foraji-movement-oyahabi-movement
Madhyamik

ওয়াহাবি আন্দোলন ও ফরাজি আন্দোলন

ইতিহাসদশম শ্রেণি – প্রতিরোধ বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ (পর্ব – ৬)

গত পর্বে আমরা সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এই পর্বে আমরা ওয়াহাবি আন্দোলন ও ফরাজি আন্দোলন সম্পর্কে জানবো।

বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলন (১৮২২-৩১)

বাংলায় মির নিশার আলি বা তিতুমিরের নেতৃত্বে ওয়াহাবি আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল। যদিও প্রকৃত ওয়াহাবি আন্দোলনের জন্ম বাংলা বা ভারতে নয়।

ইসলামের শুদ্ধিকরণের জন্য আরব দেশে আব্দুল ওয়াহাব নামে এক ব্যক্তি এই আন্দোলনের সূচনা করেন। ‘ওয়াহাবি’ শব্দের অর্থ নবজাগরণ।

ভারতে দিল্লির শাহ ওয়ালিউল্লাহ এই আন্দোলনের সূত্রপাত করলেও রায়বেরিলির সৈয়দ আহমেদ বরেলভিকেই এই আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। তিতুমির হজ করতে গিয়ে সৈয়দ আহমেদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের সূত্রপাত করেন।


jump magazine smart note book


বারাসাত তিতুমিরের মূল ঘাঁটি ছিল বলে এই আন্দোলন ‘বারাসাত বিদ্রোহ’ নামেও পরিচিত।

ওয়াহাবি আন্দোলনের কারণ

ওয়াহাবি আন্দোলন প্রকৃত অর্থে ছিল ইসলামীয় পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন। সৈয়দ আহমেদ ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতকে ‘দার-উল-হারব’ বা ‘বিধর্মীদের দেশ’ বলে অভিহিত করেন এবং ধর্মযুদ্ধের দ্বারা এই দেশকে ‘দার-উল-ইসলাম’ বা ‘ইসলামশাসিত পবিত্রভূমিতে’ পরিণত করার আহ্বান জানান।
প্রাথমিকভাবে ইসলামের শুদ্ধিকরণ এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য হলেও পরবর্তীকালে তিতুমীরের নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা সুদখোর মহাজন, জমিদার ও নীলকরদের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাই ডঃ বিনয়ভূষণ চৌধুরী বলেছেন যে, ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনের উদ্দেশ্যে তিতুমিরের বিদ্রোহ শুরু হলেও তা পরবর্তীকালে ব্রিটিশ বিরোধী গণ অভ্যুত্থানের চেহারা নেয়।

অসাধারণ সাংগঠনিক শক্তির অধিকারী তিতুমির দরিদ্র মুসলিমদের নিয়ে এক সংগঠন গড়ে তোলেন। মৈনুদ্দিন ও গোলাম মাসুম ছিলেন তিতুর বাহিনীর যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রী ও সেনাপতি। ইংরেজ রাজত্বের অবসানকল্পে তিতুমির নিজেকে ‘বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করেন। [লক্ষ্য করো, ‘বাদশাহ’ শব্দটি মোঘল শাসকদের পদবি হলেও এক কৃষক নেতা অবলীলাক্রমে তা রুপকার্থে ব্যবহার করছেন।] আসলে ‘বাদশাহ’ শব্দটি ততদিনে ভারতের সার্বভৌমত্বের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই তিতুমিরের আন্দোলনকে ধর্মের মোড়কে রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার এক মরিয়া চেষ্টা বললেও অত্যুক্তি হয় না।

ওয়াহাবি আন্দোলনের বিস্তার ও পরিণতি

তিতুমির প্রায় ৫০০ জন হতদরিদ্র ও নির্যাতিত মুসলমানকে সঙ্গে নিয়ে উত্তর চব্বিশ পরগনার বাদুরিয়া থানার অন্তর্ভুক্ত নারকেলবেড়িয়া গ্রামে একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন। এই কেল্লাই ছিল বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র। তিতুমির মূর্তিপূজা, পিরদের পূজা ও সুদে টাকা খাটানোর বিরোধী ছিলেন। ধীরে ধীরে এই আন্দোলন নদিয়া, যশোর, চব্বিশ পরগনা, মালদা, ঢাকা, রাজশাহী প্রভৃতি অঞ্চলে বিস্তারলাভ করে।

বাংলায় তিতুমিরের আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করলে ব্রিটিশ সরকার এই বিদ্রোহ দমনে উদ্যোগী হয়।

১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক তিতুমিরের বিরুদ্ধে একটি অভিযান প্রেরণ করেন। কামনার গোলার আঘাতে বাঁশের কেল্লা ধ্বংস হয়ে যায়। তিতুমির মৃত্যুবরণ করেন এবং গোলাম মাসুদসহ অন্যান্য বন্দি সেনাদের ফাঁসি হয়।

বাঁশের কেল্লার পতনের পরে এই বিদ্রোহ ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে পড়ে।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

jump magazine smart note book


তিতুমির বাংলায় যে ওয়াহাবি আন্দোলনের সূত্রপাত করেন তার নাম ‘তরিকা-ই-মহম্মদীয়া’ বা মহম্মদের পথ। অধ্যাপক গৌতম ভদ্র বলেছেন যে, তিতুমিরের অনুগামীরা এই আন্দোলনকে ওয়াহাবি নয় ‘তরিকা-ই-মহম্মদীয়া’ বলত ও নিজেদেরকে বলত ‘হেদায়তী’ (সঠিক পথের পথিক)

অর্থাৎ, ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন হলেও ওয়াহাবি আন্দোলনের যে একটি নির্দিষ্ট প্রণোদনার উৎস বা ভরকেন্দ্র ছিল এমনটা ধরে নেবার কোনো কারণ নেই। বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলন প্রকৃতিগতভাবে ছিল একটি স্থানীয় অভ্যুত্থানের মত। মূর্তিপূজার পাশাপাশি পিরপূজার বিরোধিতা এই আন্দোলনের গোঁড়া ধর্মীয় চরিত্রকে তুলে ধরে।

অভিজিৎ দত্তের মতে, তিতুমিরের বারাসাত বিদ্রোহ ছিল আসলে অন্ধ মুসলিম জেহাদ। অন্যদিকে এই আন্দোলনে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের যোগদানের কারণে এর গণমুখী চরিত্রটিকেও ঠিক অস্বীকার করা যায় না। নরহরি কবিরাজ যেমন একে ধর্মের মোড়কে কৃষক বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন।

ফরাজি আন্দোলন (১৮১৮-১৯০৬)

এককথায় ফরাজি আন্দোলনকে বাংলাদেশের ফরিদপুরে কৃষি অসন্তোষ ও ধর্মীয় প্রভাবের সংযুক্ত ফল হিসেবে দেখা যেতে পারে। এই আন্দোলনে হাজি শরিয়তউল্লাহ ও তার পুত্র মোহাম্মদ মহসিন ওরফে দুদু মিঞা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। এই দুই ব্যক্তিত্বের ক্যারিশমায় ভর করেই ফরাজি আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল।


ওয়াহাবি আন্দোলন ও ফরাজি আন্দোলন আলোচনা


শরিয়তউল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০)

১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার বাহাদুরপুর গ্রামে এক কৃষক পরিবারে হাজি শরিয়তউল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন। দেশের পাশাপাশি বিদেশেও মক্কা কায়রোর মত শহরে তিনি ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেন। দেশে ফিরে তিনি ‘ফরাজি’ নামে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় গড়ে তোলেন। ‘ফর্জ’ বা ‘ফরাইজ’ থেকে ‘ফরাজি’ শব্দটির উৎপত্তি। এর অর্থ ‘ইসলাম নির্দিষ্ট বাধ্যতামূলক কর্তব্য’।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

ফরাজিদের উদ্দেশ্য ছিল ধর্মগ্রন্থের আক্ষরিক অনুসরণের মাধ্যমে ইসলামীয় আচারের সংস্কার করা। শরিয়তউল্লাহ ভারতবর্ষকে ‘দার-উল-হারব’ থেকে ‘দার-উল-ইসলামে’ পরিণত করার ডাক দেন। কোরান নির্দিষ্ট নয় এমন সব উৎসব অনুষ্ঠান তিনি বর্জনের কথা বলেন।

