bangalir-nritatwik-porichoy-2
Class-11

বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় – দ্বিতীয় পর্ব

বাংলাএকাদশ শ্রেণি – বাঙালির শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি (দ্বিতীয় অধ্যায়)


আশা করি বন্ধুরা বাঙালির উৎস সম্পর্কে প্রথম পর্বের আলোচনায় তোমরা দুটি গোষ্ঠীর কথা শুনেছো। প্রথমত আদি-অস্ত্রাল আর দ্বিতীয়ত মোঙ্গল-প্রতিম জনধারা।

এই মোঙ্গল-প্রতিম জনধারাকে অনেকে মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠী বলে থাকেন।

এদের মুখ ছোটো, নাক চ্যাপ্টা এবং চোখের আকৃতিও খুবই ছোটো। মোটামুটিভাবে মধ্যম উচ্চতাসম্পন্ন সোজা চুল বিশিষ্ট এই মঙ্গোলীয়দের দেখা যায় মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যাণ্ডে।

বলা হয়, এরাই আসলে বেদে বর্ণিত সেই ‘কিরাত’ সম্প্রদায়। এছাড়াও বয়েছে আরো তিনটি ভিন্ন জনগোষ্ঠী।

প্রথমে বলতে হয় দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর কথা।

রামায়ণে যে লঙ্কার রাজা রাবণের কথা পড়েছো, সেই হল দ্রাবিড় বংশীয়। রাবণের যে মূর্তি বা ছবি দেখবে তার সঙ্গে দ্রাবিড়দের অনেক মিল পাবে। খুব সহজ করে বললে, দ্রাবিড় মানে দক্ষিণ ভারতীয়।

সিনেমা যারা দেখো কমবেশি তারা নিশ্চয়ই রজনীকান্তের নাম শুনেছো বা ছবিতে দেখেছো তাঁকে। তাঁর চেহারার সঙ্গে উৎকৃষ্ট দ্রাবিড়ীয় বৈশিষ্ট্যের মিল আছে।

খেয়াল করে দেখবে বন্ধুরা, ভারতের উত্তরে আর দক্ষিণের মানুষদের মধ্যে সংস্কৃতিগতভাবে যেমন বিস্তর ফারাক, তেমনি চেহারাতেও অমিল রয়েছে।

এ নিয়ে একটা গল্প আছে, বলি তোমাদের।

ভারতের মানচিত্রে দেখবে ঠিক পশ্চিম দিক থেকে উত্তরদিকে আড়াআড়িভাবে একটা পাহাড় রয়েছে যার নাম বিন্ধ্য পর্বত। এর পরেই দক্ষিণে সমান্তরালে রয়েছে সাতপুরা পর্বত।

বলা হয়, আর্যরা যখন ভারতে আসে, তারা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ঢুকেছিল, মানে পাকিস্তান, আফগানিস্তান হয়ে কাশ্মীর হয়ে ভারতে আসার পরে যাযাবর আর্যরা আরো দক্ষিণে এগোতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের পথে বাধা ছিল এই বিন্ধ্য পর্বত। এত উঁচু ছিল এই পর্বত আগে যে আর্যদের পক্ষে তা লঙ্ঘন করে এপারে আসা অসম্ভব ছিল। ফলে বহিরাগত আর্যদের সংস্কৃতি বিন্ধ্য পর্বতের উত্তরাংশেই সীমায়িত ছিল।

সাম্রাজ্য স্থাপনের লক্ষ্যে তারা দক্ষিণ ভারতীয় দ্রাবিড়দের কাছে পৌঁছোতে পারেনি। তাই এত ফারাক।
আর্যরা আসার বহু আগে থেকেই ভারতে দ্রাবিড়দের বসবাস।

এই দ্রাবিড়দেরই আমরা ‘অনার্য’ বলে চিনি।

বহুকাল থেকে ভারতীয় সংস্কৃতিতে আর্য-অনার্যের দ্বন্দ্ব চলে আসছে। ফলে এই দুই জনগোষ্ঠীর পরিচয় জানা দরকার।
দ্রাবিড় ভাষায় যারা কথা বলেন, তাদেরকেই দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী বলা হয়ে থাকে। মাঝারি গড়নের লম্বা মাথা, ছোটো নাক ও ঘন কালো গাত্রবর্ণ বিশিষ্ট মানুষরাই দ্রাবিড় গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।

দ্রাবিড়দের চেহারার যেমন বৈশিষ্ট্য মেলে না অন্যান্যদের সঙ্গে, তেমনি খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, সংস্কৃতি সবেতেই পার্থক্য লক্ষণীয়।

