radioactive-rays
Madhyamik

তেজস্ক্রিয় রশ্মির প্রকৃতি

ভৌতবিজ্ঞানদশম শ্রেণি – অধ্যায়: পরমাণুর নিউক্লিয়াস (দ্বিতীয় পর্ব)

আগের পর্বে আমরা তেজস্ক্রিয়তা ও তার কারণ সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এই পর্বে আমরা তিন প্রকার তেজস্ক্রিয় রশ্মি নিয়ে আলোচনা করবো।

যেহেতু বেকারেল প্রথম তেজস্ক্রিয় রশ্মি সম্পর্কে ধারণা দেন তাই এই রশ্মিকে বেকারেল রশ্মিও বলা হয়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন বিজ্ঞানী যেমন, রাদারফোর্ড মাদাম ও পিয়ের কুরী, ভিলার্ড প্রমুখেরা পরীক্ষা করে দেখান যে, কোন তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে নির্গত রশ্মি আসলে তিন প্রকার রশ্মির সমন্বয়ে গঠিত।

Alpha_Beta_Particles,_Gamma_Rays_in_a_Magnetic_Field
তেজস্ক্রিয়তার পরীক্ষা (সৌজন্যে – http://wiki.chemprime.chemeddl.org)

এই পরীক্ষার জন্য উদ্ভুত তেজস্ক্রিয় রশ্মিকে তড়িত-চুম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে দিয়ে পাঠানো হয়। দেখা যায় সম্পূর্ণ রশ্মির একটি অংশ দেখা যায় তড়িতচৌম্বক ক্ষেত্রের ধবনাত্মক দিকে বেঁকে গেছে। এর থেকে ধারণা করা হয় যে তেজস্ক্রিয় রশ্মির ঐ অংশ ঋণাত্মক চার্জবাহী এবং এর নাম দেওয়া হয় β (বিটা) – রশ্মি বা β কণা।


তেজস্ক্রিয় রশ্মির অপর একটি অংশ ঋণাত্মক তড়িত-চৌম্বক ক্ষেত্রের দিকে আকৃষ্ট হয়। সুতরাং এই অংশটি ধবনাত্মক চার্জবাহী ও এর নাম দেওয়া হয় α (আলফা) – রশ্মি বা α কণা

তেজস্ক্রিয় রশ্মির বাকি অংশ কোন দিকে না বেঁকে সোজা ধাবিত হয়। সুতরাং ধারণা করা হয় যে এই অংশটি নিস্তড়িৎ। এই অংশের নাম দেওয়া হয় γ (গামা) রশ্মি।

NM3_1Ani

আলফা, বিটা ও গামা তিন প্রকার রশ্মির তুলনামূলক আলোচনা

ধর্ম α কনা/রশ্মি β কণা/রশ্মি γ – রশ্মি
প্রকৃতি এটি আসলে পরমাণুর কেন্দ্রক থেকে নির্গত 2টি প্রোটন ও 2 টি নিউট্রন দ্বারা গঠিত কণা। সহজ ভাষায় একে ইলেকট্রন বিহীন হিলিয়াম পরমাণুও বলা চলে। এর সংকেত : 2^{\alpha^{4}} এটি পরমাণুর কেন্দ্রক থেকে নির্গত ইলেকট্রন কণার স্রোত। এর সংকেত হল 1^{\beta^{0}} বা 1^{e^{0}} এটি আসলে পরমাণুর কেন্দ্রক থেকে নির্গত অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ।
ভর

(α>β>γ)

 সকাল তেজস্ক্রিয় রশ্মির মধ্যে α কণার ভর সর্বাধিক এর ভর প্রোটনের ভরের প্রায় 4 গুণ। β কনার ভর αএর চেয়ে কম এবং একটি ইলেকট্রনের ভরের সমান। এটি ভরহীন।
আধান +2 একক -1 একক  0 একক
ভেদন ক্ষমতা

 

(α<β<γ)

