bangalir-nrittawik-part-1
Class-11

বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় – প্রথম পর্ব

বাংলাএকাদশ শ্রেণি – বাঙালির শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি (প্রথম অধ্যায়)


বাঙালি কাহারে কয়

‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় আলেকজাণ্ডারের বয়ানে লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত সংলাপ –

‘সত্য সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ!’

ভারতের বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি-পরিবেশ, বেশভূষা, খাদ্যাভ্যাস, জীবনাচরণ এমনকি ধর্ম ও মানসিকতাতেও প্রবল বৈচিত্র্য। বৈচিত্র্যই ভারতের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এই বৈচিত্র্যের মধ্যে রয়েছে ঐক্যও।

বিবিধের মাঝেও মহান এক মিলনের সুর প্রবাহিত হয় এই দেশে। ভারতে যেমন নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান তেমনিই এই বাংলাও সেই বৈচিত্র্যের অঙ্গ। ভারতীয়দের বৈচিত্র্যের পাশাপাশি আঞ্চলিক সংস্কৃতি হিসেবে বাঙালিদের মধ্যেও বিরাট এক ভিন্নতা দেখা যায়।

এখন তোমরা প্রশ্ন করতেই পারো, এক দেশে এত ভিন্নতা তৈরি হল কেন? উত্তরটা দিচ্ছি। তার আগে, তোমাদের নিশ্চয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত ‘ভারততীর্থ’ কবিতার লাইনগুলো মনে আছে।
সেই যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন –

‘কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা
দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে সমুদ্রে হল হারা।
হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন –
শক-হূণ দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন –

রবীন্দ্রনাথের মতো এত সহজ করে এর ব্যাখ্যা হয়তো আর কেউ দেননি। আসলে ভারত তথা এই আপামর বাংলাদেশে কালের নিয়মে নানা সময় নানা গোষ্ঠীর মানুষ এসেছেন, নানা ধর্মের নানা গোষ্ঠীর মানুষ এসেছেন, নানা ধর্মের, নানা জাতের মানুষ এসেছেন।

কত রাজা, কত নবাব, কত সম্রাট এই উপমহাদেশে কোনো না কোনো সময় শাসন করেছেন আর এই সকল মানুষের সংস্কৃতি যেমন মিশেছে ভারতের প্রাচীন সনাতন সংস্কৃতির সঙ্গে ঠিক সেরকমভাবেই তাদের চেহারা-গড়নও কিন্তু বংশগতির ধারায় মিলেমিশে গেছে আদিম ভারতীয়দের সঙ্গে।

সহজ করে বললে, বহিরাগত পাঠানদের থেকে ভারতীয়রা যেমন কোট, পাজামা, পাঞ্জাবি ইত্যাদি পড়তে শিক্লহেছে সংস্কৃতিগতভাবে, তেমনই ভারতীয়দের মধ্যে পাঠানদের জৈবিক বাহ্যিক গঠনেরও প্রভাব পড়েছে।

পাঠানদের চেহারার সঙ্গে এখন পাঞ্জাবিদের চেহারার খানিক মিল পাবে। আবার মায়ানমারসহ উত্তর-পূর্ব মানুষদের দেখলেই আমরা অনেকসময় বলে থাকি যে তাদের সঙ্গে জাপানি বা চিনাদের মিল আছে।

এই যে সাদৃশ্য কেন হল এরকম?

শোক বা হূণদের বংশগতির ফল এটা। ভারতের প্রাচীন আদিবাসীদের সঙ্গেও কিন্তু আমাদের অনেকের চেহারার খানিক মিল পাওয়া যায়।
তোমরা নিজেদের অভিজ্ঞতায় এগুলি নিশ্চয়ই দেখেছো। দেখবে, কোনো সদ্যোজাত শিশুকে দেখতে এলে পরিবারের আত্মীয়-পরিজনেরা বলে থাকেন ‘এ পুরো বাবার মতো বা মায়ের মতো দেখতে হয়েছে’।

আসলে জিনগতভাবেই এই সাদৃশ্য বাহিত হয়। জীববিজ্ঞানের ভাষায়, বংশগতির ধারায় পূর্বপুরুষের যে জিন পরবর্তী প্রজন্মে প্রকট হবে বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যে সেই বৈশিষ্ট্যের নিরিখেই এই সাদৃশ্যের বিচার করা হয়।|

আমাদের নাক-চোখ-মুখ ইত্যাদির গঠন, মাথার আকৃতি, ঠোঁটের আকৃতি এমনকি চোখের মণির রঙ এগুলি সবই পূর্বপুরুষের জিনগত বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন। এই বৈশিষ্ট্যগুলিকে বিচার করেই জীববিজ্ঞানীরা বলতে পারেন আমাদের মধ্যে কাদের কাদের বৈশিষ্ট্য মিশেছে।

কিন্তু বন্ধুরা এটা তো জীববিজ্ঞানের ক্লাস নয়। তোমরা এতক্ষণে ভাবছো যে জিন-টিন নিয়ে এসব আলোচনা শুরু করলাম কেন?