দ্রাবিড় ছাড়া মধ্য এশিয়ার পার্বত্য অঞ্চল থেকে আসা আরেক জনগোষ্ঠী হল আলপীয় (Alpinoid)।

এদের গায়ের রঙ বাদামি ফর্সা, গোল মাথা, মাঝারি বা দীর্ঘ দেহযুক্ত এবং এদের চোখের মণির রঙ কালো। এদের সঙ্গে আর্যদের সাদৃশ্য খুব কাছাকাছি। কিন্তু এরা প্রকৃত আর্য নয়।


একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

অনেক নৃতত্ত্ববিদ এই আলপীয়দের শক-পামিরীয় জনধারা বলে চিহ্নিত করেছেন। মোটামুটিভাবে দেখা গেছে মধ্য এশিয়ার পারস্য-তুর্ক প্রদেশের অঞ্চলকে পামিরীয় অঞ্চল বলা হয় এবং এখান থেকে শক জাতির মানুষেরা ভারতে আসে।

দক্ষিণ ভারতে এবং পূর্ব ভারতে তারা ছড়িয়ে পড়ে। এখনকার উচ্চবর্ণের বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে এই জনগোষ্ঠীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

যে আর্যদের কথা বললাম তারা মূলত দুই ধরনের এমনই নৃতত্ত্ববিদ্‌দের মত।

উন্নত আর্যদেরকে নৃতত্ত্বের ভাষায় বলা হয় ‘নর্ডিক’। এদেরকে অনেক নৃতত্ত্ববিদ ‘ইন্দো-আর্য দীর্ঘমুণ্ড জনধারা’ বলেও চিহ্নিত করেছেন।

ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতিতে এই নর্ডিক আর্যদের বিশাল প্রভাব রয়েছে। এরাই ২০০০-১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সুদূর ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর উপকূল থেকে পায়ে হেঁটে ভারতের উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে পাঞ্জাবের পঞ্চনদীর কাছে বসতি স্থাপন করেন।

এরাই ক্রমে উত্তর ভারত জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। মনে পড়ছে নিশ্চয় জার্মানির ফ্যাসিস্ট নেতা হিটলারের মতাদর্শের কথা। হিটলার মনে করতেন জার্মানরা হল উন্নত আর্য জাতি অর্থাৎ নর্ডিক জনগোষ্ঠীর প্রতিভূ আর তাই তাদের দেশে ইহুদী ম্লেচ্ছদের থাকা চলে না।


একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer

এই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে বিশাল একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেন তিনি। এই সেই আর্যদের কথা।

বলিষ্ঠ দেহ, ফর্সা গায়ের রঙ, নাক লম্বা ইত্যাদি এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। পশুপালন ছিল আর্যদের জীবিকা।

আর্যরাই ‘বেদ’ রচনা করেন। আর্যরা আসার পরে ভারতের আদিম অধিবাসীদের তারা ‘অসুর’ বলে চিহ্নিত করে।

তাহলে আশা করি তোমরা বুঝতে পেরেছো বাঙালিদের রক্তে-চেহারায়-সংস্কৃতিতে মূলত ছয়টি জনগোষ্ঠীর প্রভাব কমবেশি পড়েছে।

১। নিগ্রোবটু বা নেগ্রিটো
২। আদি অস্ত্রাল
৩। মোঙ্গল প্রতিম
৪। আলপীয়
৫। নর্ডিক
৬। দ্রাবিড়

এই অবিরল মেলামেশার ফলে বাঙালি একটি পাঁচমিশেলি জাতে পরিণত হয়েছে। নিজস্ব একটি স্বতন্ত্র গড়ন তৈরি হয়ে গেছে বাঙালির।

বেশিরভাগ বাঙালির চেহারাই মাঝারি ধরনের – মাথার গড়ন লম্বাও নয়, গোলও নয় – নাক না লম্বা, না চ্যাপ্টা, আবার উচ্চতা খুব লম্বাও নয়, খুব বেঁটেও নয়।

ফলে বাঙালিদের মধ্যে যেমন দ্রাবিড়দের বৈশিষ্ট্য আছে, তেমনি আদি-অস্ত্রালদের বৈশিষ্ট্যও আছে। আবার আর্য বা আলপীয়দের বৈশিষ্ট্যও মিশে গেছে বাঙালিদের মধ্যে।

দেখা গেছে বাংলা ভাষায় যে সকল দেশি শব্দ রয়েছে সেগুলি আসলে সবই অস্ট্রিক ভাষার শব্দ।

এই অস্ট্রিক ভাষা আসলে কাদের ভাষা?

সেই আদি-অস্ত্রালদের।

ফলে এবার কি একটু আন্দাজ করতে পারছো কেন বাঙালিদের আদি উৎস বলা হয় আদি-অস্ত্রালদের মধ্যে রয়েছে?

আদি-অস্ত্রালরা নিজেদের বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে পারেনি।

প্রাচীনকালে পুণ্ড্র, কর্বট, বাগদি, হাড়ি, ডোম, বাউরি ইত্যাদি কৌম ছিল বাংলায়।

পরবর্তীকালে বৌদ্ধ পাল রাজবংশের শাসনকালে এসব জাতির মধ্যে পারস্পরিক মিশ্রণ ঘটে, অনুলোম-প্রতিলোম বিবাহ চালু হলে সংকর বর্ণের সৃষ্টি হয়।


একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল

ঠিক এই কারণেই এখন আর আদি-অস্ত্রালদের বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায় না। আশা করি তোমাদের উত্তর পেলে। বাঙালির উৎপত্তি ঠিক কীভাবে হল সেই বিশাল রহস্যের খানিকটা সন্ধান পেলে তোমরা।

ইতিহাস আমাদের দেখিয়ে দেয় কীভাবে ভাষা-সংস্কৃতি মানুষের জিনগত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

আগেকার দিনে রাজা-রাজড়াদের মধ্যে রেওয়াজ ছিল ভিনদেশি রাজকন্যা বিবাহ করার। রাজাদের বিয়েতে কিন্তু তখন গোত্র, বর্ণ ইত্যাদি বিচার করা হতো না।

এভাবে দেখা গেছে ভিন দেশ থেকে যে সকল নারীরা এদেশে এসেছে তারাও কিছু কিছু নতুন বৈশিষ্ট্য সংযোজন করেছে। তাছাড়া নানা সময় শক, যবন, কম্বোজ, খর, দেবল বা শাকদ্বীপী, হূণ, কর্ণাট প্রভৃতি গোষ্ঠী বাংলায় শাসন কায়েম করেছে। বেশিদিন শাসনক্ষমতায় না থাকলেও তাদের বংশবিস্তারের ফলেও কিছু কিছু নতুন বৈশিষ্ট্য সংযোজন ঘটেছে বাঙালিদের মধ্যে।

তুর্কি বিজয়ের পরে কিছু কিছু আরবি মুসলমান বাংলায় এসে বাণিজ্য করার সুবাদে বাঙালি মুসলমানদের সঙ্গে তাদের রক্তের বৈশিষ্ট্য মিলেমিশে গেছে।

আবার কোনো কোনো সময় এই বাংলাতেই মগ জলদস্যুদের প্রবল প্রতাপ ছিল। সমুদ্রতীরবর্তী বেশ কিছু জেলার মধ্যে মগ রক্তও বাঙালির রক্তপ্রবাহে মিশে আছে বলে নৃতাত্ত্বিকেরা মনে করেন।

এ থেকে এই সিদ্ধান্তে সহজেই আসা যায় যে বাঙালি আদপেই একটি সংকর জাতি। কিন্তু তার মুল বা আদি উৎস লুকিয়ে আছে আদি-অস্ত্রাল বা অস্ট্রিকদের মধ্যে।

ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেকে দেখলে পরিস্কার তা বোঝা যাবে।
খাঁখাঁ, বাখারি, বাদুড়, কানি, জাং, ঠোঁট, পাগল, বাসি, মেড়া, বোয়াল, করাত, লেবু, কলা, কামরাঙ্গা ইত্যাদি সব শব্দই আসলে অস্ট্রিক ভাষাগোষ্ঠীর শব্দ।

বাংলায় আজও আমরা কুকুরকে ডাকার সময় চু-চু বা তু-তু বলে ডাকি যে শব্দটা আসলে বাংলায় কোনো অর্থ বহন করে না ঠিকই, কিন্তু এই শব্দই আসলে অস্ট্রিক ভাষায় কুকুরের প্রতিশব্দ।

অবাক হলে তো?

সত্যিই অবাক হবার মতোই এই কথাটা। ভাষাতাত্ত্বিকেরা এভাবেই বহু দৃষ্টান্ত তুলে ধরে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে বাংলা ভাষার মধ্যে আদিম অস্ট্রিক ভাষার বহুল প্রভাব রয়েছে।

আর এই অস্ট্রিক ভাষা এসেছে আদি-অস্ত্রালদের থেকে। এভাবেই বোঝা গেল যে বাঙালির আদি উৎস আদি-অস্ত্রালদের মধ্যেই বিদ্যমান। তাহাকেই বাঙালি কয়। তারাই ছিল প্রথম এবং প্রকৃত বাঙালি।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → প্রাচীন বাংলার সমাজ ও সাহিত্য – প্রথম পর্ব

এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –