বাংলা – দ্বাদশ শ্রেণি - ক্রন্দনরতা জননীর পাশে (বিশদে আলোচনা) [addthis tool=addthis_inline_follow_toolbox] এর আগে ক্রন্দনরতা জননীর পাশে কবিতার সারসংক্ষেপ সম্পর্কে আলোচনা করেছি, এই পর্বে আমরাক্রন্দনরতা জননীর পাশে কবিতাটি বিশদে আলোচনা করবো। মৃদুল দাশগুপ্তের ‘ক্রন্দনরতা জননীর পাশে’ কবিতাটি কবির সমাজভাবনার এক বলিষ্ঠ প্রকাশ। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, মৃদুল দাশগুপ্তের কবিতাকে বলেছেন ‘ব্যক্তিগত স্তর থেকে সামাজিক স্তরে যাওয়ার করিডোর বিশেষ। আর এই করিডোর থেকেই তিনি প্রত্যাঘাত হানেন। কাব্যে প্রবর্তন করতে চান সহিংস আধ্যাত্মিকতার রেওয়াজ।’ ‘ক্রন্দনরতা জননীর পাশে' কবিতাতেও এই একই ভাবনার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। সমাজের এক অস্থির সময়ে শাসকেরা যখন তাদের দায়িত্ব ভুলে যায়, তাদের জনবিরোধী অবস্থানে দেশ হয় বিপন্ন—তখন সেই লাঞ্ছিত দেশবাসীর পাশেই দাঁড়াতে চান কবি। শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীতের কাছে এই দায়বদ্ধতাই কবি প্রত্যাশা করেন — কেন তবে লেখা, কেন গান গাওয়া, কেন তবে আঁকাআঁকি? দেশের মানুষ কবির ভাই। সেই ভাইয়ের মৃতদেহের দৃশ্য তাঁর মনে ক্রোধের জন্ম দেয়। এই সামাজিক ক্রোধ কবির কাছে ভালোবাসা, সমাজবদ্ধতা এবং মূল্যবোধের প্রতীক। জঙ্গলের মধ্যে নিখোঁজ মেয়ের ছিন্নভিন্ন শরীর দেখে প্রতিবাদে অস্থির হয়ে ওঠেন কবি। আকাশের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরের সুবিচারের জন্য অপেক্ষা করে থাকা তখন তাঁর কাছে অর্থহীন বলে মনে হয়। বরং সেইসময় নিজের কবিতাকে তিনি করে তোলেন প্রতিবাদের অস্ত্র। নিজের বিবেককে তিনি জাগিয়ে রাখতে চান কবিতার মধ্য দিয়ে। এভাবেই ‘ক্রন্দনরতা জননীর পাশে' কবি দাঁড়ান নিজের কবিতাকে সঙ্গে নিয়েই। শাসকের অত্যাচার, অমানবিকতা, নারী নিগ্রহের ঘৃণ্যতা প্রভৃতির বিরুদ্ধে তীব্রকণ্ঠ হয়ে ওঠে মৃদুল দাশগুপ্তের কবিতা। একদা মৃদুল লিখেছিলেন – ‘আমি মৃদুল দাশগুপ্ত, আমি আরব গেরিলাদের সমর্থন করি’ তিনি যখন নিহত ভাইয়ের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন, তখন তাঁর ক্রোধ হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। মানুষের প্রতি ভালোবাসা, দায়বদ্ধতা আর মূল্যবোধই তাঁর এই ক্রোধের উৎস। নিখোঁজ মেয়ের ছিন্নভিন্ন শরীর যখন জঙ্গলে পাওয়া যায়, তখন কবিতার মাধ্যমেই নিজের বিবেককে জাগিয়ে রাখতে চান কবি। যে অনুভূতি থেকে নজরুল লিখেছিলেন, ‘রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা / তাই লিখে যাই এ রক্ত লেখা’, কবি সেই একই প্রেরণা থেকেই লিখে চলেন প্রতিবাদধর্মী কবিতা। কবিতার মধ্যে জমিয়ে তোলেন প্রতিবাদের বারুদ, সামান্য আগুনের ছোঁয়াতেই যা থেকে নিশ্চিতভাবে ঘটে যাবে প্রতিবাদের বিস্ফোরণ। এই মৃত্যু, এই নারকীয় অত্যাচার প্রতিনিয়ত কবির দেশমাতাকে করে তোলে ‘ক্রন্দনরতা জননী’। আর কবি চান সেই জননীর পাশে দাঁড়াতে। এই পাশে দাঁড়ানো আসলে সেই দায়বদ্ধতা যা একজন কবি, শিল্পী বা গায়কের কাছে প্রত্যাশিত। কবি বিশ্বাস করেন — “সমস্ত কবিতাই জীবন ও জীবনযাপনের” তাই জীবন যখন লাঞ্ছিত এবং রক্তাক্ত হয়, তখন তার পাশে দাঁড়ানোকেই তিনি কবির ধর্ম বলে মনে করেছেন। এই কবিতায় সময়কে অবলম্বন করে মহাসময়ে পৌঁছোতে চেয়েছেন কবি। সাধারণভাবে কবি মৃদুল উচ্চকণ্ঠে কথা বলেন না, কিন্তু তাঁর প্রকাশভঙ্গিতে থাকে দৃঢ়তা। চারপাশের অসংগতি আর অন্যায়, ঘটে যাওয়া অজস্র ঘটনায় তাঁর ভাবনার গভীরতা এই দৃঢ়তাকে তৈরি করে দেয়। ‘ক্রন্দনরতা জননীর পাশে’ কবিতাতেও আমরা দেখি বিপন্ন সময়ের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে কবি মনে করেন ঈশ্বর বিশ্বাসের কোনও জায়গা থাকে না, আধ্যাত্মিকতার কোনও স্থান নেই এই পৃথিবীতে। আকাশের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরের কাছে বিচার চাওয়া এখন নিতান্ত বাতুলতা, তাই গড়ে তোলা দরকার সমষ্টিগত এবং ব্যক্তিগত প্রতিবাদ। কবির কাছে সেই প্রতিবাদের বাহন হল কবিতা। অধ্যাপক অভীক মজুমদার এই কবিতা সম্পর্কে আলোচনায় লিখেছেন –‘কোনো বিশেষ দল, দলীয়তা নয়, একধরনের মানুষের আন্দোলন' বারংবার মৃদুলকে আলোড়িত করে, তাঁকে নাড়িয়ে দেয়।' দ্বাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি তাই সামাজিক অথবা রাজনৈতিক শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে তীব্র হয়ে ওঠে কবির প্রতিক্রিয়া। ‘ক্রন্দনরতা জননীর পাশে’ গিয়ে দাঁড়ান কবি। কান্নার অংশীদার হতে নয়, বরং কান্নার কারণগুলিকে খুঁজে নিয়ে নিজের ক্ষোভ আর যন্ত্রণাকে উগরে দিতে। তাই ভাইয়ের অর্থাৎ সহনাগরিকের মৃতদেহ দেখে তাঁর মনে ক্রোধের জন্ম হয়। জঙ্গলে নিখোঁজ মেয়ের ছিন্নভিন্ন শরীর দেখে কবির মনে হয় যে, এই বিনাশী সময়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিধির বিচার চাওয়া একেবারে অর্থহীন। আর সেই কারণেই নিজের মানবিক ভালোবাসা, সামাজিক দায়বদ্ধতা আর মূল্যবোধকে জাগিয়ে রাখতে কবিতাকে হাতিয়ার করেন কবি। কবিতার মাধ্যমে নিজের বিবেককে জাগিয়ে রাখেন মৃদুল। এই জাগরণে মানবতা থাকে, আবেগ থাকে, আর তার কাঠামোয় রাজনীতিও থাকে। কবিতায় নিজের বিবেক যা আসলে বারুদের মতো, তাকে মজুত করে রাখেন কবি বিস্ফোরণের প্রাক্‌-প্রস্তুতি হিসেবে। কারণ তিনিই তো অন্য একটি কবিতায় প্রশ্ন তুলেছেন— ‘বিস্ফোরণ ছাড়া কোনও ঘটনা সম্ভব?’ আর বিস্ফোরণ মানেই তো অবস্থার পরিবর্তন – কবি যার স্বপ্ন দেখেন নিরন্তর। ‘ক্রন্দনরতা জননীর পাশে’ কবিতায় নির্যাতিত মানুষদের থেকে কবি মুখ ফিরিয়ে না থাকতে পারার কথা বলেছেন। নিখোঁজ মেয়েটির ছিন্নভিন্ন শরীর জঙ্গলে দেখতে পেয়ে কবি নিজের কাছেই প্রশ্ন করেছেন— ‘আমি কি তাকাব আকাশের দিকে/বিধির বিচার চেয়ে?’ এবং তার উত্তরে নিজেই বিধির বিচারের জন্য অপেক্ষা করতে না পারার অক্ষমতার কথা জানিয়ে প্রশ্নোদ্ধৃত মন্তব্যটি করেছেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিধির বিচার চাওয়া একদিকে যেমন ঈশ্বর-নির্ভরতার প্রকাশ, তেমনি অন্যদিকে আত্মশক্তির অভাব ও অসহায়তাকেও নির্দেশ করে। কিন্তু মানুষের অধিকার যখন বিপন্ন হয়, বেঁচে থাকার সুস্থ পরিবেশ আর থাকে না, এমনকি রাষ্ট্রশক্তি নিজেকে নিরঙ্কুশ করতে তার নখ দাঁত বিস্তার করে—তখন ঈশ্বরের কাছে ন্যায়বিচার চেয়ে বসে থাকা আসলে অনাবশ্যক কালক্ষেপ। বিধির হাতে নিজেকে ছেড়ে দেওয়ার অর্থ শোষকের বা ক্ষমতাবানের অবাধ বিচরণের সুযোগ করে দেওয়া। মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ এবং সহানুভূতিশীল কবি তাই চেয়েছেন এই অত্যাচারীর আনুগত্য বর্জন করতে। এক একটি সামাজিক ঘটনাপ্রবাহ বা মানবিক লাঞ্ছনা কবির মধ্যে তাই ক্রোধের জন্ম দেয়। তাঁর কাছে এই ক্রোধই হয় সমাজের প্রতি ভালোবাসা, দায়বদ্ধতা আর মূল্যবোধের প্রকাশ। কবিতায় কবি জাগিয়ে তুলতে চান নিজের বিবেক। আধ্যাত্মিকতা বা বাস্তব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া নয়, কবি চান তাঁর কবিতাকে প্রতিবাদের অস্ত্র করে তুলতে। মৃদুল দাশগুপ্তের কবিতা মূলত বিষয়মুখী। কবি হিসেবে তিনি বিশ্বাস করেন — “কাঠ খোদাই-এর সঙ্গে কবিতার তফাত আছে সর্বদাই।” এবং “আঙ্গিক কিছুটা আকাশ থেকেই নেমে আসে।” এই মন্তব্যই স্পষ্ট করে দেয় মৃদুল দাশগুপ্তের কবিতা একেবারেই বিষয়প্রধান। সেই বিষয়কে রূপ দিতে গিয়েই তাঁর কবিতায় আঙ্গিক আসে অবধারিতভাবে। ‘ক্রন্দনরতা জননীর পাশে' কবিতাটিতে চারটি স্তবক আছে। প্রতি স্তবকে রয়েছে চারটি পংক্তি। তার মধ্যে প্রতিটি স্তবকের দ্বিতীয় আর চতুর্থ পংক্তিতে অন্ত্যমিল নিয়ে এসেছেন কবি। শোষণ আর রক্তাক্ততা কবির মধ্যে যে আবেগের জন্ম দিয়েছে, অন্ত্যমিলের নমনীয়তায় তাকেই আন্তরিকভাবে ধরতে চেয়েছেন কবি। সমগ্র কবিতাটি উত্তম পুরুষের জবানিতে লেখা। অশান্ত সময়ের মাঝখানে কবি নিজেকে দাঁড় করিয়ে প্রতিবাদকে প্রত্যক্ষ ও জীবন্ত করতে চেয়েছেন। ‘আমি’ এবং ‘আমার’ শব্দগুলি তাই ঘুরে-ফিরে আসে কবিতায়। কবিতাটির আর একটি লক্ষণীয় গঠনগত বৈশিষ্ট্য হল, প্রতিটি স্তবক শেষ হচ্ছে প্রশ্ন বা বিস্ময় চিহ্ন দিয়ে। যেন কবি চারপাশে উত্তর খুঁজছেন। আর তা খুঁজতে খুঁজতেই শেষ স্তবকে পৌঁছে যাচ্ছেন সিদ্ধান্তে। সেখানে ঘোষণা করে দিচ্ছেন কবিতায় বিবেক জাগিয়ে রাখার অঙ্গীকার। মৃদুল দাশগুপ্তের এই কবিতার আর একটি বিশেষত্ব হল— প্রতিবাদের কবিতা হলেও শব্দ ব্যবহারের মুনশিয়ানায় অদ্ভুত একটা গীতিকাব্যিক মেজাজও আলোচ্য কবিতায় নিয়ে এসেছেন কবি। কবিতার নামই তার নিদর্শন। “ক্রন্দনরতা জননীর পাশে / এখন যদি না থাকি / কেন তবে লেখা, কেন গান গাওয়া / কেন তবে আঁকাআঁকি?” বোধের সঙ্গে, অনুভূতির সঙ্গে মিলে এভাবেই প্রতিবাদের ভাষা বিশিষ্ট হয়ে ওঠে ‘ক্রন্দনরতা জননীর পাশে’ কবিতায়। সমাপ্ত। এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। লেখক পরিচিতি প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন। এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল। [addthis tool="addthis_inline_share_toolbox"] JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য – সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল লাইক করো – facebook পেজ সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা XII_Beng_Krondonrota_jononir_pashe_2
Class-12

ক্রন্দনরতা জননীর পাশে বিশদে আলোচনা

বাংলাদ্বাদশ শ্রেণি – ক্রন্দনরতা জননীর পাশে (বিশদে আলোচনা)

এর আগে ক্রন্দনরতা জননীর পাশে কবিতার সারসংক্ষেপ সম্পর্কে আলোচনা করেছি, এই পর্বে আমরাক্রন্দনরতা জননীর পাশে কবিতাটি বিশদে আলোচনা করবো।

মৃদুল দাশগুপ্তের ‘ক্রন্দনরতা জননীর পাশে’ কবিতাটি কবির সমাজভাবনার এক বলিষ্ঠ প্রকাশ। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, মৃদুল দাশগুপ্তের কবিতাকে বলেছেন ‘ব্যক্তিগত স্তর থেকে সামাজিক স্তরে যাওয়ার করিডোর বিশেষ। আর এই করিডোর থেকেই তিনি প্রত্যাঘাত হানেন। কাব্যে প্রবর্তন করতে চান সহিংস আধ্যাত্মিকতার রেওয়াজ।’ ‘ক্রন্দনরতা জননীর পাশে’ কবিতাতেও এই একই ভাবনার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। সমাজের এক অস্থির সময়ে শাসকেরা যখন তাদের দায়িত্ব ভুলে যায়, তাদের জনবিরোধী অবস্থানে দেশ হয় বিপন্ন—তখন সেই লাঞ্ছিত দেশবাসীর পাশেই দাঁড়াতে চান কবি।

শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীতের কাছে এই দায়বদ্ধতাই কবি প্রত্যাশা করেন —
কেন তবে লেখা, কেন গান গাওয়া,
কেন তবে আঁকাআঁকি?

দেশের মানুষ কবির ভাই। সেই ভাইয়ের মৃতদেহের দৃশ্য তাঁর মনে ক্রোধের জন্ম দেয়। এই সামাজিক ক্রোধ কবির কাছে ভালোবাসা, সমাজবদ্ধতা এবং মূল্যবোধের প্রতীক। জঙ্গলের মধ্যে নিখোঁজ মেয়ের ছিন্নভিন্ন শরীর দেখে প্রতিবাদে অস্থির হয়ে ওঠেন কবি। আকাশের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরের সুবিচারের জন্য অপেক্ষা করে থাকা তখন তাঁর কাছে অর্থহীন বলে মনে হয়। বরং সেইসময় নিজের কবিতাকে তিনি করে তোলেন প্রতিবাদের অস্ত্র। নিজের বিবেককে তিনি জাগিয়ে রাখতে চান কবিতার মধ্য দিয়ে। এভাবেই ‘ক্রন্দনরতা জননীর পাশে’ কবি দাঁড়ান নিজের কবিতাকে সঙ্গে নিয়েই।

শাসকের অত্যাচার, অমানবিকতা, নারী নিগ্রহের ঘৃণ্যতা প্রভৃতির বিরুদ্ধে তীব্রকণ্ঠ হয়ে ওঠে মৃদুল দাশগুপ্তের কবিতা। একদা মৃদুল লিখেছিলেন –

‘আমি মৃদুল দাশগুপ্ত, আমি আরব গেরিলাদের সমর্থন করি’

