বাংলা – একাদশ শ্রেণি – বাঙালির শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি (তৃতীয় অধ্যায়)
এর আগে রামায়ণের অনুবাদ সম্পর্কে আলোচনা করেছি, এই পর্বে আমরা মহাভারতের অনুবাদ সম্পর্কে আলোচনা করবো।
এবারে চলে আসি মহাভারতের কথায়। মহাভারত তায় আবার বাংলায়! এ কথা বলতেই প্রথমে কানে বাজে একটা ছন্দোবদ্ধ পয়ার –
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।
আগেকার দিনে প্রত্যেক বাঙালি বাড়িতেই একখানা করে জাবদা সাইজের মহাভারত কিংবা রামায়ণ থাকতো। মা-কাকিমা, দিদা-ঠাকুমারা প্রত্যেক সন্ধ্যায় সন্ধ্যাদীপ জ্বেলে এসে সুর করে সেই মহাভারত পড়তেন।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত কিন্তু তাঁর মায়ের মহাভারত পড়া শুনে সেই পড়ার ছন্দের প্রয়োগটা শুধরে দিয়েছিলেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র এগারো বছর।
একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল
বাঙালি শিশুদের কান এভাবেই তৈরি হয়ে গিয়েছে রামায়ণ আর মহাভারতের পয়ার ছন্দে। এই পংক্তিটাও তেমনি, কিন্তু এ কার লেখা বলতে পারবে? বুদ্ধিমানরা নিশ্চিত এতক্ষণে ধরে ফেলেছো। হ্যাঁ বন্ধুরা, পয়ারের পদটির মধ্যেই কবির নাম লেখা আছে – কাশীরাম দাস। বাংলায় যে কয়েকজন কবি সংস্কৃত বেদব্যাসের লেখা মহাভারতের অনুবাদ করেছেন মধ্যযুগে, তাদের মধ্যে কাশীরাম দাস শ্রেষ্ঠ।
এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, এই যে পদের মধ্যে বা শ্লোকের মধ্যে নিজের নাম উল্লেখ করে দেওয়ার রীতি একে সাহিত্যে বিশেষ এক নাম দেওয়া হয়েছে – ‘ভণিতা’।
বাঙালি কবিরা তাঁদের রচিত পদে নিজেদের স্বাক্ষর রাখতেই এমনটা করতেন। তখন তো আর কপিরাইটের যুগ ছিল না যে অন্য কেউ লেখা নকল করলে তেড়ে মামলা ঠুকে দেবে কপিরাইট আইনে। তাই এই ব্যবস্থা! তবে একটা সমস্যা তো ছিলই, আগেই বলেছি সেটা লিপিকরদের নিয়ে। তাই কোনটা যে কাব্যের আসল পুঁথি তা খুঁজে বের করা মুশকিল হয়ে পড়ে। যাইহোক এই ভণিতার ব্যাপারটি মাথায় রেখো বন্ধুরা। আমরা যখন বৈষ্ণব পদাবলি পড়বো, সেই আলোচনার সময়েও এই ভণিতার প্রয়োগ তোমরা দেখতে পাবে।
কাশীরাম দাস যে বাংলায় মহাভারত রচনা করলেন, তার নাম দিলেন ‘ভারত পাঁচালী’।
মনে করে দেখো কৃত্তিবাসের রামায়ণের নামেও এই পাঁচালি কথাটির উল্লেখ ছিল। বাড়িতে তোমরা মা-কাকিমাদের নিশ্চয় লক্ষ করেছো, প্রতি বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীপূজার সময় লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়তে। সুর করে সেই লেখাগুলি পড়তে হয়, একটা বিশেষ ছন্দ আছে। প্রত্যেক লাইনই একই ছন্দে, একই লয়ে পাঠ করা হয়। একেই বাংলা ছন্দের ভাষায় বলা হয় ‘পয়ার’ আর চলতি কথায় বলে পাঁচালি। মধ্যযুগে এবং আধুনিক যুগের শুরুর দিকে বেশিরভাগ সাহিত্যই রচিত হয়েছে এই পয়ার ছন্দে। তবে পয়ারে লেখা কিন্তু সহজ ছিল না। তবে এই ছন্দের আলোচনায় এখন যাচ্ছি না। পরে কখনো সময় পেলে, সে গল্প করা যাবে।
এখন কাশীরাম দাস ভদ্রলোকটিকে একটু চিনে নিই প্রথমে নাকি!