 যেহেতু সবচেয়ে ভারী ও আকারে বড় তাই ভেদন ক্ষমতা সর্বনিম্ন। আকারে α-এর চেয়ে ছোট হওয়ার ভেদন ক্ষম তাও তুলনায়  বেশি। ভরহীন তাই ভেদন ক্ষমতা সর্বাধিক।
আয়নন ক্ষমতা

(α>β>γ)

α কণা যেহেতু সব চেয়ে ভারী তাই এটি গ্যাসের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় গ্যাসের পরমাণুর বহিঃ কক্ষের ইলেকট্রন পজিটিভ α কণা দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে যুক্ত হয় ফলে গ্যাস আয়নিত হয়। β কণার চার্জ ও ভর α কণার চেয়ে কম হওয়ার গ্যাসকে  আয়নিত করার ক্ষমতা ও α কণার চেয়ে কম। γ রশ্মির ভরহীনতা ও নিস্তড়িৎ প্রকৃতির কারনে এটির গ্যাসকে আয়নিত করার ক্ষমতা সর্বনিম্ন।
গতিশক্তি

(α>β>γ)

α কণার ভর সর্বাধিক হওয়ার কারণে তেজস্ক্রিয় রশ্মি গুলির মধ্যে এর গতি শক্তি সর্বাধিক। β কণার গতিশক্তি α কণার চেয়ে কম। γ রশ্মির গতিশক্তি প্রায় নেই বললেই চলে।
ভরবেগ

(α>β>γ)

α কণার ভর বেগ সর্বাধিক। β কণার ভর বেগ α– কণার চেয়ে কম। γ রশ্মির ভর বেগ প্রায় শূন্য।
জীব কোষের উপর প্রভাব  জীব কোষের সর্বাধিক ক্ষতি করে ও ক্ষতের সৃষ্টি করে। জীব কোষের ক্ষতির পরিমাণ β কণার চেয়ে কম। γ রশ্মি জীব কোষের সবচেয়ে কম ক্ষতি করে।

কোন পরমাণু থেকে তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গমনের ফলে কি ঘটে?

যেহেতু তেজস্ক্রিয় রশ্মি তিন প্রকার তাই সকল প্রকার তেজস্ক্রিয় রশ্মির নির্গমনের ফলে একই প্রকারের পরিবর্তন হয় না।

আলফা (α) কণা নির্গমনের ফল

α কণার পরমাণু ক্রমাঙ্ক 2 একক ও ভর 4 একক সুতরাং কোন মৌলের পরমাণু থেকে α-কণা নির্গত হলে মৌলটির পরমাণু ক্রমাঙ্ক 2 একক এবং ভর সংখ্যা 4 একক কমে যায়। ফলে একটি নতুন মৌলের সৃষ্টি হয়।

ধরা যাক একটি মৌল 84^{Po^{218}} (পোলোনিয়াম) যা থেকে একটি α কণা নির্গত হচ্ছে সুতরাং নতুন মৌলের পরমাণু ক্রমাঙ্ক হবে (84-2) = 82 এবং ভরসংখ্যা হবে (218-4) = 214 এবং পরমাণু ক্রমাঙ্ক অনুসারে  উৎপন্ন নতুন মৌলটি হবে লেড।

{84^{Po^{218}}}\overset{2^{\alpha^{4}}}{\rightarrow} 82^{Pb^{214}}


দশম শ্রেণির ভৌতবিজ্ঞান বিষয়ক অন্যান্য লেখাগুলি পড়ুন।

বিটা (β) কণা নির্গমনের ফল

β কণার ভরসংখ্যা শূণ্য এবং পরমাণু ক্রমাঙ্ক 1, বস্তুতর β কণা ঋণাত্মক প্রকৃতির হওয়ার কোন মৌলের পরমাণু থেকে β কণা নির্গত হলে ঐ মৌলের পরমাণু ক্রমাঙ্ক 1 একক বৃদ্ধি পায়, আর ভরসংখ্যা শূন্য হওয়ার কারণে β কণা নির্গমনে মৌলের ভর সং খ্যার কোন পরিবর্তন হয় না।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় , 84^{Po^{218}} থেকে একটি β কণা নির্গত হলে মৌলটির ভর সংখ্যা 218 ই থাকে এবং পরমাণু ক্রমাঙ্ক হয় (84+1) = 85। যেহেতু পরমাণু ক্রমাঙ্ক পরিবর্ত্তিত হয় ফলে উৎপন্ন মৌলটি একটি নতুন মৌল হয়ে থাকে যার নাম অ্যাটনিয়াম (A+)।

{84^{Po^{218}}}\overset{-1^{\beta ^{0}}}{\rightarrow} 85^{At^{214}}

এক্ষেত্রে বলা যায় যে β -কণা নির্গমনের মাধ্যমে যে নতুন মৌলের সৃষ্টি হয় তা হল পূর্ববর্ত্তি মৌলের আইসোবার। কারণ তাদের পরমাণু ক্রমাঙ্ক ভিন্ন হলেও ভর সংখ্যা সমান


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

এক্ষেত্রে আরও একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ্য যে মৌলের তেজস্ক্রিয় বিভাজন যে কেবল 1টি  α কণা বা 1টি β কণা নির্গমনের পরেই বন্ধ হয়ে যায় এমনটা নয়।

আগেই বলা হয়েছে যে \frac{n}{p} অনুপাত 1 এর বেশি থাকলেই সেই মৌলের পরমাণু ভাঙ্গনশীল বা তেজস্ক্রিয় রূপ প্রদর্শন করে। সুতরাং α বা β কণার নিঃসরণ ততক্ষণ চলতে থাকে যতক্ষন না \frac{n}{p} অনুপাতের মান উপযুক্ত সুবিধা জনক স্থানে পৌঁছানোর মাধ্যমে উৎপন্ন পরমাণুর নিউক্লিয়াসটি সুস্থিত হচ্ছে।

গামা (ϒ) রশ্মি কণা নির্গমনের ফল

সাধারণ ভাবে α ও β কণার নির্গমনের মাধ্যমে কোন তেজস্ক্রিয় মৌলের নিউক্লিয়াস একটি সুস্থিত অতেজস্ক্রিয় মৌলের নিউক্লিয়াসে পরিণত হলেও সেই নিউক্লিয়াসে কিছু আতিরিক্ত শক্তি থেকে যায়। এই শক্তিই তড়িত-চুম্বকীয় তরঙ্গ রূপে পরমাণুর কেন্দ্রক বা নিউক্লিয়াস থেকে নির্গত হয় যা γ–রশ্মি নামে পরিচিত।

γ রশ্মির ভর সংখ্যা বা পরমাণু ক্রমাঙ্ক না থাকায় পূর্ববর্ত্তি মৌলের ভর সংখ্যা বা পরমাণু ক্রমাঙ্কের কোনরূপ পরিবর্তন হয় না। তাই বলা যায় γ রশ্মির নিঃসরণ কোন নতুন মৌল সৃষ্টি করে না।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

তেজস্ক্রিয়তার ব্যবহার কি কি?

চিকিৎসাক্ষেত্রে – বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় মৌলের সমস্থানিক ক্যান্সার নিরাময়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।

কোন বস্তুর বয়স নির্ণয়ে – তেজস্ক্রিয় বিঘটনের সূত্র দ্বারা বিভিন্ন ঐতিহাসিক বস্তুর বয়স নির্ণয়ের কাজে তেজস্ক্রিয়তা ব্যবহার আছে।

পারমানবিক শক্তি উৎপাদনে – তেজস্ক্রিয় বিভাজন পদ্ধতির সাহায্যে পারমানবিক শক্তি উৎপাদিত হয়।

এছাড়াও কৃষিক্ষেত্রে, পরীক্ষাগারে গ্যাসকে আয়ণিত করার কাজেও তেজস্ক্রিয়তার ব্যবহার আছে।

পরবর্তী পর্বে পড়ুন নিউক্লিয় শক্তি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা।


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
Dr. Mrinal Seal
ডঃ মৃণাল শীল সাঁতরাগাছি উচ্চ বিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার একজন জনপ্রিয় শিক্ষক। পড়াশোনার পাশাপাশি ঘুরে বেড়াতে ও নানান ধরণের নতুন নতুন খাবার খেতেও পছন্দ করেন ডঃ শীল।