itihaschorchay-songbadpotro-samoyikpotrer-gurutwo
Madhyamik

আধুনিক ইতিহাস চর্চায় সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রের গুরুত্ব

ইতিহাসদশম শ্রেণি – ইতিহাসের ধারণা (পর্ব – ৭)

আগের পর্বে তোমরা ইতিহাস চর্চায় আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথার গুরুত্ব জেনেছ এই পর্বে আমরা ইতিহাসচর্চায় সংবাদ পত্র ও সাময়িকপত্রের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করবো।

তোমরা নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ো?

অতীতের সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনের যে চিরন্তন ধারাটাকে আমরা ইতিহাসের মধ্যে ধরতে চাই সেটার চলমান প্রতিচ্ছবিটাই কিন্তু ধরা পড়ে খবরের কাগজ বা সংবাদপত্রে।

একসময়ে সংবাদপত্র বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত মানবসমাজের মধ্যে যোগসূত্র রচনার একমাত্র মাধ্যম ছিল। এখন তো টেলিভিশন বা মোবাইলের কল্যাণে আমরা বিশ্বনাগরিক হিসেবে একটি সমরূপ সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি।

ঐতিহাসিককেরা মনে করেন পঞ্চদশ শতকের মুদ্রণবিপ্লব ও তার হাত ধরে সংবাদপত্রের আবির্ভাব ইউরোপে জাতিগঠনে বিশেষ সহায়তা করেছে। মধ্যযুগে ইউরোপের জীবনযাত্রা অনেকটাই ধর্মকেন্দ্রিক ছিল। মুদ্রণযন্ত্রের সুবাদে বাইবেল ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয় ও ধর্মীয় উপদেশাবলী বা ডিসকোর্সকে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ বিভিন্নভাবে পাঠ করেন। এরফলে ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তা গঠনের পথ সুগম হয়। তবে পাঠের এই প্রকারভেদ অচিরেই ধর্মের নামে রাজনীতির জন্ম দেয়।

সমগ্র ইউরোপ ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্ট দুটি শিবিরে ভাগ হয়ে যায়।

কালক্রমে ধর্ম বা ধর্মের এক্তিয়ারভুক্ত বিবাহ, পরিবার প্রভৃতি বিষয়গুলি গৌণ হয়ে ব্যক্তিগত পছন্দের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। রাজনীতি বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের বিষয়টি হয়ে ওঠে জনসাধারণের মূল মাথাব্যথার বিষয়। ধীরে ধীরে এই বিষয়গুলিই নবোদ্ভূত সংবাদপত্রগুলির পাতায় স্থান করে নেয়।

বুঝতেই পারছো, ইউরোপে সংবাদপত্র ছিল একটি সামাজিক পট পরিবর্তনের সূচক।

ইউরোপে জাতিগঠন একটি সামাজিক প্রক্রিয়া হলেও ভারতবর্ষে তা ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অঙ্গ। ভারতবর্ষে সংবাদপত্রের প্রচলন ও ক্রমবিকাশকে বিচার করতে হবে এই প্রেক্ষাপটেই।

ভারতবর্ষে সংবাদপত্রের সূচনা ও প্রসার

ঔপনিবেশিক ভারতে প্রথম প্রকাশিত সংবাদপত্র ছিল জেমস অগাস্টাস হিকির ‘বেঙ্গল গেজেট’।

বাংলা ভাষায় আভিধানিক অর্থে সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে সময় লাগলেও খ্রিষ্টান মিশনারীদের উদ্যোগে 1818 সাল থেকেই বাংলায় সাময়িকপত্র প্রকাশ হতে থাকে। ওই বছর শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশনের উদ্যোগে প্রকাশিত হয় ‘দিগদর্শন’।

হেয়ার স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড হেয়ারের স্নেহধন্য ‘স্কুল বুক সোসাইটি’ থেকে 1822 সালে প্রকাশিত হয় ‘পশ্বাবলী’।

প্রথম দিককার এই পত্রিকাগুলি মূলতঃ কিশোর পাঠক পাঠিকাদের জন্যই লেখা হত। অচিরেই বিভিন্ন জটিল সামাজিক বিষয় নিয়ে আলোচনার মাধ্যম হয়ে ওঠে এই সাময়িক পত্র। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় শিক্ষিত সমাজ হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের গোঁড়ামিগুলির বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেন।

এই সময় আচারসর্বস্ব হিন্দুধর্মের সমালোচনা করে রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের মুখপত্র ছিল ‘সংবাদ কৌমুদী’। এই সংগঠনের বিরোধী রক্ষণশীল হিন্দু সংগঠন ধর্মসভার মুখপত্র ছিল ‘সমাচার চন্দ্রিকা’।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

বিধবা বিবাহের সমর্থনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রথম দিককার লেখাগুলি প্রকাশিত হয়েছিল ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায়। এইসব পত্রিকায় ধর্মীয় আচার, শাস্ত্রের বিধান, সতীদাহের মত কুপ্রথার অযৌক্তিকতা, বিধবা বিবাহের প্রয়োজনীয়তা প্রভৃতি নানাবিধ বিষয়ে তর্কবিতর্ক চলত। সতীদাহের পক্ষে ও বিপক্ষে বক্তব্যগুলিতে শাস্ত্রবচনের নানারকম মজাদার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

এ নিয়ে যদি বিশদে জানতে চাও, লতা মণির ‘কনটেনশিয়াস ট্রাডিশনস’ বইটি পড়ে দেখতে পারো।

অন্যদিকে ‘আল ইসলাম পত্রিকা’, ‘সওগাত পত্রিকা’, ‘মিহির’, ‘সুধাকর’, ‘নবনূর’, ‘বঙ্গনূর’, ‘মোহাম্মদী’, ‘বুলবুল’, ‘বেগম’ প্রভৃতি পত্রিকায় মুসলিম মহিলাদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নিয়মিত লেখা প্রকাশিত হত। অর্থাৎ, ইউরোপের মত ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও ধর্ম ও পরিবর্তনশীল সমাজের ঘাত-প্রতিঘাতের ইতিহাস রচনায় এই সংবাদপত্রগুলির সাহায্য অবশ্য প্রয়োজনীয়।

মহাবিদ্রোহের পরবর্তী সময়ে সংবাদপত্রের ভূমিকা

1857 সালের মহাবিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার ভারতের প্রত্যক্ষ শাসনভার গ্রহণ করে। সামাজিক সমস্যার জায়গায় এবার শিক্ষিত সমাজ পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন সরকারি নীতি নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে শুরু করে। ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকায় সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় নীলকর সাহেবদের অত্যাচার সম্পর্কে সরকার বাহাদুরের নিস্পৃহতার সমালোচনা করেন।

1872 খ্রিষ্টাব্দে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় আত্মপ্রকাশ করে ‘বঙ্গদর্শন‘। ‘বঙ্গদর্শন’ বাংলা পত্রপত্রিকার ইতিহাসে এক যুগসন্ধিক্ষণকে সূচিত করে।বঙ্গদর্শন পত্রিকা প্রকাশের পিছনে বঙ্কিমচন্দ্রের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সমকালীন শিক্ষিত মননের সঙ্গে সাধারণ মানুষের পরিচয় ঘটানো। সমসাময়িক পাশ্চাত্য জ্ঞানচর্চার বিষয়গুলি এই পত্রিকায় উঠে আসত। দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান ও প্রাণীবিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন রচনা এখানে প্রকাশিত হত।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল


‘বেঙ্গলী’ পত্রিকায় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার বয়সসীমা হ্রাসের দাবি তোলা হয়। শিক্ষিত সমাজের এইসব রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া স্বভাবতই ঔপনিবেশিক শাসকবর্গ ভালোভাবে নেয়নি।

বড়লাট লর্ড লিটনের আমলে 1878 সালের 18ই মার্চ ‘দেশীয় ভাষা সংবাদপত্র আইন’ জারি করে দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রের সরকারি কার্যকলাপের সমালোচনা করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।

এতদসত্ত্বেও মানুষের মতপ্রকাশের অধিকারকে সম্পূর্ণ দমানো যায়নি। আইনের আওতা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বিখ্যাত বাংলা-ইংরেজী দ্বিভাষিক সাপ্তাহিক ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ রাতারাতি আদ্যন্ত ইংরেজি ভাষায় রূপান্তরিত হয়।

এই হপকিনসন ও কপ প্রেসটি অমৃতবাজার পত্রিকার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল [image by Biswarup Ganguly,source own work, licensed under CC BY 3.0]
অবশেষে এই আইনের অচলতা অনুধাবন করে 1882 সালে বড়লাট লর্ড রিপনের আমলে এই কালা আইন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

1905 সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে যে স্বদেশি আন্দোলন গড়ে ওঠে তাতেও সংবাদপত্রের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। শ্যামজী কৃষ্ণবর্মার ‘ইন্ডিয়ান সোসিওলজিস্ট’, অরবিন্দ ঘোষের ‘বন্দেমাতরম’, কৃষ্ণকুমার মিত্রের ‘সঞ্জীবনী’, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের ‘সন্ধ্যা’, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ও ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের ‘যুগান্তর’ প্রভৃতি পত্রিকায় রাজনৈতিক আন্দোলন পরিচালনার নানাবিধ পন্থার প্রতি দিকনির্দেশ করা হয়।

অধ্যায় সমাপ্ত।


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতি

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এম ফিল পাঠরত রাতুল বিশ্বাস। ইতিহাসচর্চার পাশাপাশি লেখা-লিখিতেও সমান উৎসাহী রাতুল।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X-Hist-1g