jatiyo-aay
Class-11

জাতীয় আয় | National Income

Economicsএকাদশ শ্রেণি – সমষ্টিগত অর্থনীতির প্রধান ধারণাসমূহ


আগের পর্বে আমরা দাম কিভাবে চাহিদা জোগানের ঘাত প্রতিঘাতে নির্ধারিত হয় তা দেখেছি। এই পর্বে আমরা সমষ্টিগত অর্থনীতির প্রধান ধারণাগুলি সম্পর্কে আলোচনা করবো।

সমষ্টিগত অর্থনীতির প্রধান ধারণাগুলির মধ্যে আমরা জাতীয় আয় কাকে বলে এবং জাতীয় আয় সম্পর্কিত বিভিন্ন ধারণাগুলির সম্বন্ধে আজ বুঝে নেব।

জাতীয় আয়ের (National Income or NI) সংজ্ঞা

জাতীয় আয় হল সমগ্র দেশের এক বছরের সামগ্রিক আয়।

কোন এক নির্দিষ্ট বছরে সারা দেশের জনসাধারণ অর্থনৈতিক কাজকর্মের মাধ্যমে যে সেবা ও দ্রব্য উৎপাদন করে তার অর্থ মূল্যকেই জাতীয় আয় বলা হয়।

অর্থাৎ, কোন দেশের উৎপাদনের উপাদানগুলিকে কাজে লাগিয়ে দেশের সকল অধিবাসী কোন নির্দিষ্ট সময়ে, (সাধারণত এক বছরে) যে পরিমাণ দ্রব্য ও সেবা সৃষ্টি করে তার অর্থ মূল্যের সমষ্টিকে জাতীয় আয় বলে।

সমাজে যে সকল ব্যাক্তি বা সংস্থা অর্থনৈতিক দ্রব্য বা সেবা বিক্রির মাধ্যমে আয় করে তাদের উপার্জনকারী একক বলা হয়।

উপার্জনকারী এককগুলি বিভিন্নভাবে রোজগার করে। যেমন মজুরি, বেতন, মুনাফা, সুদ ইত্যাদি। এই উপার্জনগুলির যোগফল থেকেও জাতীয় আয় নির্ণয় সম্ভব।

স্থুল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (Gross Domestic Product or GDP)

একটি নির্দিষ্ট সময়ে (সাধারণত এক বছর) কোন নির্দিষ্ট দেশের জাতীয় সীমানার মধ্যে যে পরিমাণ দ্রব্য ও সেবা সৃষ্টি হয় তার অর্থমূল্যের যোগফলকে স্থুল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বলা হয়।
স্থুল অভ্যন্তরীণ উৎপাদনকে দুই ভাবে পরিমাপ করা যায়।

বাজার মূল্যে স্থুল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন এবং উপাদানমূল্যে স্থুল জাতীয় উৎপাদন।

বাজারমূল্যে স্থুল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন

বর্তমান বাজার মূল্যে উৎপাদিত দ্রব্য ও সেবার মূল্য হিসাব করলে সেই হিসাবকে বাজার মূল্যে স্থুল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বলে। এটিকে GDPmp বলে চিহ্নিত করা হয়।

উপাদান মূল্যে স্থুল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন

বিভিন্ন উপাদানের মালিক যে উপাদান মূল্য উপার্জন করে সেই উপার্জনগুলির যোগফলকে উপাদান মূল্যে স্থুল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বলা হয়। যেমন, উপদান মূল্য হল মজুরি, সুদ, খাজনা এবং মুনাফা ইত্যাদি। এটিকে GDPfc বলে চিহ্নিত করা হয়।

বাজার মূল্যে GDPmp এর থেকে পরোক্ষ কর বিয়োগ করলে এবং ভর্তুকি যোগ করলে উপাদান মূল্যে GDPfc পাওয়া যায়
GDPfc = GDPmp – পরোক্ষ কর + ভর্তুকি

নিট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (Net Domestic Product or NNP)

নিট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনও দুই রকমভাবে পরিমাপ করা যায়। বাজার মূল্যে এবং উপাদান মূল্যে।

বাজার মূল্যে নিট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন

কোন নির্দিষ্ট দেশের স্থুল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে মূলধনের অপচয় ব্যয় (মূলধন ব্যবহারের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় বাবদ খরচ) কে বাদ দিলে আমরা সেই দেশের নিট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন পাই। নিট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনকে বাজার মূল্যে প্রকাশ করা হলে সেটিকে বাজার মূল্যে NDP বলা হয়। এটিকে আমরা NDPmp বলে চিহ্নিত করা হয়।

বাজার মূল্যে নিট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (NDPmp) = বাজার মূল্যে স্থুল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (GDPmp) – অপচয় ব্যয়