এখানেই মজা। আমরা আজকে যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো তাতেই লুকিয়ে আছে এই জিনের খেলা। তবে সেটা আমরা বোঝার চেষ্টা করবো জীববিজ্ঞান দিয়ে নয়, খানিকটা নৃতত্ত্ব দিয়ে যাকে ইংরেজিতে বলে ‘Anthropology’।

হ্যাঁ, বন্ধুরা তোমরা ঠিকই ধরেছো।

আজকে আমাদের পাঠ্য বিষয় ‘বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’।

ক্লাসের মূল বিষয়ে ঢোকার আগে এই এত্তবড় গৌরচন্দ্রিকা করলাম তার একটা কারণ আছে। আজকের বাঙালি মানে ঠিক আমরা কোথা থেকে এলাম? কীভাবে আমাদের আজকের এই চেহারা পেলাম আমরা?


একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer

এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর বুঝতে গেলেই জিনের মজাটা বুঝতে হবে বন্ধুরা। এ সেই আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের জিনের মতোই ম্যাজিক জানে কিন্তু। জাতে বাঙালি। কিন্তু দেখতে কাশ্মীরীদের মতো ফর্সা-লম্বা সুঠাম চেহারা, আবার বাঙালি কিন্তু সেই মুণ্ডা-ওঁরাওদের মতো ভোঁতা নাক-মোটা ঠোঁট, কালো গায়ের রঙ ম্যাজিক নয় কি?

কীভাবে সম্ভব? তাহলে কি বাঙালির নিজস্ব কোনো পরিচয় নেই?

বাঙালির কি নিজস্ব কোনো স্বতন্ত্র শারীরিক বৈশিষ্ট্য নেই? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতেই আমরা আজ অভিযানে নামবো। চলে যাবো টাইম ট্র্যাভেল করে বাঙালি জাতির সৃষ্টির দোরগোড়ায়। চলো শুরু করা যাক আমাদের

এই অভিযান – বাঙালির উৎস সন্ধান!

যে কোনো রহস্য ভেদ করতে গেলে আমাদের দরকার কিছু সূত্র যার নিরিখে আমরা মূল উৎসে পৌঁছোতে পারি। এখানেও আমরা অনেক সূত্র পেয়েছি। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা আমাদের বলেছেন এই যে এক এক মানুষকে এক এক রকম দেখতে, তা সত্ত্বেও যদি কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠীর অংশ হয় তবে ঐ গোষ্ঠীর প্রায় সকলের মধ্যেই কিছু সাদৃশ্য থাকবেই আর সেটাই প্রধান সূত্র।

একে আমরা বলতে পারি কমন ফ্যাক্টর। এই সূত্রের নিরিখে সব বাঙালিদের আপাততভাবে বিচার করলে আমরা কী দেখি?
আমরা দেখি যে প্রচুর ভিন্নতা থাকলেও তাদের মধ্যে এই কমন ফ্যাক্টর রয়েছে কিছু কিছু যেগুলির সাহায্যে তাদের আলাদা আলাদা গোষ্ঠীতে ভেঙে ফেলা যায়।


একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল

দেখবে কারো কারো মাথা চওড়া, কারো মাথা গোল, কারো বা চ্যাপ্টা। আবার কারো চোখের মণি কালো, কারো আবার খানিক বাদামি। কারো চুল কোঁকড়ানো, কারো চুল আবার লম্বা-সোজা। কারো নাক টিকালো, কারো ভোঁতা আর গায়ের রঙের পার্থক্য তো বোঝাই যায় বাইরে থেকে একবার দেখেই।
কেউ শ্যামবর্ণ, কেউ গৌরবর্ণ, কেউ আবার পীতাভ, কারো গায়ের রঙ উজ্জ্বল বাদামি, কেউ আবার ঘন কৃষ্ণকায়।

এইরকমভাবে তোমরা খেয়াল করে দেখবে কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সাদৃশ্য পাওয়া যাবে। আর সেগুলোই আমাদের দ্বিতীয় ক্লু বা সূত্র।

চলো দেখে নিই সেই সূত্রগুলি কী কী?

