শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত

জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু ভূপৃষ্ঠের উপর থেকে প্রবাহিত হওয়ার সময়ে কোন উচ্চ মালভূমি বা পর্বত গাত্রে ধাক্কা খেয়ে ঢাল বরাবর উপরের দিকে উঠে যায় এবং ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টিপাত ঘটায়, একে শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত বলা হয়।
প্রক্রিয়া জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু পরবর্তী প্রতিবাত ঢালে ধাক্কা খেয়ে ঊর্ধ্বগামী হয় এবং সেই উর্ধ্বগামী বায়ু ঘনীভূত হয়ে প্রতিবাত ঢালে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। কিন্তু সেই জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু প্রতিবাত ঢাল অতিক্রম করে যখন অনুবাত ঢাল এর দিকে অগ্রসর হয় তখন সেই বায়ুতে আর জলীয় বাষ্প থাকে না ফলে এই ঢালে বৃষ্টিপাত কম হয়।এই অঞ্চলকে বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল বলা হয়।
উদাহরণ – পশ্চিমঘাট পর্বতমালার পশ্চিম ঢালে মৌসুমী বায়ুর আরব সাগরীয় শাখা এবং হিমালয় পর্বতের দক্ষিণ ঢালে মৌসুমী বায়ুর বঙ্গোপসাগরীয় শাখা এই ধরনের বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে থাকে। কিন্তু সেই অনুপাতে পশ্চিমঘাট পর্বতের পূর্ব ঢালে এবং শিলং মালভূমিতে বৃষ্টিপাত হয় না কারণ এই অঞ্চল দুটি বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলের মধ্যে পড়ে।

ঘূর্ণবাত বা সীমান্ত বৃষ্টিপাত

ঘূর্ণবাতের প্রভাবে যে বৃষ্টিপাত হয়, তাকে ঘূর্ণবাত বৃষ্টিপাত বলে। ঘূর্ণ বৃষ্টিপাতকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।

ক্রান্তীয় ঘূর্ণবৃষ্টি:

ক্রান্তীয় অঞ্চলে গভীর নিম্নচাপ সৃষ্টি হলে আশে পাশের অঞ্চল থেকে জলীয় বাষ্পপূর্ণ বাতাস প্রবল বেগে ছুটে আসে এবং ঊর্ধ্বগামী হয়। এই উষ্ণ ও আর্দ্র বাতাস ঊর্ধ্বগামী ও ঘনীভূত হয়ে বিশাল এলাকাজুড়ে বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিপাত সৃষ্টি করে। উদাহরণ – জুলাই থেকে অক্টোবর মাসে বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে মাঝে মাঝে ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের ফলে প্রবল বর্ষণ হয়।

নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবৃষ্টি

মধ্য অক্ষাংশীয় উষ্ণ এবং শীতল বায়ু সংঘর্ষে ঘূর্ণবাতের সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে ঘূর্ণবাত জনিত বৃষ্টিপাতের উৎপত্তি হয়। এ ধরণের ঘূর্ণবাত বৃষ্টিপাত সীমান্ত সৃষ্টির মাধ্যমে ঘটে থাকে বলে, সীমান্ত বৃষ্টিও বলা হয়। উদাহরণ – শীতকালে উত্তর ভারতে সৃষ্টি পশ্চিমী ঝঞ্ঝা হল নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবৃষ্টির উদাহরণ।

শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত

বৃষ্টিপাতের পরিমাপ

বৃষ্টিপাত পরিমাপক যন্ত্রের নাম হল রেন গজ (Rain gauge)। এই যন্ত্রে 5 ইঞ্চি ব্যাস যুক্ত তামার চোঙার মুখে একই মাপের একটি ফানেল বসানো থাকে এবং চোঙার মধ্যে একটি কাঁচের বোতল থাকে। এই ফানেলের মধ্যে দিয়ে বৃষ্টির জল চোখের ভিতর রাখা বোতলের মধ্যে জমা হয়। এরপর বৃষ্টিপাত পরিমাপক দাগ কাটা একটি কাঁচপাত্রের সাহায্যে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ পরিমাপ করা হয়। রেন গজে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ মিলিমিটারে প্রকাশ করা হয় এছাড়া কখনো কখনো ইঞ্চি এবং সেন্টিমিটারেও প্রকাশিত হয়।

রেন গজ

সমবর্ষণ রেখা

সমান বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চলগুলিকে যে কাল্পনিক রেখা দ্বারা যুক্ত করা হয়, তাকে সমবর্ষণ রেখা (Isohyet) বলা হয়। ‘Iso’ শব্দের অর্থ শব্দের অর্থ হল সমান ও ‘Hyet’ কথার অর্থ বৃষ্টিপাত।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → পৃথিবীর মুখ্য জলবায়ু অঞ্চল


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X-geo-2-l