বাংলা – একাদশ শ্রেণি – ডাকাতের মা (দ্বিতীয় পর্ব)
ডাকাতের মা গল্পের আলোচনার প্রথম পর্বে আমরা আলোচনা করেছি লেখক পরিচিতি, উৎস এবং বিষয়সংক্ষেপ নিয়ে। এই পর্বে আমরা প্রথমে বিশদে সম্পূর্ণ গল্পের আলোচনা করবো এবং তারপর গল্পের বিষয়বস্তু দেখে নেব। তোমারা আগের পর্ব না পড়ে থাকলে এই লিঙ্ক ব্যবহার করে প্রথম পর্ব পড়ে নিতে পারো → ডাকাতের মা গল্পের বিষয়সংক্ষেপ।
ডাকাতের মা গল্পের বিশদে আলোচনা
সতীনাথ ভাদুড়ির এই ‘ডাকাতের মা’ গল্পের কাহিনির প্লট বা গতিপথ অত্যন্ত সরল এবং একমুখী। একটি নির্দিষ্ট সময়ে ঘটনাক্রম শুরু হয়ে দুরন্ত গতিতে এগিয়ে গেছে ক্লাইম্যাক্সের দিকে।
ডাকাত সর্দারের ছেলে সৌখী আর সৌখীর মা গল্পের দুই মুখ্য চরিত্র। এছাড়াও গল্পে অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে রয়েছে মাতাদীন পেশকার, দারোগাবাবু এবং বাসনওয়ালা।
তবে গল্পটি আবর্তিত হয়েছে সৌখীর মাকে কেন্দ্র করে। সৌখীর মায়ের মানসিক অবস্থার গতি-প্রকৃতি নিয়েই গল্পটি এগিয়ে গেছে। সেদিক দিয়ে বিচার করতে গেলে ‘ডাকাতের মা’ গল্পে সৌখীর মা প্রধান চরিত্র। গল্পের নামকরণের মধ্যেও সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট।
গল্পের শুরুতেই দেখা যায় সৌখীর বাবার আমল থেকে এখনকার সময়ের ডাকাত দলের সদস্যদের তুলনা, বর্তমান সময়ের ন্যায়-নীতির আলোচনা, সৌখীর জেল থেকে ফিরে আসার পর সন্তানের প্রতি বাৎসল্যবশত মধ্যরাত্রে ঘটি চুরি করা ইত্যাদি সব ঘটনাতেই সৌখীর মায়ের হৃদয়ের অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। সৌখীর মা-ই আবার এই গল্পে সমস্ত ‘doing’ ও ‘suffering’-এর মূল কেন্দ্রে রয়েছে। অর্থাভাবে সৌখীর মাকে যেমন খই-মুড়ি বিক্রি করে অন্নকষ্ট দূর করতে হয়েছে, তেমনি বাধ্য হয়ে সৌখীর মাকেই তাঁর নাতি ও বৌমাকে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হয়েছে।
এতদিন পরে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিল সৌখী, কিন্তু শুধু অর্থাভাবের কারণেই সৌখীর প্রিয় আলু-চচ্চড়ি করে খাওয়াতে পারেনি সৌখীর মা। সবথেকে বড়ো ব্যাপার হল ডাকাত পরিবারের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও সামান্য ছিঁচকে চুরির অপবাদে সৌখীর মায়ের একটি ভুলের কারণে সেইদিন রাত্রেই সৌখীকে আবার থানায় যেতে হয়। ছেলে জেলে গেলে তাঁর অহংবোধ হতো ঠিকই, কিন্তু তা ডাকাতির কারণে। ডাকাত হয়ে চুরির অপবাদে জেলে যাওয়ার যে গ্লানি তা আজীবন সৌখীর মাকে দগ্ধ করবে। নিজের অপারগতা তাঁকে আরো বেশি ক্ষত-বিক্ষত করে তোলে।
ফলে সৌখীর মা যেমন এই গল্পে ‘doer’, ঠিক তেমনি তিনিই এই গল্পে একমাত্র ‘suffer’ও বটে।
একটি ডাকাত পরিবারের জীবন-যাপন, মূল্যবোধ, মানসিকতা ইত্যাদিকে ঘিরে এই গল্পটি কেন্দ্রীভূত হয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি অখ্যাত ছোটোগল্প ‘চোর’-এর মতো এই গল্পেও দেখা যায় ডাকাতের খলনায়কত্ব দূরে সরিয়ে চাঁদের অন্য পিঠে আলো ফেলেছেন সতীনাথ ভাদুড়ী। সাধারণের চোখে চোর-ডাকাত বৃত্তির মানুষ পরিত্যাজ্য। কিন্তু তাদের মনের মধ্যেও যে মানবিকতার প্রদীপটি এখনো নিভে যায়নি, ডাকাত হলেও তারা যে নিজস্ব একপ্রকার মূল্যবোধে বিশ্বাস করে, ডাকাত হলেও মানবিক বৃত্তিগুলি – দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য অটুট থাকে হৃদয়ে তা এই গল্পের মধ্যে দিয়েই ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি।
সৌখীর মায়ের মনে সৌখীকে দেখে জেগে ওঠা বাৎসল্যের জোয়ার যে চিরন্তন, বাৎসল্যের কোনো জাত-ধর্ম-সম্প্রদায় হয় না। মাতৃত্ববোধের অপার মাহাত্ম্যে সৌখীর মা এই গল্পে উজ্জ্বলরূপে প্রতিভাত হয়ে উঠেছেন। ডাকাত সর্দার বেঁচে থাকাকালীন সৌখীর মায়ের পরিচয় ছিল ডাকাতের বউ হিসেবে।
সর্দারের মৃত্যুর পরে তিনি পরিচিত হন ‘ডাকাতের মা’ নামে।
সৌখীর বাবার আমলে ডাকাত দলের সদস্যরা প্রচণ্ড অনুগত ছিল, কিন্তু সৌখীর বাবা মারা যাওয়ার পরে তাদের চরিত্রে বদল ঘটেছে। সৌখী জেলে যাওয়ার পর কয়েক মাস তারা সৌখীর মাকে টাকা পাঠালেও পরে আর দিতে আসতো না। এই ঘটনায় সৌখীর মা অত্যন্ত ব্যথিতচিত্তে মনে করেন এখনকার সদস্যদের মূল্যবোধ, দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কথা।
ডাকাত হলেও তাদের মধ্যেও যে দায়িত্বজ্ঞান, কর্তব্যবোধ কিংবা বিশ্বস্ততা থাকা দরকার, তা মনে করিয়ে দেন সৌখীর মা। সৌখীর মা কখনোই ডাকাতিকে খারাপ কাজ বলে মনে করেন না, অন্যায় বলে ঘৃণার চোখে তিনি এই পেশাকে কখনোই দেখেননি, বরং তিনি মনে করেন ‘ডাকাতি করা তার স্বামী-পুত্রের হকের পেশা’।
সমর্থ পুরুষের হকের পেশা এই ডাকাতি সৌখীর মায়ের গর্বের কারণ। ডাকাত পরিবারের মূল্যবোধের যে পরিচয় লেখক আমাদের সামনে তুলে ধরেন, তা সত্যই চমকপ্রদ। সৌখীর দলের লোকেদের টাকা না দিয়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ সৌখী যখন বলেন –
ন্যায় অন্যায় কর্তব্য অকর্তব্যের পাট কি একেবারেই উঠে গেল দুনিয়া থেকে__?
ডাকাতের মায়ের মুখে এই উক্তি শুনে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে সত্যই আশ্চর্য লাগে। সৌখীর মা মনে করে না যে ডাকাতি একটা অন্যায় কাজ। অন্যদিকে ডাকাত দলের কেউ যখন জেলে বন্দি থাকে, তখন অন্য সদস্যদের টাকা দিতে না আসাকেই তিনি অন্যায় বলে মনে করেন।
তাঁর কাছে চুরি করা যতটা নীচ কাজ, ডাকাতি করা একেবারেই সেই রকম নয়। গল্পে দেখা যায়, প্রথম কিছুদিন ডাকাত দলের যে সদস্য তাঁকে টাকা দিতে আসতো, তার ছিঁচকে চোরের মতো চেহারাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে তাকে ডাকাত দলের যোগ্য মনে করেনি সৌখীর মা। সৌখীও জেলের চোর কয়েদিদের সঙ্গে কথাই বলতো না।
সৌখীর পরিবার বংশ পরম্পরাগতভাবে সাধারণ মূল্যবোধের নিরিখে একটি অপরাধমূলক কাজকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। তবু ডাকাতের মা হলেও সৌখীর মায়ের মধ্যেও রয়েছে মাতৃত্বের টান, রয়েছে ভালোবাসা, রয়েছে পুত্রের প্রতি তাঁর কর্তব্যবোধ। কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায় তা যেমন আপেক্ষিক, তেমনি এই গল্পেও লেখক দেখিয়েছেন সাধারণ মানুষের চোখে অন্যায়কারী সেই ডাকাত পরিবারের সৌখীর মা পরিস্থিতির সাপেক্ষে ন্যায়সঙ্গত কাজই করেছেন। তাঁর একমাত্র ছেলে জেল থেকে ফিরে এসেছে এবং সকালে তাঁকে কিছু খেতে দেওয়ার জন্য আকুল হয়ে ওঠা সৌখীর মায়ের মধ্যে প্রকৃতই ন্যায়পরায়ণতা রয়েছে। তা না হলে সে শুধু খাবার তৈরি করবে বলে চুরি করার সিদ্ধান্ত তিনি নিতেন না।
সৌখীর বাবার নামে সারা পাড়া কাঁপতো, দারোগাবাবু কখনও তাঁকে তুই-তোকারি করার সাহস পায়নি। চৌকিদার সাহেবও তাঁকে সমঝে চলেন। সেই পরিবারের সদস্যদের আজ চরম অনটনে, দারিদ্র্যে কাটাতে হচ্ছে। ডাকাত দলের সদস্যরাও আর আগের মতো মাসে মাসে টাকা দিয়ে যায় না।
একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল
সৌখীর দ্বিতীয় স্ত্রী প্রথম থেকেই বেশ রুগ্ন ছিল এবং পরে ছেলে হওয়ার কারণে আরো শরীর ভেঙে গেছে তার। এমতাবস্থায় তার পক্ষে গায়ে-গতরে খেটে উপার্জন করা সম্ভব নয়। ফলে সংসারে অভাবিতভাবে নেমে আসা দূর্যোগ থেকে বাঁচতে সৌখীর মা বাধ্য হয়ে সৌখীর বউ আর ছেলেকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল যাতে বাপের বাড়িতে গরুর দুধের যোগান ভালো থাকায় তা খেয়ে-দেয়ে শরীর স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পারে। ডাকাত সর্দারের একমাত্র ছেলেকে নিয়ে তাই সৌখীর মা বলেন –
কী কপাল নিয়ে এসেছিল
প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেল সৌখী জেলে গেছে। সৌখীর মায়ের রাতে এমনিতেই ঘুম হয় না ঠাণ্ডায়। পুরনো কম্বলের শতচ্ছিন্ন অবস্থা, ঠাণ্ডা মানে না। কম্বলমুড়ি দিয়ে শুতে বারণ করেছিল সৌখী। বিগত কয়েক বছরে তাঁকে বকুনি দেওয়ার, ধমক দেওয়ার মতো একমাত্র সৌখীও তাঁর পাশে নেই। নিজের ছেলের এই অভাববোধ সৌখীর মাকে তাড়িত করে।
সৌখীর মা নিরক্ষর, অর্থনৈতিকভাবে পরাধীন, প্রৌঢ়া ও বিধবা মহিলা যিনি পুরুষতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। তাই ছেলের হাতে মার খাওয়া বা ধমক খাওয়াকে তিনি অপমানের বলে মনে করেন না। বরং বেশ কয়েক বছর যাবৎ বকুনি বা ধমক না খাওয়ায় তিনি বিচলিত। ছেলের অনুপস্থিতিতে ছেলের প্রতি সৌখীর মায়ের আস্থা ও শ্রদ্ধা দুইই বেড়েছে।
এই প্রসঙ্গেই ডাকাত সর্দার সৌখীর মায়ের খেদোক্তি শোনা যায় গল্পে –
এ কি কম দুঃখের কথা
বাড়িতে তাই কেউই নেই, এক সৌখীর মা ছাড়া। এমনই এক শীতের রাত্রে কম্বল মুড়ি দিয়ে কোনোক্রমে ঘুমাবার চেষ্টা করছিল সৌখীর মা। হঠাৎই বাড়ির উঠোনে নোনা আতা গাছের নীচে শুকনো পাতার খড়খড় শব্দ শুনে সচকিত হয়ে ওঠেন তিনি। ঘুম ভেঙে যায় তাঁর। ঠিক তার কিছুক্ষণ পরেই একটা টিকটিকি টিক টিক শব্দ করে ডেকে ওঠে। আর তখনই সৌখীর মায়ের মনে হয় –
হাতি পাঁকে পড়লে ব্যাঙেও লাথি মারে
এটা একটা বাংলা প্রবাদ যার অর্থ হল বিপাকে পড়লে অক্ষমেরাও ক্ষমতাবানদের বিদ্রুপ করে। একে সৌখীর মায়ের কাছে নেই তাঁর ছেলে। তার উপর বৌমা আর নাতিকেও তিনি বাধ্য হয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন বাপের বাড়িতে। এমতাবস্থায় সৌখীর মায়ের মনে হয় যেন টিকটিকিটাও তাঁর সঙ্গে মশকরা করছে।
কিছুক্ষণ পরেই তিনি আশ্বস্ত হন যে তাঁর ছেলে সৌখী জেল থেকে ফিরে এসেছে। ঘরে ঢুকেই ঘর ফাঁকা দেখে প্রথমেই সৌখীর মনে পড়ে বউ আর ছেলেটার কথা। মেয়াদ শেষের আগেই সে বাড়ি ফিরে এসেছে।
একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer
কিন্তু সে তো আর জানে না পরিবারের অসচ্ছলতার কথা। সন্তানের প্রতি সৌখীর প্রবল টান। আর তাই ঘরে ফিরেই সে তাঁর ছেলের খোঁজ করতে থাকে। বউ আর ছেলেকে ছেড়ে সৌখী যে এক মুহূর্তও থাকতে পারে না সে কথা সৌখীর মা ভালোভাবেই জানেন। তাই তিনি প্রথমেই সৌখীকে কিছু বলেননি। আপন সন্তানকে বহুদিন পরে কাছে পেয়ে, সাময়িক সন্তানসুখটুকু কোনোভাবেই হারাতে চাননি তিনি। সৌখী তাঁর বাবার মতোই অল্পেই রেগে যায়।
তাই যদি আসল ঘটনা জেনে এখনই যাতে বউ আর ছেলেকে আনার জন্য সৌখী বেরিয়ে না পড়ে, তাই সবটাই গোপন রেখে তার বউ ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে এ কথা বলে সৌখীর মন ভোলাতে চান তিনি।
মা হিসেবে এ যেন তাঁর দ্বৈত সংকট।
আর তাই সৌখী যখন বাড়ি ফিরে তাঁর বৌ আর ছেলেকে দেখত না পেয়ে জিজ্ঞাসা করে যে তারা কোথায় আছে, তখন সৌখীর মায়ের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে লেখক সতীনাথ ভাদুড়ী বর্ণনা দেন –
প্রতি মুহূর্তে বুড়ি এই প্রশ্নের ভয়ই_ _করছিল
বহুদিন পরে ছেলেকে কাছে পেয়ে আনন্দ হলেও সৌখীর মায়ের মনে দেখা দেয় নতুন দুর্ভাবনা। একে পুরনো কম্বলে তার ঘুম আসছিল না ঠাণ্ডায়, তার উপর পরদিন সকালে উঠে ছেলেকে কী খেতে দেবে সেই চিন্তা তাঁকে আরো অস্বস্তিতে ফেললো।