উপাদান মূল্যে নিট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন

উপাদান মূল্যে স্থুল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে মূলধনের অপচয় ব্যয় বিয়োগ করলে উপাদান মূল্যে নিট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন পাওয়া যায়। এটিকে NDPfc বলে চিহ্নিত করা হয়।

NDPfc = GDPfc – মূলধনের অপচয় ব্যয়

এছাড়াও জাতীয় আয়ের ভিত্তিতে আমরা NDPfc এর পরিমাপ করতে পারি।

NDPfc = মজুরি + বেতন + খাজনা + সুদ + মুনাফা + মিশ্র আয়


একাদশ শ্রেণি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer

স্থুল জাতীয় উৎপাদন (Gross National Product or GNP)

একটি নির্দিষ্ট বছরে দেশের ভিতরে ও বাইরে বসবাস করা সকল অধিবাসীদের দ্বারা উৎপাদিত দ্রব্য ও সেবার অর্থমূল্যকে যোগ করলে আমরা সেই দেশের স্থুল জাতীয় উৎপাদন পাই।

স্থুল জাতীয় উৎপাদনকেও দুইভাবে প্রকাশ করা যায়।

1. বাজার মূল্যে স্থুল জাতীয় উৎপাদন

বর্তমান বাজার মূল্যে স্থুল জাতীয় উৎপাদনের পরিমাপ করা হলে তাকে বাজার মূল্যে স্থুল জাতীয় উৎপাদন বলা হয়। এটিকে GNPmp হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।

উপাদান মূল্যে স্থুল জাতীয় উৎপাদন

নির্দিষ্ট বছরে কোন দেশের নাগরিকবৃন্দ যে পরিমাণ দ্রব্য বা সেবা সৃষ্ট করে তার উপাদান মূল্যের যোগফলকে উপাদান মূল্যে স্থুল জাতীয় উৎপাদন বলা হয়। এটিকে GNPfc বলে চিহ্নিত করা হয়।

এছাড়াও GNPmp থেকে পরোক্ষ করকে বিয়োগ ও ভর্তুকিকে যোগ করলে আমরা GNPfc পাই।
GNPfc = GDPmp – পরোক্ষ কর + ভর্তুকি

নিট জাতীয় উৎপাদন (Net National Product or NNP)

কোন নির্দিষ্ট দেশের স্থুল জাতীয় উৎপাদন থেকে মূলধনের অপচয় বাবদ ব্যয়কে বিয়োগ করা হলে আমরা নিট জাতীয় উৎপাদন পাই। এটিকে সাধারণত NNP বলে চিহ্নিত করা হয়।

নিট জাতীয় উৎপাদন = স্থুল জাতীয় উৎপাদন – মূলধনের অপচয় ব্যয়

এটিকেও আমরা দুইভাবে পরিমাপ করতে পারি বাজার মূল্যে এবং উপাদান মূল্যে।

বাজার মূল্যে নিট জাতীয় উৎপাদন

বাজার মূল্যে স্থুল জাতীয় উৎপাদন থেকে মূলধনের অপচয় ব্যয়কে বাদ দিলে বাজার মূল্যে নিট জাতীয় উৎপাদন পাওয়া যায়। এটিকে NNPmp বলে চিহ্নিত করা হয়।

NNPmp = GNPmp – মূলধনের অপচয় ব্যয়

উপাদান মূল্যে নিট জাতীয় উৎপাদন

উপাদান মূল্যে জাতীয় আয় থেকে মূলধনের অপচয় ব্যয় বিয়োগ করলে উপাদান মূল্যে নিট জাতীয় উৎপাদন পাওয়া যায়। এটিকে NNPfc বলে চিহ্নিত করা হয়।

NNPfc = GNPfc – মূলধনের অপচয় ব্যয়

আবার, NNPmp থেকে পরোক্ষ কর বিয়োগ করলে এবং একইসাথে ভর্তুকিকে যোগ করলে NNPfc পাওয়া যায়।

NNPfc = NNPmp – পরোক্ষ কর + ভর্তুকি

এছাড়াও উপাদান মূল্যে নিট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের সাথে বিদেশ থেকে প্রাপ্ত নিট আয়কে যোগ করলেও NNPfc পাওয়া যায়।

NNPfc = NDPfc + বিদেশ থেকে প্রাপ্ত নিট আয়

স্থুল জাতীয় উৎপাদন এবং স্থুল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন এদের মধ্যে পার্থক্য

সাধারণত একটি নির্দিষ্ট বছরে কোন দেশের জাতীয় সীমানার অভ্যন্তরে যে সকল অধিবাসী বাস করে তাদের দ্বারা সৃষ্ট দ্রব্য ও সেবার অর্থমূল্যকে যোগ করা হলে স্থুল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন পাওয়া যায়।