১. চোখের রঙ ও বৈশিষ্ট্য
২. মাথার চুলের রঙ ও বৈশিষ্ট্য
৩. মাথার আকার
৪. নাকের আকার
৫. গায়ের রঙ
৬. দেহের উচ্চতা
৭. মুখের গড়ন
৮. রক্তের বর্গ (Blood Group)

শেষেরটা বাদ দিয়ে বাকিগুলি বাইরে থেকে দেখেই বোঝা যায়। কারো চুল কোঁকড়ানো, কারো চুল সোজা, কারো চুল আবার ঢেউ খেলানো। টেলিভিশনে দেখেছো হয়তো আফ্রিকার বাসিন্দাদের, আদিবাসীদের অমন চুল হয়, ভারতীয় আদিবাসীদেরও তাই।

এদের বলা হয় মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠী।

এদের গায়ের রঙ দেখবে কালো, মাথাটা চ্যাপ্টা ধরনের আর নাকটা দেখবে ভোঁতা ও চওড়া। আবার আর্যদের মধ্যে সোজা চুলের বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেছে। এই আর্যরা ছিল খুব ফর্সা, লম্বা, সরু-টিকালো নাকবিশিষ্ট।

ফলে এই যে সাদৃশ্য পাচ্ছি এভাবেই আমরা বিচার করে দেখবো ঠিক কে বা কারা ছিল বাঙালিদের পূর্বপুরুষ।

এখন যে কোনো এলাকার মানুষের প্রাচীনকালে কীরূপ বৈশিষ্ট্য ছিল তা কীভাবে জানা সম্ভব খুব সহজে? এটা সম্ভব সেই এলাকার আদিম অধিবাসীদের থেকে। তাদের চেহারায় থাকে ঐ অঞ্চলের মানুষের আদিম বৈশিষ্ট্য।

পরে বহু জাতির মিশ্রণে সেই বৈশিষ্ট্য থেকে সরে আসে মানুষের গড়ন। এবার চলো বন্ধুরা দেখা যাক ভারতের আদিম অধিবাসী কারা ছিল? ছবিটা দেখো।

এদের নাম আদি-অস্ত্রাল বা আদিম অস্ট্রেলীয়। এদের আরেকটা নাম হল ভেড্ডিড।

দক্ষিণ ভারতের মানুষদের চেহারার সঙ্গীদের মিল পাচ্ছো নিশ্চয়ই। যদিও পুরো ভারত জুড়েই একসময় এই নরগোষ্ঠীর লোকেরা বিচরণ করতো। এরা আকারে বেঁটে-খাটো, নাক চওড়া, ঘন কালো গায়ের রঙ, লম্বাটে মাথাবিশিষ্ট।

রাজমহল পাহাড়ে প্রত্যন্ত উপজাতিদের মধ্যে এই আদিম অস্ট্রেলীয়দের খুঁজে পাবে তোমরা। কিন্তু এখন অনেক বৈশিষ্ট্যই আর সেভাবে বুঝতে পারবে না। কেন পারবে না? এর উত্তর পরে দেবো। একটু ধৈর্য ধরতে হবে।

আরেক ধরনের মানুষ ছিল সে সময় যাদের চোখ ছিল লালচে-বাদামি রঙের, চোখের কোণে এত ভাঁজ ছিল যে চোখটা ছোটো হয়ে যেতো। এরাও আকারে বেঁটে-খাটো, গোলপানা মাথা। কোথা থেকে এলো এরা?

প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে এরা হল মোঙ্গলপ্রতিম জনধারা মানে মোঙ্গলীয়দের মতো।

মোঙ্গলীয় বলতেই নিশ্চয় তোমাদের মনে এসেছে সেই চেঙ্গিস খানের কথা।

হ্যাঁ ঠিকই ধরেছ, একেবারে চিনাদের মধ্যে বা আসামে, নাগাল্যাণ্ডে, মায়ানমারের মানুষদের মধ্যে হুবহু এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।

ছবিতে দেখো – কি মিল পাচ্ছো?

বাংলার কোচ, রাজবংশি, বাহে উপজাতিদের মধ্যে আবার চট্টগ্রামের চাক্‌মা, মগ প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এদের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এবারেই ঘটলো প্রথম ম্যাজিক, ছবি দেখো –

সেই ভেড্ডিডদের সঙ্গে এই মোঙ্গলীয়দের মিশ্রণ ঘটেছে কোনো এক সময় আর তার ফলে এখনকার মুণ্ডাভাষী লোকেদের সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ সাঁওতাল পরগণা, চাইবাসা, ঝাড়খণ্ডের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে আদিবাসীদের দেখা যায় তারা সকলের এই চেহারায় এই মিশ্রণের প্রভাব স্পষ্ট। ধীরে ধীরে আমরা রহস্যের আরো কাছে পৌঁছাচ্ছি বন্ধুরা। কী হবে শেষে? কারা হবে বাঙালির পূর্বপুরুষ?


একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

যদি বুঝতে পেরে থাকো অবশ্যই জানাও। বা অপেক্ষা করতে থাকো পরের পর্বের জন্যে, দেখো তোমাদের সঙ্গে আমাদের ভাবনা মেলে কিনা। দেখা হবে আবার পরবর্তী ক্লাসে। ততক্ষণ ছুটি। পাঠশালা বন্ধ।

পর্ব সমাপ্ত। পড়ো → দ্বিতীয় পর্ব


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –