sthaniyo-akosmik-bayur-dharona
Madhyamik

স্থানীয় ও আকস্মিক বায়ুর ধারণা

ভূগোলদশম শ্রেণি – বায়ুমণ্ডল (নবম পর্ব)

আগের পর্বে আমরা নিয়ত বায়ু ও সাময়িক বায়ুর ধারণা সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজকের পর্বে স্থানীয় ও আকস্মিক বায়ুর ধারণা আমরা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

স্থানীয় বায়ু

ভূপ্রকৃতি, মৃত্তিকার তাপ শোষণ ক্ষমতা ও বায়ুচাপের তারতম্যের ফলে অল্প পরিসরে অঞ্চলের মধ্যে যে বায়ু প্রবাহের উৎপত্তি হয়, তাকে স্থানীয় বায়ু বলা হয়। তাপের পার্থক্য অনুযায়ী স্থানীয় বায়ুকে উষ্ণ স্থানীয় বায়ু শীতল স্থানীয় বায়ু ভাগ করা যায়।

উষ্ণ স্থানীয় বায়ু

ফন

এই বায়ু আল্পস পর্বতের উত্তর ঢালে প্রবাহিত হয় এবং পর্বতের ঢাল বেয়ে নিচের দিকে নামে। অ্যাডিয়াবেটিক প্রক্রিয়ায় এই বায়ু শুষ্ক ও উষ্ণ হয়।

চিনুক

উত্তর আমেরিকার রকি পর্বতের উত্তর পূর্ব ঢালে এই স্থানীয় বায়ু প্রবাহিত হয়। এই বায়ু অ্যাডিয়াবেটিক প্রক্রিয়ায় উষ্ণ এবং শুষ্ক হয়ে পড়ে এবং বরফ গলিয়ে দেয়। তাই এই বায়ু তুষার ভক্ষক বায়ু নামে পরিচিত।

লু
ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে এই বায়ু প্রবাহিত হয়। ভূপৃষ্ঠের প্রবল উত্তাপের ফলে এই বায়ু এবং রুক্ষ হয়।

সিরোক্কো
এই বায়ুর সাহারা মরুভূমি ও ভূমধ্যসাগর থেকে দক্ষিণ ইতালি ও স্পেনের উপরে প্রবাহিত হয়। উষ্ণ ভূপৃষ্ঠের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় অ্যাডভেকশন পদ্ধতিতে এই বায়ু উষ্ণ হয়।

শীতল স্থানীয় বায়ু

মিস্ট্রাল

ফ্রান্সের রোন নদীর উপত্যকায় বরাবর এই অত্যন্ত শীতল বায়ু প্রবাহিত হয়।

বোরা

অতি শীতল ও শুষ্ক বায়ু বোরা ইতালির অ্যাড্রিয়াটিক উপকূলে বরাবর প্রবাহিত হয়।

আকস্মিক বায়ু

বায়ুমন্ডলে হঠাৎ সৃষ্টকারি দুর্যোগপূর্ণ অনিয়মিত বায়ুপ্রবাহকে আকস্মিক বায়ু বলা হয়।

আকস্মিক বায়ু দুই প্রকারের হয় যথা – ঘূর্ণবাত এবং প্রতীপ ঘূর্ণবাত।

ঘূর্ণবাত

স্থলভাগ জলভাগের উপরে প্রবল উষ্ণতার ফলে কোনো স্বল্প পরিসর স্থানের বাতাস হালকা হয়ে উপরের দিকে উঠে যায় এবং একটি শক্তিশালী নিম্নচাপ কক্ষ বা কেন্দ্রের সৃষ্টি করে। বায়ুমণ্ডলের নিচের দিকে এই নিম্নচাপ কেন্দ্রকে ঘিরে একটি খাড়া চাপ ঢাল তৈরি হয়। এরফলে চারিদিক থেকে শীতল বাতাস পাক খেতে খেতে এই কেন্দ্রের দিকে ছুটে আসে এবং আবার উত্তপ্ত হয়ে উপরে উঠে যায়। এরকম কেন্দ্রমুখী প্রবল সম্পন্ন বায়ুর আবর্তকেই ঘূর্ণবাত বলা হয়।

ঘূর্ণবাত

ঘূর্ণবাতের বৈশিষ্ট্য

এই ঘূর্ণবাতের কেন্দ্রে বায়ুর চাপ সবথেকে কম এবং ঘূর্ণবাতের বাইরে বায়ুর চাপ সবথেকে বেশি হয়। এর কেন্দ্রে বায়ুর চাপ 850 থেকে 900 মিলিবার হয়ে থাকে।

এই ঘূর্ণবাত উত্তর গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে অর্থাৎ বামাবর্তে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে দক্ষিণাবর্তে চক্রাকারে প্রবাহিত হয়।

• গুনাবাতির মাঝখানে যে গোলাকার কেন্দ্রটি বর্তমান একে ঘূর্ণবাতের চক্ষু বলা হয়।
• একটি ঘূর্ণবাতের ব্যাস সর্বাধিক 3 হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।
• ঘূর্ণবাতের মধ্যে বায়ুর গতিবেগ ঘণ্টায় 40 কিলোমিটার থেকে 400 কিলোমিটার হতে পারে।
• ঘূর্ণবাত প্রবল ঝড় বৃষ্টির এবং দুর্যোগের আবহাওয়ার সংকেত দেয়।

ঘূর্ণবাতের শ্রেণীবিভাগ

ঘূর্ণবাতের অবস্থানের ভিত্তিতে ঘূর্ণবাতকে দুই ভাগে ভাগ করা যায় সেগুলি হল- ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত এবং নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত

নিরক্ষরেখার দুই পাশে অবস্থিত ক্রান্তীয় অঞ্চলে অর্থাৎ 5° থেকে 30° অক্ষরেখার মধ্যে সমুদ্রের উপর সৃষ্ট নিম্নচাপ কেন্দ্রকেই ক্রান্তীয় বা উষ্ণ মণ্ডলীয় ঘূর্ণবাত বলা হয়। নিরক্ষীয় অঞ্চলে সমুদ্র জলের তাপমাত্রা 27°C থাকায় এবং জলীয় বাষ্পজনিত লীনতাপ প্রচুর পরিমাণে থাকার কারণে এই ঘূর্ণবাত সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত এখান থেকেই শক্তি সঞ্চয় করে স্থলভাগের দিকে এগিয়ে যায় এবং উপকূল অঞ্চলে পতিত হয়।

এই ঘূর্ণবাত বিভিন্ন মহাসাগরের বিভিন্ন নামে পরিচিত যেমন ক্যারিবিয়ান সাগরে হারিকেন, জাপান সাগরে তাইফু দক্ষিণ চীন সাগরে টাইফুন, উত্তর ভারত মহাসাগরে বাগুইও, দক্ষিণ ভারত মহাসাগরে উইলি উইলি, দক্ষিণ-পশ্চিম ভারত মহাসাগর ও উত্তর পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে সাইক্লোন এবং পশ্চিম আটলান্টিকে টর্নেডো নামে পরিচিত।

ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাতের বৈশিষ্ট্য

• এই ঘূর্ণবাত গ্রীষ্মকালে ও শরৎকালের সমুদ্রের উপর সৃষ্টি হয়।
• এই ঘূর্ণবাত বায়ুর গতিবেগ ঘন্টায় 100 থেকে 500 কিমি পর্যন্ত হয়।
• এই ঘূর্ণবাত অত্যন্ত বিধ্বংসী চরিত্রের হতে পারে।
• এই ঘূর্ণবাত স্বল্পস্থায়ী হয় কিন্তু ভারী বর্ষণ ঘটায়।

নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত

মধ্য অক্ষাংশীয় অর্থাৎ নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলে 30° থেকে 60° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে উষ্ণ ও শীতল বায়ু সংঘর্ষে যে ঘূর্ণবাতের সৃষ্টি হয়, তাকে নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাত বলা হয়। এই অঞ্চলে উষ্ণ বায়ু ও শীতল বায়ুর সংঘর্ষে একটি সীমান্ত (Front) সৃষ্টি হয়। এই সীমান্ত বরাবর ঘূর্ণবাত সংঘটিত হয়।

নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবাতের বৈশিষ্ট্য

• এই ঘূর্ণবাত প্রধানত শীতকালের স্থলভাগের উপর সৃষ্টি হয়।
• এই ঘূর্ণবাত বিধ্বংসী চরিত্রের হয় না। এই ঘূর্ণবাতের বাতাসের গতিবেগ 30 থেকে 35 কিলোমিটার হয়।
• এই ধরনের ঘূর্ণবাত দীর্ঘস্থায়ী হলেও স্বল্প পরিমাণ বৃষ্টিপাত ও তুষারপাত ঘটায়।

প্রতীপ ঘুর্ণবাত

নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলের কোনো অংশে হঠাৎ উষ্ণতা হ্রাস পাওয়ার কারণে উচ্চচাপে সৃষ্টি হয় এই উচ্চচাপ কেন্দ্রের বাইরের দিকে নিম্নচাপের অবস্থান হওয়ার জন্য এই উচ্চচাপ কেন্দ্র থেকে শীতল বাতাস বাইরের দিকে প্রবাহিত হয় একে কেন্দ্রবহির্মুখী বায়ু প্রবাহ বা প্রতীপ ঘূর্ণবাত বলা হয়।

প্রতীপ ঘূর্ণবাত

প্রতীপ ঘুর্ণবাতের বৈশিষ্ট্য

• প্রতীপ ঘূর্ণবাতের কেন্দ্রে থাকে উচ্চচাপ এবং বাইরের দিকে থাকেন নিম্নচাপ এবং কেন্দ্র ও কেন্দ্রের বাইরে মধ্যে চাপের তারতম্য প্রায় 10 থেকে 20 মিলিবার থাকে।
• ঘূর্ণবাতের কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে বায়ু প্রবাহিত হয়।
• প্রতীপ ঘূর্ণবাত এর অঞ্চলে আকাশ পরিষ্কার ও মেঘমুক্ত থাকে।
• প্রতীপ ঘূর্ণবাত বিশাল অঞ্চল জুড়ে সৃষ্টি হয় এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়।
• প্রতীপ ঘূর্ণবাত উত্তর গোলার্ধে ডান দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বামদিকে আবর্তিত হয়।
• বায়ু চাপের তারতম্য কম থাকায় বায়ুর গতিবেগ অনেক কম হয় গড়ে 30 থেকে 50 কিলোমিটার প্রতি ঘন্টায়।
• উচ্চচাপ কেন্দ্রে বায়ু ভারী এবং শীতল হওয়ার কারণে ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন হয়ে কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে প্রবাহিত হয়।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → জেট বায়ুর ধারণা


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X-geo-2-i