মোহাম্মদ মহসিন (১৮১৯-১৮৬২)

শরিয়তউল্লাহের মৃত্যুর পর ফরাজি আন্দোলনের দায়িত্ব নেন তাঁর পুত্র মোহাম্মদ মহসিন বা দুদু মিঞা। তাঁর নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের দরিদ্র মুসলমানগণ হিন্দু জমিদার ও নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়।

তিনি ঘোষণা করেন, আল্লা হলেন জমির আসল মালিক। ফলে জমির উপর খাজনা ধার্য করা ও খাজনা আদায়ের অধিকার জমিদারদের নেই। এইভাবে ধর্মীয় উন্মাদনা দরিদ্র মুসলিম কৃষকদের আর্থসামাজিক দাবিদাওয়া আদায়ে সংঘবদ্ধ হতে সাহায্য করেছিল।

ওয়াহাবিদের মতই ফরাজিরাও প্রশাসনিক কাঠামোর আদলে নিজেদের সংগঠনকে সাজিয়েছিল। মোহাম্মদ মহসিন পূর্ববঙ্গকে ৩০০ থেকে ৫০০ পরিবারের এক একটি ‘হল্কায়’ বিভক্ত করেন। হল্কাগুলিতে অর্থ ও সৈনিক সংগ্রহ এবং জমিদার-নীলকরদের বিরুদ্ধে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য একজন করে খলিফা নিযুক্ত করা হয়েছিল।

ফরাজি আন্দোলনের বিস্তার ও পরিণতি

মোহাম্মদ মহসিনের হাত ধরেই ফরাজি আন্দোলন একটি সংগঠিত কৃষক আন্দোলনের আকার ধারণ করে। আন্দোলনের মূল কেন্দ্র ছিল বাহাদুরপুর। দুদু মিঞা একটি শক্তিশালী লেঠেল বাহিনী ও গুপ্তচর বাহিনী গড়ে তোলেন। বাহাদুরপুর থেকে ধীরে ধীরে এই আন্দোলন খুলনা, যশোর, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, বাখরগঞ্জ, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, ঢাকা প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে মোহাম্মদ মহসিনের অনুগামীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় আশি হাজারে। সরকার তাঁকে বেশ কয়েকবার বন্দি করে। ১৮৬০ সালে মুক্তি পাওয়ার পর ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে বাহাদুরপুরে তাঁর মৃত্যু হয়। দুদু মিঞার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নোয়া মিঞা সংগঠনের রাশ হতে তুলে নেন। তবে তিনি ধর্মসংস্কারের উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করায় ফরাজি আন্দোলনের রাজনৈতিক ঝোঁক অনেকটাই কমে আসে।

ফরাজি আন্দোলনের প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মহলে বিতর্ক রয়েছে। এই আন্দোলনের প্রাণভোমরা ছিল মোহাম্মদ মহসিনের সুদক্ষ নেতৃত্ব। তবে শরিয়তউল্লাহের ধর্মীয় সংকীর্ণতা থেকে তিনি সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন না।

এইজন্যই অধ্যাপক শশীভূষণ চৌধুরীর মত ঐতিহাসিকেরা মনে করেন যে নীলকর ও জমিদারদের বিরুদ্ধে ফরাজিদের আন্দোলন কখনোই সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে উঠতে পারেনি। তারা নিজেরা নীলচাষ না করতে চাইলেও নীলচাষের বিলোপ চায়নি। এমনকি তারা জমিদার প্রথারও উচ্ছেদ চায়নি। তবে সংকীর্ণ ধর্মবোধ একটা সময়ের পর প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক আকাঙ্খার রূপ নেয়। ব্রিটিশ বিচারালয়ের বিকল্প হিসেবে ফরাজিদের স্থানীয় আদালত স্থাপন, হল্কা গঠন, আন্দোলন পরিচালনার জন্য কর সংগ্রহ প্রভৃতি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → মহাবিদ্রোহের চরিত্র


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X_hist_3f