pascal-law-in-bengali
Class-11

পাস্কালের সূত্র

পদার্থবিদ্যা একাদশ শ্রেণি – উদস্থিতি বিদ্যা (অধ্যায়- পদার্থের ধর্মসমূহ)


তরলের চাপ সম্পর্কিত পাস্কালের সূত্র

কোনো আবদ্ধ প্রবাহীর যে কোনো অংশে চাপ প্রয়োগ করলে, সেই চাপ প্রবাহীর সমস্ত বিন্দুতে অপরিবর্তিত মানে সঞ্চালিত হয় এবং প্রবাহী সংলগ্ন যে কোনো তলের উপর লম্বভাবে ক্রিয়া করে।

ফরাসি বিজ্ঞানী ব্লেইজ পাস্কাল প্রবাহীর মধ্যে দিয়ে চাপ সঞ্চালনের উপরের সূত্রটি নির্ধারণ করেন যা বিজ্ঞানীর নাম অনুসারে পাস্কালের সূত্র নামে পরিচিত। কোনো কঠিন পদার্থের ক্ষেত্রে, ক্ষুদ্র পরিসরের উপর চাপ প্রয়োগ করলে সেই চাপ বস্তুটির স্থানীয় বিকৃতি ঘটায় কিন্তু কঠিন বস্তুটির সমগ্র আয়তনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে না। কারণ কঠিন পদার্থের মধ্যে দৃঢ়তা বর্তমান। আবদ্ধ প্রবাহীর ক্ষেত্রে এই দৃঢ়তা থাকে না বলে প্রবাহীর এক অংশে চাপ দিলে সেই চাপ প্রবাহীর অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ আবদ্ধ প্রবাহীর কোনো বিন্দুতে চাপের পরিবর্তন করলে ঐ প্রবাহীর সকল বিন্দুতেই চাপের সমান পরিবর্তন হয়।

একটি জলপূর্ণ রবারের বলের গায়ে পিন দিয়ে সূক্ষ্ম ছিদ্র করা হল। এবার আঙ্গুল দিয়ে বলটির কোনো অংশে চাপ দিলে দেখা যাবে যে, সকল ছিদ্র দিয়ে ফিনকি দিয়ে জল বলের সাথে লম্বভাবে বাইরে বেরোচ্ছে। আঙ্গুলের চাপ জলের মধ্যে সবদিকে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে বলেই এরকমটা লক্ষ্য করা যায়।

একটি সহজ পরীক্ষার সাহায্যে পাস্কালের সূত্রের সত্যতা প্রমাণ করা যায়।

একটি গোলাকার পাত্র নেওয়া হল, যার মধ্যে A, B, C, D ছিদ্র রয়েছে। যাদের ক্ষেত্রফল যথাক্রমে

α β γ δ প্রতিটি ছিদ্র জলরোধক পিস্টন দিয়ে বন্ধ করা আছে। পাত্রটি জল বা কোনো তরল দিয়ে ভর্তি করে যে কোনো পিস্টনকে ভিতর দিকে ঠেলে দিলে দেখা যায় অন্য পিস্টনগুলি বাইরের দিকে সরে যাচ্ছে। এতে প্রমাণিত হয় যে আবদ্ধ তরলের কোনো অংশে চাপ দিলে সেই চাপ সবদিকে সঞ্চালিত হয়। যদি A পিস্টনের ওপর বাইরে থেকে F_A বল প্রয়োগ করলে তরলের উপর প্রযুক্ত চাপ \frac{F_A}{\alpha}.এবার B, C, D পিস্টনগুলিকে স্থির রাখতে যদি যথাক্রমে F_B, F_C, F_D পরিমাণ বল প্রয়োগ করতে হয় তবে,
\frac{F_A}{\alpha}= \frac{F_B}{\beta}= \frac{F_C}{\gamma}= \frac{F_D}{\delta}= চাপ


একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

অর্থাৎ সকল পিস্টনের ওপর চাপ সমান হয়। এর থেকে বোঝা যে A পিস্টনে যে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল, তা মানে অপরিবর্তিত থেকে সবদিকে সঞ্চালিত হয়।

পাস্কালের সূত্র থেকে ঘাত বৃদ্ধির নীতি

পাস্কালের সূত্র জানবার পর আমাদের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, পাস্কালের সূত্র প্রয়োগ করে কী ঘাতবৃদ্ধি সম্ভব?
হ্যাঁ নিশ্চয়ই।

