telenapota-abiskar-golper-bishoybostu
Class-11

তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পের বিষয়বস্তু

বাংলাএকাদশ শ্রেণি – তেলেনাপোতা আবিষ্কার (দ্বিতীয় পর্ব)


আগের পর্বে আমরা তেলেনাপোতা আবিষ্কার গল্পের সারসংক্ষেপ সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। এই পর্বে আমরা তেলেনাপোতা আবিষ্কার গল্পের মূল বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করবো।

তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ গল্পের বিষয়বস্তু

এই তেলেনাপোতা বড় মায়াবী জায়গা। যে কেউ সঠিক সময়ে পৌঁছালে এই তেলেনাপোতা আবিষ্কার করে ফেলতে পারেন। গল্প কথক বলছেন গল্পের শুরুতেই –

_‘…তা হলে হঠাৎ একদিন তেলেনাপোতা আপনিও আবিষ্কার করতে পারেন’

শনিবার বা মঙ্গলবারের মধ্যেই মঙ্গলবারেই কথক বর্ণিত পথ অনুসরণ করে যে কেউ সেই অখ্যাত স্থান আবিষ্কার করে ফেলতে পারেন। কীভাবে সেই আবিষ্কার করা সম্ভব সে বিষয়ে কথক যে বর্ণনা দেন সেখানে উল্লেখযোগ্যভাবে ভবিষ্যৎ কালের বর্ণনাই প্রধান এবং তাতে সম্ভাব্যতার উল্লেখ আরো লক্ষণীয়।

হঠাৎ কাজ থেকে দু’দিনের ছুটি পেলে এক পানরসিক বন্ধু আর একজন নিদ্রাকাতর বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে কথকের মতো পাঠকও পারেন ভিড়াক্রান্ত বাসে চাপাচাপি করে জঙ্গলের পথে ছোট্ট গরুর গাড়িতে কোনোমতে জায়গা করে বসে অবশেষে তেলেনাপোতায় পৌঁছাতে।

এই তেলেনাপোতায় যাত্রাকে লেখক বলেছেন ‘আবিষ্কার’। কলকাতার অনতিদূরেই এমন দূর্ভেদ্য জঙ্গলাকীর্ণ ভগ্নপ্রায় প্রাসাদোপম বাড়ি এসব কথকের কল্পনাতেও আসেনি। অজানাকে জানার কৌতুহল রোম্যান্টিকতার লক্ষণ আর সেই লক্ষণ গল্পের মধ্যে বিদ্যমান। তাই অজ্ঞাত অপরিচিত এই তেলেনাপোতা যাত্রা হয়ে উঠেছে একটি আবিষ্কার, যা আসলে নিজেকেই আবিষ্কার করার প্রতিরূপ।

এ কথা আগেই বলা হয়েছে। গরুর গাড়িতে যেতে যেতে ক্রমশ দু পাশের জঙ্গল আরো ঘন হয়ে উঠবে। মাঝে মাঝে ছইয়ের মধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি লাগবে। আর ধীরে ধীরে যেন কথক এবং তাঁর সঙ্গীরা প্রত্যেকেই বাস্তবের জগৎ ছেড়ে ঢুকে পড়তে থাকেন এক স্বপ্ন-কল্পনাময় অজ্ঞাত পরিবেশে। তাদের সকলেরই আর যেন কোনো বাস্তববোধ থাকে না। তাই কথক বলেন –

‘চেতনার শেষ দ্বীপটিও বুঝি ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে’

তেলেনাপোতা যেন চেতন-অবচেতনের মাঝে দোদুল্যমান এক স্বপ্ন, এক না হয়ে ওঠা বাস্তব। সেই দুর্ভেদ্য অব্ধকারাচ্ছন্ন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কথকরা কোনো গাড়ি বা যানবাহনের অপেক্ষারত, তখন অন্ধকারে পরস্পরের মুখও আর দেখা যাবে না। মশাদের উৎপাত আরো প্রবল হবে। সেই সময়ই অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত কথকদের সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে জঙ্গলের ভিতর থেকে এগিয়ে আসতে দেখা যাবে একটি গরুর গাড়িকে আর তাঁর চাকার অমানুষিক শব্দ শুনে কথক ভাববেন –

‘মনে হবে বোবা জঙ্গল থেকে কে যেন অমানুষিক এক কান্না নিংড়ে নিংড়ে বার করছে’

সেই গরুর গাড়ির অদ্ভুত ক্যাঁচ-কোঁচ শব্দই আসলে কথকের এক হৃদয়বিদারক কান্না মনে হয়েছে।

জনহীন ঐ জঙ্গলের মায়াবী আধিভৌতিক পরিবেশে দূরাগত ঐ চাকার শব্দকে কান্না মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। জঙ্গলে কোনো প্রাণীর চলাফেরা বা ডাকও শোনা যাচ্ছিল না বলে কথক একে ‘বোবা জঙ্গল’ বলেছেন।

তারপর সেই গাড়িতে চেপে বহু পথ অতিক্রম করে বিরাট একটা মাঠ অতিক্রম করার পরে আকাশে কৃষ্ণপক্ষের ক্ষয়িত চাঁদের দেখা মেলে। গরুর গাড়ির দু পাশে কথকরা দেখতে পান পুরনো মন্দির, প্রাসাদের স্তম্ভ, দেউড়ির খিলান এসবই যেন নির্বাক পাহারাদারের মতো মহাকালের সাক্ষী হয়ে দণ্ডায়মান।

ক্রমশই এক সুপ্ত অতীতের দিকে ধাবিত হচ্ছিলেন কথকরা, সেই অতীতের অমোঘ আকর্ষণ আর পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির রোম্যান্টিক আবহে কথকের মনে হয় যেন তিনি –

‘জীবন্ত পৃথিবী ছাড়িয়ে অতীতের কোনো কুজ্ঝটিকাচ্ছন্ন স্মৃতিলোকে এসে পড়েছেন’।

সমগ্র গল্পটিতে মূলত তিনটি বিষয় লক্ষণীয়

১) গল্পটি এক সম্ভাবনার নামান্তর। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভবিষ্যৎকালে লেখা এই গল্পে যেন সব ঘটনাই ধরে নেওয়া, কল্পনামাত্র। নির্দিষ্ট করে কিছুই যেন বলা হচ্ছে না।

২) লেখকের কথনরীতিতে সাধুভাষা ও তৎসম শব্দের বাহুল্য লক্ষ করা যায়। প্রাচীনত্বের সঙ্গে এবং কাব্যিক আবহের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটাতে লেখকের শব্দচয়নের মুন্সিয়ানা বেশ মাধুর্যপূর্ণ।

৩) গল্পের মূল কেন্দ্রবিন্দু লুকিয়ে আছে যামিনী, নিরঞ্জন এবং কথককে ঘিরে। কিন্তু তার মাঝে ঐ ভগ্নপ্রায় প্রাসাদোপম বাড়িটি নিজেই যেন একটি চরিত্র হয়ে ওঠে।

পাঠককে মধ্যমপুরুষে সম্বোধন করে লেখা এমন অসামান্য ছোটোগল্প বাংলা সাহিত্যের আর দুটি নেই বললে অত্যুক্তি হয় না। বাস্তব আর অবাস্তবের মাঝে দোদুল্যমান এক ধূসর স্মৃতিকল্প এই তেলেনাপোতা আবিষ্কার।


একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

তেলেনাপোতা আসলে কী ?

কোনো বিশেষ স্থানে রোমাঞ্চকর আবিষ্কারের কথা লেখক এখানে বলতে চাননি। এই তেলেনাপোতা আবিষ্কার আসলে আমাদের নিজেদের মনের অতল তলের সন্ধান, এক আত্মানুসন্ধান বা আত্ম-আবিষ্কার।

কথক আর দুই বন্ধু যেন ঐ ভগ্নপ্রায় বাড়িটিতে যামিনী আর তার বৃদ্ধা মায়ের এতদিনের আপোসের সংসারে এসে নিজেদেরকেই আবিষ্কার করলো নতুনভাবে। গল্পটিকে যদি পর্ব অনুসারে বিভাজন করতে হয় তাহলে চারটি মূল বিভাজন লক্ষ করা যাবে –

· তেলেনাপোতার উদ্দেশ্যে যাত্রার প্রস্তুতি ও যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা

· তেলেনাপোতায় পৌঁছে ভাঙা প্রাসাদের একটি কোণে রাত্রিবাসের অভিজ্ঞতা

· যামিনী ও তাঁর বৃদ্ধা মায়ের জীবনের সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে প্রবেশ করে কথকের নিজেকে সেই সমস্যার অঙ্গ করে নেওয়া।

· কলকাতা ফিরে এসে সমস্ত ঘটনার বিস্মরণ।

তেলেনাপোতা যেন সত্যই এক স্মৃতিলোক। বাস্তবের পৃথিবীর বাইরে এক অজ্ঞাত-অচেনা মায়া ঘেরা পৃথিবীতেই যামিনীর দেখা পাওয়া সম্ভব। অতীতচারিতা রোম্যান্টিকতার অন্যতম লক্ষণ যা কথকের এই বক্তব্যে পরিস্ফূট হয়।

এই তেলেনাপোতার স্মৃতিই একদিন নাগরিক দৈন্যতায় ধুয়ে মুছে যাবে। কথক ভুলে যাবেন যামিনীকে। ম্যালেরিয়া থেকে সুস্থ হয়ে দূর্বল দেহে কথকের মনে হবে যামিনী নামে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ক্রমেই অস্তমিত তারার ম্লান আলো নিয়ে মিশে যাচ্ছে দিগন্তে। আর তখনই কথকের মনে হবে –

‘…তেলেনাপোতা ব’লে কোথায় কিছু সত্যি নেই’

কিন্তু এই তেলেনাপোতাতেই একদিন মৎস্য শিকারের লোভে ভগ্নপ্রায় প্রাসাদের পাশের এক পানাপুকুরে ছিপ, বড়শি নিয়ে শ্যাওলাবৃত ভাঙা ঘাটে বসে মাছের অপেক্ষা করেছিলেন কথক আর সেখানেই তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা হয়ে যায় যামিনীর।

জনহীন পুকুরঘাটের অসীম নির্জনতার মধ্যে ওপারের ডাল থেকে মাছরাঙা পাখির ছোঁ মেরে মাছ তুলে নেওয়া কথককে বিব্রত করবে। চারপাশে ঘুঘু পাখির ডাক, ফড়িংয়ের ডানা মেলা উড়ান কথককে উদাস করে তুলবে, আর সেই অমনোযোগে মাছ ছিপ থেকে টোপ খেয়ে পালিয়ে যাবে। ইতিমধ্যে কলসিতে জল ভরবে যামিনী। অপরিচিতা যৌবনোত্তীর্ণা সেই নারীর অলজ্জ বাক্যালাপে মুগ্ধ হয়ে আনমনা হয়ে পড়বেন কথক।

একসময় মাছ না পেয়ে যামিনীর সেই আবেদনময়ী হাসি কথক কোনোদিনই ভুলতে পারবেন না। আর তাই তাঁর মনে হয় –

‘পুকুরের ঘাটের নির্জনতা ভঙ্গ হবে না তারপর’

অচঞ্চল, কমনীয়, গম্ভীর সেই নারীই যে যামিনী তা কথক বন্ধুদের কাছে যাওয়ার পরেই জানতে পারবেন। তাঁর শীর্ণ, অপরিপুষ্ট শরীর দেখে কথকের মনে হয় যৌবনের বিকাশ যেন তাঁর দেহে থমকে আছে।

বন্ধু মণিদার কাছ থেকে কৌতুহলবশত যামিনীর পরিচয় জেনে নেবেন কথক। নিরঞ্জনের জন্য অযৌক্তিক অপেক্ষা তাঁর কাছে ‘মুস্কিল’ বলে মনে হবে। যামিনীর বৃদ্ধা মা নিরঞ্জনের প্রতিশ্রুতিভঙ্গের কথা শুনলে সঙ্গে সঙ্গেই হয়তো পরলোকগতা হবেন। তাই হয়তো লেখক বলেন –

‘আপনাদের পদশব্দ শুনে সেই কঙ্কালের মধ্যেও যেন চাঞ্চল্য দেখা দেবে’।

যামিনীর প্রায়ান্ধকার ঘরে একটা ভাঙা তক্তাপোশের এক পাশে কাঁথায় জড়ানো তাঁর মায়ের কঙ্কালসার শায়িত মূর্তি দেখে যে কেউ আবেগবিহ্বল হয়ে পড়বেন, তাঁর মনের মধ্যে জেগে উঠবে সাময়িক শিভ্যালরির এক ভ্রান্ত তাড়না।

আর সেই তাড়না থেকেই কথকের মতো পাঠকও হয়তো সেই পরিস্থিতিতে যামিনীর মাকে নিরঞ্জন সেজে কথা দিয়ে ফেলবে, যামিনীকে বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলবে।

সূচিত হবে বিশ্বাসভঙ্গের আরেক করুণ অধ্যায়, প্রতিশ্রুতিভঙ্গের আরেক আঘাত সইতে হবে যামিনীকে।


আরো পড়ুন কর্তার ভূত গল্পের বিষয়সংক্ষেপ

সবই যেন পরিস্থিতির নিগড়ে বাঁধা। কী অদ্ভুত মুন্সিয়ানায় লেখক ভবিষ্যৎকালের প্রয়োগ করে আমাদের বুঝিয়ে দেন পৃথিবীতে পরিকল্পনা বলে সত্যিই কিছু হয় না। যা ঘটে আর যা হয়, সবই আমাদের সাময়িক আবেগের ফলমাত্র।

কথকের মতো আমরাও হয়তো অপরিকল্পিত প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলি অনেক, কিন্তু তার দায় পালনের সময়ই কঠোর বাস্তব জগতের শত সহস্র পরিকল্পনার কথা আমাদের মাথায় ভিড় করে আসে।

মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত কথক নিছক খেলার ছলেই প্রতিশ্রুতি দেন যামিনীকে বিয়ে করবেন কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি আসলে রাখতে পারেন না তিনি। হয়তো এটাই কাম্য পরিণতি।

নানাবিধ দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মাঝে নাগরিক ক্লান্তি আমাদের ভুলিয়ে দেয় নিজস্ব আবেগ। এই মিথ্যে আবেগসর্বস্ব নাগরিকতা যে কতটা ভ্রান্ত অসাড় তা যেন লেখক কথকের মিথ্যে প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে পাঠককে দেখিয়ে দিতে চান।


আরো পড়ুন বাড়ির কাছে আরশিনগর কবিতার মূল বক্তব্য

অমন নির্জন জায়গায় একটি মেয়েকে দেখে খানিক আকৃষ্ট হয়েছিলেন কথক। হয়তো তাঁর ছিপ নিয়ে মাছ ধরা সেই মেয়েটিকে প্রেমের ফাঁদে আবদ্ধ করার প্রতীকী ব্যঞ্জনা।
আর তাই হয়তো ফেরার সময় তিনি বলেন-

”…তেলেনাপোতার মাছ একবার ফাঁকি দিলেও দ্বিতীয়বার আর তা পারবে না….’’

যামিনী কি তাহলে সেই তেলেনাপোতার মাছ?

মনে পরে যাবে তেলেনাপোতা যাত্রাকালে লেখক আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সেই তেলেনাপোতার বিরাট সরোবরে আজও মাছেরা কারোর বড়শিতে বিদ্ধ হয়নি এবং সেই বিদ্ধ হওয়ার আসাতেই তারা সব প্রতীক্ষমাণ।

সেই বৃদ্ধাকে কথা দিয়ে ফেলা, নিরঞ্জনের হয়ে অভিনয় করা এসবই কি তাহলে কথকের বানানো – এই প্রশ্ন জাগে আমাদের মনে। আমরা যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না ঐ পরিস্থিতিতে যে কোনো মানুষের পক্ষেই এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলা স্বাভাবিক।


একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer

আর সেই ‘যে কোনো মানুষ’-এর প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন কথক আর তার দুই বন্ধু।

তাদের কোনো নির্দিষ্ট পরিচয় নেই। কথক যেন অন্য দুজনের থেকে একটু আলাদা। এক বন্ধু মদ্যপানে মগ্ন আর অপরজন নিদ্রায় – দুজনের মধ্যে থেকেও এভাবে একা হয়ে পড়েন কথক আর সেই একাকীত্বে ঐ ভগ্ন প্রাসাদের অতীতের মধ্যে তাঁর নিজের চেতনার আলোটিও নিভে যায়।

এক মহাকাল যেন গ্রাস করে তাঁকে।

কালের অমোঘ নিয়তি যেন এই প্রতিশ্রুতিভঙ্গ। দেখা যাবে যে সময় গল্পটি লেখা হচ্ছে তার আগে আগেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘটে গেছে।

আর এই যুদ্ধ বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতি মানবজীবন সবেতেই এক বিরাট পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে। অবিশ্বাস, সন্দেহ, ভয়, দ্বিধা মানুষকে গ্রাস করেছে বিশ্বযুদ্ধের পরে।

তেলেনাপোতার সেই বাড়িটি যেন প্রাচীন ক্ষয়িত মূল্যবোধের প্রতিভূ হয়ে ওঠে। আর অর্থনৈতিক অসাম্যের শিকার হয়ে যামিনী আর তার মা আজও শুধুমাত্র বিবাহের আশায় একটি পারিবারিক বন্ধন টিকিয়ে রেখেছে।

যামিনী যেন অবক্ষয়িত পৃথিবীর শেষ সত্যের আলো।

ম্যালেরিয়ায় শ্মশান হয়ে যাওয়া এক অজ গ্রামে যাওয়ার আগে থেকেই কথকের রোমাণ্টিক মন উদ্বেল হয়ে ওঠে।

মধ্যবিত্ত মানুষের স্বভাবজাত রোমান্টিকতা উছলে পড়ে তেলেনাপোতার যাত্রাপথের প্রাকৃতিক নিসর্গ দেখে। আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ, কৌতূহল-প্রবণতা, রহস্যময়তা এসবই এই গল্পে রয়েছে। কিন্তু সমস্ত রোমান্টিকতার উর্ধ্বে প্রকট হয়ে ধরা পড়েছে কথক আর তাঁর দুই বন্ধুর নাগরিক স্বার্থমগ্নতা আর আত্মকেন্দ্রিকতা।


আরো পড়ুন নীলধ্বজের প্রতি জনা – কবিতার বিষয়বস্তু

বাস্তব আর অবাস্তবের মধ্যে দোলাচল থাকলেও বাস্তবকেই বেছে নিয়েছেন কথক। জ্বরের পর তাঁর মন থেকেও তেলেনাপোতার স্মৃতি, যামিনীর কথা সবই অপসৃত হয়েছে। একদিকে নিরঞ্জন যামিনীর মাকে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিরুদ্দেশ আর অন্যদিকে আবেগসর্বস্ব বাকপটুতায় যামিনীর মনে আশার আলো জ্বেলে কথকও শেষ পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা পারেন না।

নিরঞ্জন আর গল্পকথক যেন একই নাগরিক সভ্যতার দুই প্রতিভূ।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর কবিতায় আক্ষেপ করেছিলেন, ‘তবু, কথা রাখেনি বরুণা…’

এখানে তার সূত্র ধরেই বলতে হয়, নিরঞ্জনেরাও কথা রাখে না, কথা রাখে না কথকের মতো নাগরিক পুরুষও। কথা না রাখার অভ্যাসেই যেন আমরা নিজেদের বারংবার অভ্যস্ত করে ফেলেছি।

বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী তীব্র বাস্তবমুখী দুনিয়ায় সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী, দূর্বল।

তাই সেই ভগ্নপ্রায় জীর্ণ প্রাসাদের মতোই মধ্যবিত্তের সততা, নিষ্ঠা, প্রতিশ্রুতি সবই যেন ক্ষণস্থায়ী।

সমাপ্ত।


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতিঃ

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



এছাড়া,পড়াশোনা সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ের আলোচনায় সরাসরি অংশগ্রহন করতে যুক্ত হতে পারেন ‘লেখা-পড়া-শোনা’ ফেসবুক গ্রূপে। এই গ্রুপে যুক্ত হতে ক্লিক করুন এখানে।