রাত্রে কোনোরকমে খই-মুড়ি খেয়ে সৌখী ঘুমিয়ে পড়েছে। সৌখীর মা চিন্তা করে সৌখী ফিরে এসে হঠাৎ যদি ভাত আর আলুচ্চচড়ি খেতে চাইতো, কীভাবে তিনি সেই খাবারের বন্দোবস্ত করতেন! সৌখীর বড়ো প্রিয় আলুচচ্চড়ি রান্না করার জন্য চাল, আলু আর সরষের তেল কেনা দরকার।
বাড়িতে একেবারেই কিছু নেই আর কেনার মতো পয়সাও তার হাতে নেই। এদিকে সৌখী সদ্য ফিরে এসেছে বলে তার থেকে চাইতেও পারছে না সৌখীর মা।
কীভাবে তিনি এই সমস্যার সমাধান করবেন তা বুঝতে পারেন না।
এই সময় মাতাদীন পেশকারের কথা তাঁর মাথায় আসে এবং অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই সমস্যার একমাত্র সমাধান হিসেবে মাতাদীন পেশকারের বাড়িতে চুরির সিদ্ধান্ত নেন সৌখীর মা।
মধ্যরাত্রে মাতাদীন পেশকারের বাড়ির দিকে রওনা দেন তিনি। তাঁর বাড়ির সামনে সদ্য একটা পাঁচিল তোলা হয়েছে। সেই পাঁচিল টপকে ভিতরে ঢুকে পড়েন সৌখীর মা আর তারপর পেশকার সাহেবের অতি প্রিয় পিতলের লোটাটি চুরি করে ভোরবেলা তা এক বাসন-বিক্রেতার কাছে নগদ চোদ্দো আনা পয়সায় বিক্রি করে তা দিয়ে জিনিসপত্র কেনাকাটা করেন তিনি।
চুরির সূত্র ধরে সকালেই পেশকার সাহেব সৌখীর বাড়িতে এসে হাজির হয় বাসনওয়ালা আর পুলিশের দারোগাকে সঙ্গে করে। এর আগেও বহুবার তাদের বাড়িতে পুলিশ এসেছে, কিন্তু এইবারে –
দারোগা পুলিশ দেখে বুড়ির বুক কেঁপে ওঠে।
ডাকাতির কিনারা করতে তাদের বাড়িতে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র আছে কিনা তা পরীক্ষা করতে আগেও পুলিশ হানা দিয়েছে সৌখীদের বাড়িতে, তল্লাশিও চালিয়েছে। এতদিন সাহসে ভর করে সৌখীর মা রুখে দাঁড়িয়েছিল। স্বামী-পুত্রের ডাকাতি করা নিয়ে গর্ব ছিল তাঁর মনে। কিন্তু আজ তো সে নিজেই সামান্য চুরির অপবাদে দুষ্ট।
যে কিনা একদিন ডাকাত সর্দারের স্ত্রী, ডাকাতের মায়ের পরিচয়ে গর্ব করে চলতে পারতো, তাকেই আজকে বাধ্য হয়ে পরিস্থিতির ফেরে চোরের পরিচয় পেতে হচ্ছে। সামান্য একটা লোটা চুরি করেছে বলে তাঁকে আজ পুলিশ ধরে নিয়ে যেতে এসেছে।
একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি
স্বামী আর পুত্রের সম্মান সম্পূর্ণ ধুলোয় লুটিয়ে দিলেন তিনি। আর ঠিক এই কারণেই বাড়িতে দারোগা-পুলিশ দেখামাত্রই তাঁর বুক ভয়ে কেঁপে উঠেছিল।
ইতিমধ্যে বাইরে হৈ-হট্টগোল শুনে সৌখী ঘুম থেকে উঠে বাইরে এসে সমস্ত ঘটনা দেখে পূর্বাপর বুঝে ফেলে। দারোগা সাহেব যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করে যে সে এই বাসনওয়ালার কাছে চুরি করা লোটাটা বিক্রি করেছে কিনা,
সৌখীর মা নিরুত্তর হয়ে এক পলক সৌখীর দিকে তাকিয়ে মাথা হেঁট করে থাকে।
সৌখী স্পষ্ট বুঝে যায় চরম অভাবের তাড়নায় তাঁর মা এমন ঘৃণ্য কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। এদিকে সৌখী জেলে ঠিকাদারের কাছে কাজ করে নব্বই টাকা পেয়েছিল যা সে জমিয়ে রেখেছিল এতদিন। মা চাইলে তাঁকে সে এমনিই দিতে পারতো টাকাটা। কিন্তু তা সৌখীর মা করেনি। আর এ প্রসঙ্গেই সৌখী বলে ওঠে –
মেয়েমানুষের আর কত আক্কেল হবে?
সৌখীও তার মাকে ভালোবাসে। সে পুরুষ হয়ে বেঁচে থাকতে তার মাকে জেলে যেতে হবে চুরির দায়ে, তা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। তাই মায়ের অপরাধের দায় নিজের কাঁধে নিয়ে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে সৌখী।
পুলিশ চুরির দায়ে সৌখীকে আবার থানায় নিয়ে চলে যায়। মাত্র আগের রাতেই সে বাড়ি ফিরেছিল, রাতে খাওয়াটুকু ঠিক করে খায়নি। সকালে একটু ভালো করে খাওয়াবে বলে তাঁর মা বাধ্য হয়ে চুরি করে সব ব্যবস্থা করলো ঠিকই, কিন্তু সৌখীকে আর খাওয়ানো হল না তাঁর মায়ের।
পুলিশ সৌখীকে হাতকড়া পরালে তাঁর মা নিজের দোষ স্বীকার করে ঠিকই, কিন্তু কেউই তাঁর কথায় আমল দেয় না। সামান্য ছিঁচকে চুরির দায়ে সৌখীকে জেলে যেতে হচ্ছে এ যেন তার চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করার সামিল। ডাকাত সর্দার হিসেবে এককালে সৌখীর এত অহংকার ও দাপট ছিল যে জেলে থাকাকালীন ছোটোখাটো অপরাধীদের সঙ্গে সে কথাও বলতো না। আর আজ তার এই অহংকার চূর্ণ হয়ে গেল। ছেলের ভাবমূর্তির এমন বিনষ্টি দেখে সৌখীর মায়ের মনে হয় –
ছেলের নামে কলঙ্ক এনেছে সে!
আর এই কলঙ্ক অপবাদের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে কান্নায় ভেঙে পড়ে সৌখীর মা।
ডাকাতের মা গল্পের বিষয়বস্তু
সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘ডাকাতের মা’ গল্পে সৌখীর মায়ের মাতৃত্ববোধের এক অনবদ্য পরিচয় পাওয়া যায়। সৌখীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের টানা-পোড়েন নিয়েই গল্প এগিয়েছে। গল্পের কেন্দ্রে রয়েছেন সৌখীর মা।
অপরাধের জগতে থাকা একটি পরিবারের মূল্যবোধ এবং ন্যায়পরায়ণতার এক অন্য আখ্যান রচনা করেছেন লেখক। সৌখীর ফিরে আসার পরে পরম মাতৃসুলভ মমতায় ছেলেকে কিছু ভালো রেঁধে খাওয়ানোর ইচ্ছেতে মরিয়া হয়ে চুরি করতেও পিছপা হননি সৌখীর মা।
সন্তানকে বাঁচানোর জন্য তাঁর মা সবকিছুই করতে পারেন। জীবকুলের প্রতিটি জীবেরই একই ধর্ম। মানুষও তাঁর ব্যতিক্রম নয়। ডাকাতের মা এখানে মাতৃত্ববোধের প্রতীক যা এক সার্বজনীন অনুভূতি। ডাকাত হলেও তাঁদের মধ্যেকার যে মানবীয় বৃত্তিগুলি তা যে নষ্ট হয় না, এ গল্প আমাদের সেই ইঙ্গিতই দেয়।
আরেকটি বিষয় এ গল্পে লক্ষণীয়।
ডাকাত পরিবারটির আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোয় পুরুষতান্ত্রিকতা মর্মে মর্মে লেগে রয়েছে। এমনকি সৌখীর মা একজন নারী হয়েও পুরুষের অধীনতাকেই গর্ববোধ সহকারে মেনে নিয়েছেন।
পুরুষ হিসেবে স্বামী-পুত্রের ডাকাতিকে তিনি সাহসিকতার পরিচায়ক হিসেবে দেখতে চান। কথা না শোনার জন্য ছেলে সৌখী তাঁকে মেরেওছে বারকয়েক, কিন্তু তবু তিনি মায়ের পরিচয়েই তাঁকে স্নেহ করেছেন।
এছাড়াও আরো অনেকক্ষেত্রেই ‘মেয়েমানুষের আক্কেল’ এই জাতীয় শব্দবন্ধ ব্যবহার করে লেখক এই পরিবারটির মানসিকতাকে আরো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেছেন।
সব মিলিয়ে ‘ডাকাতের মা’ গল্পটি সৌখীর মায়ের অপার বাৎসল্যবোধের কাহিনিমাত্র।
সমাপ্ত। আরো পড়ো → দ্বীপান্তরের বন্দিনী গল্পের বিষয়বস্তু
লেখক পরিচিতিঃ
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
XI-Ben-Dakater-ma-part-1