varotiyo-krishi-sobuj-biplob
Madhyamik

ভারতীয় কৃষি ও সবুজ বিপ্লব

ভূগোলদশম শ্রেণি – ভারতের অর্থনৈতিক পরিবেশ (চতুর্থ পর্ব)

আগের পর্বে আমরা অর্থকরী ফসল [চা, কার্পাস ও কফি] সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজকের পর্বে আমরা ভারতীয় কৃষি ও সবুজ বিপ্লব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

ভারতে কৃষিকাজের ইতিহাস সুপ্রাচীন। অনুমান করা হয় যে, প্রায় দশ হাজার বছর আগে ভারতে কৃষিকাজের সূচনা হয়। ইতিহাসের তথ্য থেকে জানা যায় যে, বৃক্ষরোপণ, শস্য উৎপাদন, পশুপালন ইত্যাদি ছিল কৃষিকাজের মূল উৎস। প্রাচীনকাল থেকেই গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, সিন্ধু নদী অববাহিকার পলিমাটিতে আদর্শ কৃষিক্ষেত্র গড়ে ওঠে। অনুকূল মৌসুমি জলবায়ু থাকায় ভারত একটি কৃষিপ্রধান দেশে পরিণত হয়েছে।

ভারতবর্ষে স্বাধীনতার পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে খাদ্যের অভাবে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ১৯৬৪ এবং ১৯৬৬ সালে পরপর প্রবল খরার প্রকোপে ভারতে খাদ্যের অভাব প্রকট হয়ে পড়ে। যার প্রধান কারণ ছিল পুরনো পদ্ধতিতে হওয়া কৃষিকাজ। তার ফলে উৎপন্ন ফসল ছিল খুব কম, যা বিপুল জনসংখ্যার চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম ছিল না। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়েও খাদ্যের চাহিদা মেটাতে সরকারকে খাদ্যের একটা বড় অংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হত।

ভারতীয় কৃষি ও সবুজ বিপ্লব সম্পর্কে দেখে নাও এই ভিডিও থেকে↓

সবুজ বিপ্লব

ভারতীয় কৃষিকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ১৯৬০-৬১ সালে কৃষি উন্নয়নের নিবিড় কার্যক্রম প্রবর্তন করা হয়েছিল। দেশীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির ও কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দেয়। এই কার্যক্রমের মূল উপাদান হল – উন্নত ধরণের বীজের ব্যবহার, জলসেচের নিয়মিত ব্যবস্থা, আধুনিক রাসায়নিক সার, কীটনাশক ওষুধের ব্যবহার, ও আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার। এই ব্যবস্থাকেই নতুন কৃষি কৌশল হিসেবে গণ্য করা হয়।

১৯৬০ এর দশকে ভারতে এই নতুন কৃষি কৌশল প্রবর্তনের ফলে দানা জাতীয় খাদ্যশস্যের উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতির উত্তোলন পর্ব শুরু হয়। ভারতীয় কৃষির এই দ্রুত পরিবর্তনকে সবুজ বিপ্লব নামে অভিহিত করা হয়।

সবুজ বিপ্লব রূপায়ণে গৃহীত প্রধান পদক্ষেপগুলি হল

• উচ্চ ফলনশীল বীজের ব্যবহার
• জলসেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ
• রাসায়নিক ও কীটনাশকের পর্যাপ্ত ব্যবহার
• আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার

এছাড়াও যেসব অপ্রধান পদক্ষেপগুলি সবুজ বিপ্লবের সাথে জড়িত, সেগুলি হল –
• ভূমি সংস্কারের সম্প্রসারণ
• পাট্টা ও তহবিল প্রদান
• ঋণ প্রদান
• গ্রামীণ বৈদ্যুতিক সংস্করণ
• কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণার সম্প্রসারণ ইত্যাদি।

ডঃ নরম্যান ই. বোরলগ হলেন সবুজ বিপ্লবের প্রণেতা এবং উচ্চফলনশীল বীজের আবিষ্কারক।

ভারতে সবুজ বিপ্লবের সূচনা করেন কৃষিবিজ্ঞানী এম. এস. স্বামীনাথন। ভারতে চিরাচরিত প্রাচীন কৃষি পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসে সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে। এর ফলে কৃষিক্ষেত্রে বাণিজ্যিকভাবে ফসল উৎপাদন শুরু হয়। ভারতে সবুজ বিপ্লবের প্রভাব সবার প্রথমে গম চাষের ক্ষেত্রে দেখা দেয়। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ এই তিনটি রাজ্যে গম উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে গমের উৎপাদন বৃদ্ধি করা হয়।

পরবর্তী সময়ে ধানের উৎপাদনেও সবুজ বিপ্লবের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

গমের ক্ষেত্রে কল্যানসোনা, সোনারা-644, লারমা রোজো-644 এবং ধানের ক্ষেত্রে আই আর-8, জয়া, পদ্মা প্রভৃতি উচ্চ ফলনশীল বীজ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।

গম চাষ

নতুন কৃষি কৌশলের উপাদান ও বৈশিষ্ট্য

১) উচ্চ ফলনশীল বীজের ব্যবহার

কৃষি বিভাগের নানা গবেষণার ফলে তৈরি উচ্চ ফলনশীল বীজের ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হয়। এই বীজগুলি থেকে খুব অল্প সময়েই অনেক বেশি ফসল উৎপন্ন হয়।

২) রাসায়নিক সারের ব্যবহার

উচ্চ ফলনশীল বীজ ব্যবহারের জন্য প্রচুর রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয়। কৃষিজমির উর্বরতা বজায় রাখার জন্য এবং দ্রুত উৎপাদনের জন্যে ভারত সরকার উন্নত রাসায়নিক সার ব্যবহারে উদ্যোগী হয়। ষাটের দশকে রাসায়নিক সারের ব্যবহার আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পায়।

৩) জলসেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন

নতুন ধরণের বীজের ক্ষেত্রে জলের সরবরাহ সবসময় প্রয়োজন হওয়ায়, জলসেচ ব্যবস্থার দিকে গুরুত্ব আরোপ করা শুরু হয়। বিভিন্ন ধরণের জলসেচ ব্যবস্থা চালু হওয়ায় কৃষকরা ফসল উৎপাদনে আরও অর্থ বিনিময়ে উদ্যোগী হয়। তাছাড়া জলসেচের সম্প্রসারন হওয়ায় ষাটের দশকের পর থেকে ভারতে কৃষিকাজে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভরতা বেশ কিছুতা কমেছে।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

৪) কীটনাশক ওষুধের ব্যবহার

আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতিতে উচ্চ ফলনশীল বীজ থেকে উৎপন্ন গাছকে রক্ষা করতে কীটনাশকের ব্যবহার জরুরি। তাই ভারতে যে সব অঞ্চলে সবুজ বিপ্লব শুরু হয় সেখানে ভারত সরকার উন্নত মানের কীটনাশক ওষুধের জোগান নিশ্চিত করে, যাতে উৎপাদন সঠিক মাত্রায় হতে পারে। এর ফলে ফসল নষ্ট হওয়ার পরিমাণও অনেক কমেছে।

৫) আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার

নতুন কৃষি পদ্ধতিতে যন্ত্রপাতি ব্যবহারের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ট্রাক্টর, টিউবওয়েল, পাম্পসেট, হারভেসটর প্রভৃতি যন্ত্র কৃষিকাজে বেশি পরিমাণে ব্যবহারে জোর দেওয়া হচ্ছে। এই আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্যে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ আরও বেশি হয়েছে।

৬) বহুফসলী চাষ

একই বছরে জমিতে একের বেশি ফসল চাষ করা সম্ভব হয়েছে নতুন কৃষি কৌশলের প্রয়োগের ফলে। একের বেশি ফসল চাষ হওয়ার ফলে, কৃষকেরাও উৎপাদনে উৎসাহ দেখিয়েছে।

৭) শস্য সংরক্ষণ ও বিক্রির সুযোগ

ফসল প্রক্রিয়াকরণ এবং বিক্রির জন্যে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, ফলে কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে ও বিক্রয়ের বাজারে শস্য পাঠানোয় কৃষকরা উদ্যোগী হয়েছে।

৮) ফসলের নির্ধারিত উপযুক্ত দাম

উৎপাদিত ফসলের দাম ভারত সরকার থেকে একটি নির্দিষ্ট স্তরে বেঁধে দেওয়ায় উৎপাদন অনেক অংশে বৃদ্ধি হয়েছে।

ভারতীয় কৃষিতে সবুজ বিপ্লবের সুফল

নতুন কৃষি কৌশল প্রবর্তনের ফলে ভারতীয় কৃষিতে উল্লেখযোগ্য কিছু সাফল্য এসেছে।

১) আধুনিক প্রযুক্তি ও উচ্চ ফলনশীল বীজের ব্যবহারের ফলে ফসলের উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়ছে। ধান ও গম উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সাফল্যের সূচনা হয়। ১৯৬০ সাল থেকে ২০১১ সাল অবধি গমের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ১.১ কোটি টন থেকে ৯.৫ কোটি টন বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে চাল উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে ৩.৪৬ টন থেকে ১৫.২৫ টন।

২) ফসল উৎপাদনে বৃদ্ধি হওয়ায় কৃষকদের আর্থিক অবস্থার কিছু উন্নতি হয়েছে।

৩) খাদ্যের সরবরাহ প্রচুর পরিমাণে বেড়েছে ষাটের দশক থেকে।

৪) নতুন কৃষি কৌশলের ফলে দেশের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি হওয়ায় ফসলের রপ্তানি ও বেড়েছে, সাথে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হয়েছে।

৫) নতুন কৃষি ব্যবস্থায় বহু ফসলের চাষ হওয়ায় সারাবছর ধরে শ্রমিকের চাহিদা বেড়েছে, ফলে গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থান বেড়েছে অনেকাংশেই।

৬) আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি শিল্পের সাথে সংযুক্ত। রাসায়নিক সার, কীটনাশক তৈরি, নানান যন্ত্রপাতি প্রভৃতির জন্যে মাঝারি শিল্প ও কারখানা গড়ে উঠেছে। সবুজ বিপ্লব কৃষি ও শিল্পের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেছে।

৭) গ্রামাঞ্চলে মূলধন নির্ভর কৃষিকাজের বিকাশ ঘটে সবুজ বিপ্লবের সময় থেকে। কৃষিকাজ পেশা হওয়ায় মূলধন প্রয়োগ করে উৎপাদনের বৃদ্ধি শুরু করার প্রয়াস ঘটে। ভারতীয় কৃষি অনেকাংশে আধুনিক কৃষিতে রুপান্তর হয়েছে সবুজ বিপ্লবের প্রভাবে।

ভারতীয় কৃষিতে সবুজ বিপ্লবের কুফল বা সীমাবদ্ধতা

ভারতের কৃষিক্ষেত্রে বেশ কিছু সাফল্য থাকা সত্ত্বেও সবুজ বিপ্লবের কিছু সীমাবদ্ধতা বা ব্যর্থতা রয়েছে।
১) সবুজ বিপ্লবের প্রভাব সমস্ত ফসলের ক্ষেত্রে সমানভাবে দেখা যায়নি। গম উৎপাদনে এটি ব্যপকভাবে সফলতা পায়, এছাড়া ধান উৎপাদনেও কিছু পরিমাণ বৃদ্ধি হয়। অন্যান্য বাণিজ্যিক ফসলের উৎপাদনে সেভাবে এর প্রভাব পরেনি।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

২) ভারতের নতুন কৃষি কৌশল কেবলমাত্র কয়েকটি রাজ্যেই প্রসারিত হয়েছে। উত্তর-পশ্চিম ভারতের কিছু রাজ্যে সবুজ বিপ্লব সীমাবদ্ধ ছিল বলে মনে করা হয়। এরফলে কৃষিতে অগ্রগতির ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে।

৩) কিছু ক্ষেত্রে আয় বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারে জেসন কৃষকেরা সমর্থ তারা চাষ আবাদের ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে।

৪) কৃষি জমিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে অনেক উপকারী পাখি ও পতঙ্গের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে।

৫) জলসেচের ব্যবহার বেশিমাত্রায় হওয়ায় এবং ভৌমজল ব্যবহারের ফলে ভৌমজলের স্তরে হ্রাস ঘটেছে।

উপরিক্ত অসুবিধা বা ব্যর্থতার জন্যে অনেকেই সবুজ বিপ্লবকে ধূসর বিপ্লব আখ্যা দিয়ে থাকেন। তবে একথা অবশ্যই স্বীকার করা যায় যে সবুজ বিপ্লবের কারণেই ভারতে খাদ্য উৎপাদনের দৈন্যতা অনেক কমেছে এবং উচ্চ মানের ফসল ফলনের একটি নতুন দিশা কৃষকেরা পেয়েছে। একই সাথে বিদেশ থেকে খাদ্য শস্যের আমদানিও বন্ধ হয়েছে ফলে ভারত খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা লাভ করেছে।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → ভারতের শিল্প


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখিকা পরিচিতি

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের ছাত্রী শ্রীপর্ণা পাল। পড়াশোনার পাশাপাশি, গান গাইতে এবং ভ্রমণে শ্রীপর্ণা সমান উৎসাহী।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X-geo-6-d