কিন্তু, বিদেশেও অনেক দেশের নাগরিক বসবাস করে এবং তাদের দ্বারা উৎপাদিত দ্রব্য বা সেবার অর্থমূল্য বা তারা নিজেদের মূলধনকে কাজে লাগিয়ে সুদ উপার্জন করে তার মূল্য কিন্তু স্থুল অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে (GDP) যুক্ত করা হয় না।

আবার GNP থেকে বিদেশ থেকে প্রাপ্ত নিট আয়কে বিয়োগ করলে GDP পাওয়া যায়।
GDP = GNP – বিদেশ থেকে পাওয়া নিট আয়

আবার, GDP এর সাথে কোন দেশের বিদেশ থেকে পাওয়া নিট আয়কে যুক্ত করলে আমরা স্থুল জাতীয় উৎপাদন পাব।

দেশীয় উপাদানগুলি বিদেশ থেকে যে আয় করে, সেই আয় থেকে স্বদেশে কর্মরত বিদেশিদের আয়কে বাদ দিলে যে আয় পাওয়া যায় তাকে নিট আয় বলে।

GNP = GDP + বিদেশ থেকে পাওয়া নিট আয়


একাদশ শ্রেণি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

জাতীয় আয় পরিমাপের পদ্ধতি

জাতীয় আয়কে তিনটি পদ্ধতিতে পরিমাপ করা যায়।
(ক) উৎপাদন পদ্ধতি
(খ) আয় পদ্ধতি
(গ) ভোগ ও সঞ্চয় পদ্ধতি

(ক) উৎপাদন পদ্ধতি

এই পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট বছরে উৎপাদিত দ্রব্য ও সেবার অর্থমূল্যকে যোগ করলে জাতীয় আয় পাওয়া যায়। এই পদ্ধতিকে আবার মূল্য সংযোজন পদ্ধতিও বলা হয়।

একটি নির্দিষ্ট বছরে যে সমস্ত দ্রব্য উৎপাদিত হয় তার অনেক দ্রব্যই অপর দ্রব্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। যেসব দ্রব্য অন্য দ্রব্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয় তাদের অন্তর্বর্তী বা মধ্যবর্তী দ্রব্য বলা হয়।

উৎপাদন পদ্ধতিতে জাতীয় আয় নির্ণয়ে দুইবার গণনা সম্বন্ধীয় দোষের সৃষ্টি হয়, এই কারনেই সাধারণত সর্বশেষ উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্যই হিসাব করা হয় এবং অন্তর্বর্তী দ্রব্যগুলির মূল্য আলাদা করে হিসাব করা হয় না কারণ ওই দ্রব্যগুলির মূল্য সর্বশেষ উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্যের মধ্যে অন্তর্নিহিত থাকে।

একটি উদাহরণের মাধ্যমে এটিকে বোঝা যেতে পারে।

ধরা যাক, ময়দা হল সর্বশেষ দ্রব্য। ময়দার অন্তর্বর্তী দ্রব্যটি হল গম।
এবার ধরা যাক, গমের ক্রয়মূল্য 18 টাকা এবং ময়দার বিক্রয়মূল্য 28 টাকা।
এবার এখানে মূল্য সংযোজন পদ্ধতিতে মোট মূল্য হবে [18+(28-18)]=18+10=28 টাকা, যা সর্বশেষ দ্রব্য ময়দার বিক্রয়মূল্যের সমান।

এখন যদি গম এবং ময়দা দুটি দ্রব্যের মূল্য যোগ করা হত (18+28)=46 টাকা যা মূল্য সংযোজনের মূল্য থেকে অনেক বেশি এবং এটিতে দুইবার গণনা সম্বন্ধীয় দোষেরও উদ্ভব হত যার ফলে সঠিক জাতীয় আয় নির্ণয় সম্ভব হত না।

(খ) আয় পদ্ধতি

এই পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট বছরে উপাদানগুলির আয়কে ( যেমন মুনাফা, সুদ, মজুরি ইত্যাদি) যোগ করলে জাতীয় আয় পাওয়া যায়।

(গ) ভোগ ও সঞ্চয় পদ্ধতি

এই পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট বছরে কোন দেশের মোট ভোগ ব্যয় ও মোট সঞ্চয়কে যোগ করলে জাতীয় আয় পাওয়া যায়।

পর্ব সমাপ্ত।


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখিকা পরিচিতি

শ্রীরামপুর কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তনী শুভ্রা পাল। স্নাতকোত্তরের পড়াশোনার পাশাপাশি গান শুনতে এবং বাগান পরিচর্যা করতে ভালবাসেন শুভ্রা।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –