pracin-banglar-somaj-sahityo-dwitiyo-porbo
Class-11

প্রাচীন বাংলার সমাজ ও সাহিত্য – দ্বিতীয় পর্ব

বাংলাএকাদশ শ্রেণি – বাঙালির শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি (দ্বিতীয় অধ্যায়)


এর আগে প্রাচীন বাংলার সমাজ ও সাহিত্য – প্রথম পর্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছি, এই পর্বে আমরা ঐ অধ্যায়ের দ্বিতীয় অংশটি সম্পর্কে আলোচনা করবো।

আবারো চলে এসেছি বন্ধুরা সাহিত্যের ইতিহাসের ক্লাসে। মনে আছে নিশ্চয়, আমরা আগের ক্লাসে চর্যাপদ নিয়ে অনেক কথা আলোচনা করেছিলাম। চর্যাপদ কি, কারা লিখলো, কবে লেখা হয়েছে বলে মনে করা হয়, কে কবে আবিষ্কার করলো সে সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছি। আশা রাখি সেই সব তথ্য তোমাদের মনে আছে। তবু আজকের ক্লাস শুরু করার আগে তোমাদের সামনে আরেকবার পড়া ঝালিয়ে নেওয়া যাক।

১৯০৭ সালে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবার থেকে আবিষ্কার করেন চর্যাপদের পুঁথি।
• সেই পুঁথি আসলে ছিল তিনটি পুঁথির সংকলন। সেগুলি হল – চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, সরহপাদের দোহা এবং ডাকার্ণব।
১৯১৬ সালে এই চর্যার পুঁথি ‘হাজার বছরের পুরান বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা’ নামে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সম্পাদনায় প্রকাশ পায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে।
• চর্যাপদের মধ্যে যে বাংলা ভাষার রূপ দেখা যায় তা আসলে নব্য ভারতীয় আর্য তথা আদি বাংলা ভাষার নিদর্শন বলা চলে।
এর ভাষাকে ‘সন্ধা ভাষা’ বলা হয়।
• হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত চর্যাপদের পুঁথিতে পাওয়া গিয়েছে সাড়ে ৪৬টি পদ।


একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

• এই চর্যাপদের একটি তিব্বতি অনুবাদ আবিষ্কার করেছিলেন ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।
• চর্যার মধ্যে লুকিয়ে আছে বৌদ্ধ সহজিয়া সাধনার গোপন কথা। এটি হল দেহতত্ত্বের গান যার মধ্যে আক্ষরিক অর্থ এক, গূঢ় অর্থ আরেক।

খেয়াল করে দেখো বন্ধুরা মূলত সব পয়েন্টই আমরা এর আগে পড়েছি। কিন্তু শেষেরটি পড়া হয়নি অত ভালোভাবে। তাই আজ ঐ পয়েন্ট দিয়েই আমাদের আলোচনা শুরু হবে।

বন্ধুরা আমি আগেও বলেছি চর্যার মূল বিষয় হল ধর্ম। কোন ধর্ম? বৌদ্ধ ধর্ম।

গৌতম বুদ্ধর মৃত্যুর পরে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা দুইটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন যার একটিকে বলা হয় হীনযান এবং অপরটিকে বলা হয় মহাযান।

এই মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম কালক্রমে বিবর্তিত হয়েছে বহুবার। এই বিবর্তনের ফলে নবম থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যেই বাংলার বুকে তৈরি হয় বজ্রযান, কালচক্রযান এবং সহজযান নামে পৃথক পৃথক মহাযানী বৌদ্ধ সম্প্রদায়। আসলে মহাযানীরা বুদ্ধের কোনো মূর্তির অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না, তারা নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাসী। কিন্তু তা হলেও ঐ সময় পর্বে হিন্দু ধর্মের তন্ত্রসাধনা এবং শাক্ত ধর্মের প্রভাবে বৌদ্ধ ধর্মের মধ্যেও মিশছিল তন্ত্রের নানা উপকরণ ও সংস্কার।

যার ফলে মহাযানী বৌদ্ধদের মধ্যে পৃথক পৃথক সাধনার পদ্ধতি অনুযায়ী বিভাজন ঘটে যায় বজ্রযান, কালচক্রযান এবং সহজযানে। তোমাদের এত কিছু মনে না রাখলেও চলবে।

শুধু এটুকু মনে রেখো চর্যাপদের মধ্যে বৌদ্ধ সহজযানী সাধনার কথা লেখা আছে। যারা এই চর্যা লিখেছেন অর্থাৎ সেই ভুসুক পাদ, লুই পাদ, শবর পাদ প্রমুখরা সকলেই সহজযানী বৌদ্ধ।

আশা করি এইটুকু বিষয়ে কোনো বুঝতে অসুবিধে হয়নি। এবারে আসল জায়গায় আসি। চর্যাপদের প্রতিটি পদের মধ্যে বৌদ্ধ সহজযানী সাধক-কবিরা তাদের সাধনার নানা গোপন কথা হেঁয়ালির আড়ালে বলে গেছেন।
শুধু এই বিষয়টি বোঝাবার জন্য একটি পদের উদাহরণ দিই। ধরা যাক এই পদটি –

‘টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী।
হাঁড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী।।
বেগ সংসার বড় হিল জাঅ।
দুহিল দুধু কি বেণ্টে যামাঅ।।’’

এর আক্ষরিক অর্থ করলে এই দাঁড়ায় যে – টিলার উপর আমার ঘর। আমার হাঁড়িতে ভাত নেই, নিত্য উপবাস। দিন দিন সংসার বেড়ে চলেছে। দোহন করা দুধ কি আর বাঁটে ফিরে যায়?

অর্থটা কখনোই এর থেকে পরিস্কার করে বোঝা যায় না। কিন্তু এরও একটা গূঢ়ার্থ আছে। আগে সেটা দেখে নিই, পরে বোঝাচ্ছি। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা এর মধ্যে দিয়ে তাঁদের সাধনার একেবারে চরম সীমা বা উচ্চমার্গের অবস্থানের কথা বলতে চেয়েছেন। সহজ সাধনার সিদ্ধিলাভের মুহূর্তে জীবনের সমস্ত ভোগবাসনা, কামনা, রিপু সবই অবলুপ্ত হয়। সময় বা কাল অতিক্রান্ত হতে থাকে। ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্নার যে নিম্নগতি তাকে একবার উর্ধমুখী করতে পারলে তার গতি পরিবর্তিত হয় না।

খুব সংক্ষেপে এবং সহজ করে বলি বিষয়টা। বেশি কিছু মাথায় রাখার দরকার নেই। আসলে চর্যাপদের ধর্মতত্ত্ব বলতে সহজযানী সাধনার কথা বলা হয়।


একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer

এই সাধনার মাধ্যমে সাধকেরা শরীরের দুটি প্রধান নাড়ী ঈড়া ও পিঙ্গলার স্বাভাবিক নিম্নগতিকে রুদ্ধ করে মধ্যগা নাড়ী অর্থাৎ সুষুম্নায় পর্যবসিত করেন। এই সুষুম্না জাগ্রত হয়ে বিভিন্ন চক্রের মধ্যত দিয়ে শক্তি চলে যায় সাধকের মাথার মহাসুখচক্রে। এর ফলেই সাধকের সিদ্ধিলাভ ঘটে এবং সাধক মহাসুখ লাভ করেন। এই মহাসুখ লাভের গোপন ও জটিল প্রক্রিয়ার নানা ইঙ্গিত চর্যাপদে বর্ণিত আছে।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছিলেন যে এই ধর্মের বিষয়টা কেবল ওই ধর্মের মানুষই বুঝবেন, বাইরের কেউ বুঝবেন না। ঠিক কথা, এই উদ্দেশ্যেই এত হেঁয়ালি করে এই সাধনার কথা লিখেছিলেন সাধক-কবিরা। অমৃতের খোঁজ যেই পাক, সে কি অত সহজে অপরকে জানাবে!

যাক একটু মজা করলাম বন্ধুরা। ফিরে আসি পড়ায়। চর্যাপদের মধ্যে অদ্ভুতভাবে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার নানা ছবি তোমরা দেখতে পাবে। আসলে একটা কথা আছে না, সাহিত্য হল সমাজের আয়না। ঐ একই কথা বলতে হয়। যে সময়কালে যে সাহিত্য লেখা হচ্ছে তার ছাপ লেখক বা কবির লেখায় পড়বেই। বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শনটিও তার ব্যতিক্রম নয়। চর্যাপদ লেখা হয়েছে মোটামুটিভাবে দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে।