পাস্কালের সূত্র অনুসারে, আবদ্ধ তরলের কোনো স্থানে অল্প বল প্রয়োগ করে অন্যত্র বেশি মানের বল সৃষ্টি করা যায়। প্রযুক্ত বলের এই বিবর্ধনকে ঘাত বৃদ্ধির নীতি বলা হয়।

A এবং B ভিন্ন প্রস্থচ্ছেদের দুটি চোঙ নেওয়া হল যারা পরস্পরের সাথে C নল দ্বারা যুক্ত।
ধরি সরুচোঙের প্রস্থচ্ছেদ α এবং মোটা চোঙের প্রস্থচ্ছেদ হল β। চোঙদুটিকে জলপূর্ণ করে তাদের মুখদুটি নগণ্য ভরের জলরোধক পিস্টন দিয়ে বন্ধ করা হল। পিস্টন দুটির মাথায় ওজন রাখা যায় এবং পিস্টনদুটি ঘর্ষণহীনভাবে চোঙের মধ্যে চলাচল করতে পারে।
ধরি, ছোট পিস্টনের উপর w, ওজন রাখা হল।
∴ ছোট পিস্টনের উপর ক্রিয়াশীল বল W_1
∴ ছোট পিস্টন দ্বারা জল প্রযুক্ত চাপ \frac{W_1}{\alpha}

পাস্কালের সূত্র অনুসারে, এই চাপ অপরিবর্তিত মানে সবদিকে সঞ্চালিত হয় এবং বড় পিস্টনের উপর ঊর্ধ্বমুখে ক্রিয়া করে।

বড় পিস্টনের উপর মোট ঘাত বা বল চাপ × ক্ষেত্রফল= \frac{W_1}{\alpha}×β


একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল

এই পরিমাণ বলের জন্য বড় পিস্টানটি উপরের দিকে উঠতে থাকবে। এবার এই বড় পিস্টনটিকে নিজের জায়গায় বা স্বস্থানে রাখতে গেলে তার উপর নিম্নমুখী বল এমন ভাবে প্রয়োগ করতে হবে যাতে এই বল = \frac{W_1}{\alpha}×β হয়। তাহলে বড় পিস্টনের উপর W_2 চাপাতে হবে,
W_2 = \frac{W_1}{\alpha}×β = W_1×n
যেখানে n=\frac{\beta}{\alpha}

আমরা আগেই ধরেছি α ও β হল যথাক্রমে সরু ও মোটা চোঙের প্রস্থচ্ছেদ।

∴ β> α
∴ n>1
যেমন, একটু উদাহরণ দিয়ে বলি ব্যাপারটা বড় পিস্টনের ক্ষেত্রফল, ছোট পিস্টনের তুলনায় 100 গুণ বেশী। অর্থাৎ n=100 = \frac{\beta}{\alpha}
তখন বড় পিস্টনে উৎপন্ন ঘাত ছোট পিস্টনে উৎপন্ন ঘাতের 100 গুণ হবে।
অর্থাৎ আমরা দেখতে পেলাম যে আবদ্ধ তরলের এক স্থানে অল্প বল প্রয়োগ করলে অন্য স্থানে তার অনেক গুণ বেশি বল পাওয়া সম্ভব। এটাই বল বা ঘাত বৃদ্ধির নীতি বলে পরিচিত।

ঘাতবৃদ্ধির নীতি এবং শক্তির সংরক্ষণ

আপাতদৃষ্টিতে আমাদের মনে হতে পারে যে, যেহেতু অল্প বল প্রয়োগ করে বেশী মানের বল পাওয়া যাচ্ছে তাহলে ঘাত বা বল বৃদ্ধির এই নীতি শক্তির সংরক্ষণ সূত্র মেনে চলছে না। কিন্তু বাস্তবিক ভাবে বিবেচনা করলে বোঝা যায়- আমরা শক্তির দিক থেকে খুব একটা বেশি লাভবান হই না, এক্ষেত্রেও শক্তির সংরক্ষণ নীতি রক্ষিত হয়।

মনে করি, W_1 বল প্রয়োগের জন্য ছোট পিস্টন নীচের দিকে x দূরত্ব নামে এবং বড় পিস্টনটি y দূরত্ব উপরে উঠে যায়।
যেহেতু বল প্রয়োগ করে জলকে সংকুচিত করতে পারি না (জল অনমণীয়) তাই দুটি চোঙে জলের আয়তন পরিবর্তন সমান হবে।

∴ αx = βy = y \frac{\alpha}{\beta}x ——(1)
\frac{x}{y}= \frac{\beta}{\alpha} =n.


একাদশ শ্রেণি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer

যেহেতু, β>α বা n>1 সুতরাং x>y.
ছোট পিস্টনের ওপর কৃতকার্য = W_1 × x.
বড় পিস্টন দ্বারা কৃতকার্য= W_2× y.
=W_2 × \frac{\alpha}{\beta}x. (1) থেকে পাই
আবার W_2= W_1 × \frac{\beta}{\alpha} বসিয়ে পাই,
W_2 × y = W_1 \frac{beta}{\alpha} × \frac{\alpha}{\beta}x = W_1x.

অর্থাৎ বড় পিস্টন দ্বারা কৃতকার্য ছোট পিস্টনের ওপর কৃতকার্য আমরা দেখলাম যে, ছোট পিস্টনে যে শক্তি ব্যয় করা হয় সেই একই পরিমাণ কার্য ফিরে পাওয়া যায় যদি ঘর্ষণজনিত বাধা ইত্যাদি উপেক্ষা করা যায়। সুতরাং, এক্ষেত্রে শক্তির সংরক্ষণ নীতি লঙ্ঘিত হয় না।

তবে এটা সবসময় মনে রাখা দরকার যে, বাস্তব জীবনে ঘর্ষণজনিত বাধার জন্য অর্থাৎ ঘর্ষণের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য কিছু শক্তি অপচয় হয়। তাই প্রাপ্ত কার্য হিসাব করা কার্য অপেক্ষা কিছুটা কম হয়।


অর্থাৎ বড় পিস্টন দ্বারা কৃতকার্য < ছোট পিস্টনের ওপর কৃতকার্য। তবে আগেই দেখেছি যে, W_2>W_1 এবং x>y. অর্থাৎ বড় পিস্টনের সরণ সর্বদা ছোট পিস্টনের সরণের চেয়ে অনেক কম হয়।

ঘাত বৃদ্ধির নীতির ব্যবহারিক করা হয় হাইড্রলিক প্রেস নামক যন্ত্রে।

এই যন্ত্রের সাহায্যে প্রচণ্ড ঘাতের সৃষ্টি করা হয়। এটি ‘ব্রামাপ্রেস’ নামেও পরিচিত। এই যন্ত্রেও শক্তির সংরক্ষণ নীতি লঙ্ঘিত হয় না।

হাইড্রলিক প্রেস যন্ত্রের ব্যবহার

ক) মোটরগাড়ি মেরামতির কারখানায় মোটরগাড়িকে উঁচুতে তোলার জন্য।
খ) তুলো, কাপড়, কাগজ, পাট ইত্যাদির গাঁটকে চাপা দিয়ে আয়তনে ছোট করার জন্য।
গ) তেলবীজ থেকে তেল নিষ্কাশনের জন্য।
ঘ) লোহা ও ইস্পাতের দণ্ডের শক্তি পরীক্ষার জন্য।

হাইড্রলিক প্রেস যন্ত্রে মূলত দুই পর্যায়ে ঘাত বৃদ্ধি করা হয়।
প্রথম পর্যায়ে, লিভারের সাহায্যে কিছু ঘাত বৃদ্ধি করা হয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ে, পাস্কালের ঘাত বৃদ্ধির নীতি ব্যবহার করে ঘাতের আরও বৃদ্ধি ঘটানো হয়। ফলে উৎপন্ন ঘাত প্রযুক্ত বল অপেক্ষা অনেকগুণ বেশী হয়।

যান্ত্রিক সুবিধা= উৎপন্ন ঘাত/ প্রযুক্ত বল হাইড্রলিক প্রেস যন্ত্রের ক্ষেত্রে যান্ত্রিক সুবিধা 1 অপেক্ষা অনেক বেশী হয়। তবে ঘর্ষণজনিত শক্তিক্ষয়ের জন্য যান্ত্রিক সুবিধা কিছুটা কমে যায়।

সমাপ্ত।


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখিকা পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয় এবং IIT খড়গপুরের পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তনী স্বধীতি মাঝি। পদার্থবিদ্যা চর্চার পাশাপাশি ছবি আঁকা, গান গাওয়া এবং বই পড়ায় সমান উৎসাহী স্বধীতি।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –

XI_P_7.2a