কৃত্তিবাসের মতোই কাশীরাম দাসের সম্পর্কেও খুব কম তথ্য পাওয়া যায়। তিনি ঠিক কবে জন্মগ্রহণ করেছেন, সে কথা তাঁরই লেখা থেকে জানা যায়।
ষোড়শ শতকে অধুনা বর্ধমান জেলার কাটোয়ার ইন্দ্রাণী পরগণার সিঙ্গি গ্রামে কায়স্থ বৈষ্ণব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কাশীরামের প্রপিতামহের নাম ছিল প্রিয়ঙ্কর এবং পিতামহের নাম ছিল সুধাকর।
একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer
কাশীরামের বাবা কমলাকান্তের তিন সন্তানের মধ্যে কাশীরাম ছিলেন মধ্যম সন্তান। তাঁদের আদি পদবি ‘দেব’ হলেও ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা থেকেই কাশীরাম দাস নিজেকে ঈশ্বরের ‘দাস’ মনে করে নিজের পদবি পরিবর্তন করেন। তাঁরা তিন ভাই-ই ছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে মেধাবী। কাশীরামের বড়ো ভাই কৃষ্ণবিজয় সন্ন্যাস নিয়ে চলে যান।
তিনি ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ ও ‘শ্রীভাগবতপুরাণ’ অনুবাদ করে ‘শ্রীকৃষ্ণবিলাস’ গ্রন্থখানি রচনা করেন আর ছোটো ভাই গদাধর জগন্নাথদেবের মহিমা বিষয়ে রচনা করেন ‘জগন্নাথমঙ্গল’ যা ‘জগৎমঙ্গল’ নামেও পরিচিত।
কাশীরাম দাসের বাস্তুভিটে থেকে অনুমান করা যায় তাঁদের পরিবার যথেষ্ট সচ্ছল এবং মেধাবী ছিল। তিনি বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় অবস্থিত আবাসগড়ের জমিদার বাড়িতে থেকে শিক্ষকতা করতেন। জমিদার বাড়িতে বহু কথক ঠাকুরের আগমন ঘটতো যাঁদের মুখে মুখে রামায়ণ ও মহাভারতের গান শুনে শুনে তাঁর মধ্যে বাংলায় মহাভারত রচনা করার আগ্রহ জন্মায়। তিনি আবাসগড়ের জমিদার বাড়িতে একটি সংস্কৃত সভায় বির্তকে অংশগ্রহণ করার পরে মহাভারত রচনায় হাত দেন। মহাভারত বাংলায় অনুবাদ করা ছাড়াও সত্যনারায়ণের পুঁথি, স্বপ্নপর্ব, জলপর্ব ও নলোপ্যাখান রচনা করেছিলেন তিনি। নিজের গ্রামের জলকষ্ট দূর করার জন্য তিনি একটি পুকুর নির্মাণ করেছিলেন যা আজও ‘কেশপুকুর’ নামে পরিচিত।
কাশীরাম দাসের আগে কেউই মহাভারতের পূর্ণ অনুবাদ করতে সক্ষম হননি। ষোড়শ শতাব্দীতে কবীন্দ্র পরমেশ্বর দাসের ‘পাণ্ডববিজয়’, শ্রীকর নন্দীর ‘অশ্বমেধ কথা’ কোনোটাই মহাভারতের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ ছিল না। কবিরা মহাভারতের খণ্ড খণ্ড অংশের অনুবাদ করতেন অথবা কোনো বিশেষ পর্যায় অবলম্বনে নিজের কাব্য লিখতেন। কাশীরাম দাসের ‘ভারত পাঁচালী’ সম্পূর্ণতা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতানৈক্য আছে কারণ অনেকেই মনে করেন কাশীরামের মৃত্যুর পর তাঁর ভাইয়েরা আর জামাই মিলে এই কাব্যটি সমাপ্ত করেছিলেন।
গবেষকদের মতে কাশীরাম দাস নিজে মহাভারতের বনপর্ব, আদি পর্ব, সভা পর্ব, বিরাট পর্ব অনুবাদ করেছিলেন, বাকি অংশের অনুবাদ তিনি নিজে করেননি।
যাইহোক এবারে কাশীরাম দাসের কাব্যের আলোচনায় আসা যাক বন্ধুরা!
· কৃত্তিবাসের মতোই সহজ সরল ভাষায় ভক্তিরস, করুণ রস, বীর রসের সমাহারে কাশীরাম দাস তাঁর কাব্য রচনা করেছেন।
· ‘ভারত পাঁচালী’তে দ্রৌপদীর অহং প্রকাশের ঘটনা, হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদের ঘটনা, শ্রীবৎসচিন্তার কাহিনী বা অর্জুনের সুভদ্রা হরণের ঘটনাগুলি সংযোজন করেছেন কাশীরাম দাস যা মূল মহাভারতে ছিল না।
· মহাকাব্যের ঔজ্জ্বল্য তাঁর কাব্যে নেই, বরং ভক্তিভাবের প্রাধান্যই বেশি। তাই যুধিষ্ঠির চরিত্রটি ধর্মভীরু, ভাবুক হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছেন কাশীরাম।
· সাধারণ মানুষের কাছে মহাভারতের সংসার জীবনের কথা, ন্যায়-নীতি, সত্যপরায়ণতা, বীরত্ব যা কিছু হিন্দু ধর্মের মূল ভিত্তি, তাই তিনি উপস্থাপন করেছেন নিজস্ব কাব্যিক আঙ্গিকে।
একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি
কাশীরাম দাসের এই মহাভারতকে বাঙালিরা কাশীদাসী মহাভারত হিসেবে আপন করে নিয়েছে। তোমরা শুনলে অবাক হবে, এমনও মানুষ আছেন এখনও যারা জানেনই না যে আসলে মহাভারত লিখেছিলেন বেদব্যাস আর সেটা সংস্কৃতে। তাদের কাছে কাশীরাম দাসই মহাভারতের রচয়িতা। কাশীরাম দাস নিজেও একজন পরম বৈষ্ণব ছিলেন আর তাই তাঁর কাব্যে বৈষ্ণব ধর্মের ভক্তিভাবের প্রাধান্যই বেশি, মহাকাব্যের জাঁকজমক বা grandeur কমই আছে।
অন্যান্য অনুবাদ
কাশীরাম দাসের আগে যারা মহাভারত লিখেছেন বাংলায় সে কথা তো বলাই হয়েছে। কেউই কিন্তু সম্পূর্ণ মহাভারত অনুবা করতে পারেননি। কাশীরাম দাসের পরেও খুব বেশি যে সম্পূর্ণ অনুবাদ হয়েছে তা নয়। তবে একটা তথ্য তোমাদের বলা হয়নি। সেই যে শ্রীকর নন্দীর কথা বলেছিলাম, সেই শ্রীকর নন্দী মহাভারত লিখেছিলেন তাঁর আমলের রাজার অনুরোধে। তবে তারও আগে বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন হুসেন শাহ, তাঁরই সেনাপতি পরাগল খানের আদেশে এক ব্যক্তি মহাভারত অনুবাদ সমাপ্ত করেন।
পরাগল খান ছিলেন চট্টগ্রামের শাসনকর্তা এবং তাঁর নির্দেশে লেখা আঠারো পর্বের মহাভারতকে অনেকে ‘পরাগলী মহাভারত’ও বলে থাকেন।
এই পরাগলী মহাভারত কাব্যটি সম্পর্কে জানতে পারলেও এর কবি সম্পর্কে আজ অবধি কোনো পাথুরে প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → ভাগবতের অনুবাদ
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লেখক পরিচিতি
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
XI_Beng_modhyojug_Somaj_sahityo_5