সেই সময় বাঙালির খাদ্য বলতে ভাতই ছিল প্রধান যার ছবি আমরা একটু আগে আলোচিত পদটিতে পেয়েছি। এছাড়া সমাজজীবনে সেকালে পরকীয়ার উল্লেখ পাওয়া যায় যাকে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের ভাষায় ‘সাঙা’ বলা হয়েছে। ব্রাহ্মণেরা অন্ত্যজ বর্ণের চণ্ডাল নারীকে সাঙা করতে চেয়েছে এমন ছবিও এই চর্যাপদে পাওয়া যায়। যে ব্রাহ্মণেরা দিনের আলোয় সমাজে জাত-ধর্মের জিগির তুলে গ্রামের বাইরে একঘরে করে দিয়েছিল চণ্ডালিনীকে, শবরীকে; তারাই রাতের আঁধারে চুপিচুপি চণ্ডালিনীর কাছে যায়। সমাজে অন্ত্যজ বর্ণের মানুষদের উপর ব্রাহ্মণদের অত্যাচার ছিল নিত্যদিনের ঘটনা আর তার প্রভাব লক্ষ্য করা যায় চর্যার পদগুলিতেও। ব্যাধ, শবর প্রভৃতি নিম্নবর্ণের মানুষদের সঙ্গে সমাজের উচ্চবর্ণের বিরোধের চিত্র স্পষ্ট পাওয়া যায় নিম্নলিখিত পদে –

‘নগর বাহিরে ডোম্বী তোহোরি কুড়িআ।
ছোই ছোই জাহ সো বাহ্ম নাড়িআ।।’

অর্থাৎ নগরের বাইরে, গ্রামের বাইরে ডোম্বীর ঘর এবং চুপি চুপি ব্রাহ্মণেরা সেই ঘরে যায়।

এই স্পষ্ট ছবি সাধক কবিদের দৃষ্টি এড়ায়নি। সেই সময়কার সমাজে মানুষজনের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। অভাব ছিল সর্বত্র। চাঙারি তৈরি, খেয়া পারাপার, শিকার, গাছ কেটে সাঁকো নির্মাণ ইত্যাদি নানা জীবিকার উল্লেখও পাওয়া গেছে চর্যাপদে। এমনকি চুরির কথাও রয়েছে এখানে। চোর-ডাকাতের উপদ্রব যে তখনকার সমাজেও ছিল, সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।

বাংলাদেশের ভৌগলিক পরিবেশে একদিকে নদী-খাল-বিলের প্রাচুর্য যেমন ছিল, তেমনি পর্বতের অবস্থানও ছিল। চর্যাপদে প্রায়ই কবিদের লেখায় এইসব নদী, খাল এবং তার উপরের সাঁকোর কথা পাওয়া যায়। জলপথে বেশিরভাগ সময়েই ডিঙি বা নৌকা করে যাতায়াত চলতো, এমন বর্ণনা দেখা যায় চর্যাপদে। চাটিল পাদের একটি পদে গাছ কেটে সাঁকো তৈরির কথা রয়েছে।


একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল

আর সবশেষে বলতে হয় বিনোদন ব্যবস্থার কথা। চর্যায় বর্ণিত সমাজে বিনোদন হিসেবে মদ্যপান, দাবাখেলা, নাচ ও নাটকের উল্লেখ পাওয়া যায়। চর্যার একটি অত্যন্ত বিখ্যাত পদে বুদ্ধনাটকের কথা আছে যাকে প্রাচীন বাংলার নাট্য উপস্থাপনের আদিতম নিদর্শন বলে কল্পনা করা হয়।
পদটি হল –

‘নাচন্তি গাইল বাজন্তি দেবী।
বুদ্ধনাটক বিসোমা হোই।।’

এভাবে চর্যাপদ প্রাচীন বাংলার আদিম নিদর্শন হিসেবে প্রাচীন বাংলার সমাজ-সংস্কৃতির ও ধর্মাচরণের এক বিরাট রূপ আমাদের সামনে তুলে ধরে। দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যেই এই চর্যাপদ লেখা শেষ হয়ে গিয়েছিল বলে সাহিত্যের ইতিহাসকারেরা মনে করেন। তারপর দীর্ঘ দীর্ঘ সময় বাংলায় আর কোনো সাহিত্যিক নিদর্শন পাওয়া যায় না।

খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৩৫০ অব্দ পর্যন্ত সময়কাল বঙ্গদেশে এক বন্ধ্যা সময়, এক বিশৃঙ্খল সময়। অথচ এই সময়পর্বই বাংলা সাহিত্যের পরবর্তী গতিপথ নির্ধারণে সাহায্য করেছিল। তাই এই সময়কাল সাহিত্যের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এ সম্পর্কে আমরা পরবর্তী ক্লাসে আলোচনা করবো বিস্তারিতভাবে। আজ চর্যাপদের ইতিহাসেই ইতি টানলাম। ভালো থেকো সকলে।

পর্ব সমাপ্ত।


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –

XI_Beng_Somaj_sahityo_2