তিনি যখন নিহত ভাইয়ের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন, তখন তাঁর ক্রোধ হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। মানুষের প্রতি ভালোবাসা, দায়বদ্ধতা আর মূল্যবোধই তাঁর এই ক্রোধের উৎস। নিখোঁজ মেয়ের ছিন্নভিন্ন শরীর যখন জঙ্গলে পাওয়া যায়, তখন কবিতার মাধ্যমেই নিজের বিবেককে জাগিয়ে রাখতে চান কবি।

whats-app subscrition_jump-mag

যে অনুভূতি থেকে নজরুল লিখেছিলেন, ‘রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা / তাই লিখে যাই এ রক্ত লেখা’, কবি সেই একই প্রেরণা থেকেই লিখে চলেন প্রতিবাদধর্মী কবিতা। কবিতার মধ্যে জমিয়ে তোলেন প্রতিবাদের বারুদ, সামান্য আগুনের ছোঁয়াতেই যা থেকে নিশ্চিতভাবে ঘটে যাবে প্রতিবাদের বিস্ফোরণ। এই মৃত্যু, এই নারকীয় অত্যাচার প্রতিনিয়ত কবির দেশমাতাকে করে তোলে ‘ক্রন্দনরতা জননী’। আর কবি চান সেই জননীর পাশে দাঁড়াতে। এই পাশে দাঁড়ানো আসলে সেই দায়বদ্ধতা যা একজন কবি, শিল্পী বা গায়কের কাছে প্রত্যাশিত।

কবি বিশ্বাস করেন —
“সমস্ত কবিতাই জীবন ও জীবনযাপনের”

তাই জীবন যখন লাঞ্ছিত এবং রক্তাক্ত হয়, তখন তার পাশে দাঁড়ানোকেই তিনি কবির ধর্ম বলে মনে করেছেন। এই কবিতায় সময়কে অবলম্বন করে মহাসময়ে পৌঁছোতে চেয়েছেন কবি। সাধারণভাবে কবি মৃদুল উচ্চকণ্ঠে কথা বলেন না, কিন্তু তাঁর প্রকাশভঙ্গিতে থাকে দৃঢ়তা। চারপাশের অসংগতি আর অন্যায়, ঘটে যাওয়া অজস্র ঘটনায় তাঁর ভাবনার গভীরতা এই দৃঢ়তাকে তৈরি করে দেয়।

‘ক্রন্দনরতা জননীর পাশে’ কবিতাতেও আমরা দেখি বিপন্ন সময়ের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে কবি মনে করেন ঈশ্বর বিশ্বাসের কোনও জায়গা থাকে না, আধ্যাত্মিকতার কোনও স্থান নেই এই পৃথিবীতে।

আকাশের দিকে তাকিয়ে ঈশ্বরের কাছে বিচার চাওয়া এখন নিতান্ত বাতুলতা, তাই গড়ে তোলা দরকার সমষ্টিগত এবং ব্যক্তিগত প্রতিবাদ। কবির কাছে সেই প্রতিবাদের বাহন হল কবিতা। অধ্যাপক অভীক মজুমদার এই কবিতা সম্পর্কে আলোচনায় লিখেছেন –‘কোনো বিশেষ দল, দলীয়তা নয়, একধরনের মানুষের আন্দোলন’ বারংবার মৃদুলকে আলোড়িত করে, তাঁকে নাড়িয়ে দেয়।’


দ্বাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

তাই সামাজিক অথবা রাজনৈতিক শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে তীব্র হয়ে ওঠে কবির প্রতিক্রিয়া। ‘ক্রন্দনরতা জননীর পাশে’ গিয়ে দাঁড়ান কবি। কান্নার অংশীদার হতে নয়, বরং কান্নার কারণগুলিকে খুঁজে নিয়ে নিজের ক্ষোভ আর যন্ত্রণাকে উগরে দিতে। তাই ভাইয়ের অর্থাৎ সহনাগরিকের মৃতদেহ দেখে তাঁর মনে ক্রোধের জন্ম হয়। জঙ্গলে নিখোঁজ মেয়ের ছিন্নভিন্ন শরীর দেখে কবির মনে হয় যে, এই বিনাশী সময়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিধির বিচার চাওয়া একেবারে অর্থহীন।

আর সেই কারণেই নিজের মানবিক ভালোবাসা, সামাজিক দায়বদ্ধতা আর মূল্যবোধকে জাগিয়ে রাখতে কবিতাকে হাতিয়ার করেন কবি।

কবিতার মাধ্যমে নিজের বিবেককে জাগিয়ে রাখেন মৃদুল। এই জাগরণে মানবতা থাকে, আবেগ থাকে, আর তার কাঠামোয় রাজনীতিও থাকে। কবিতায় নিজের বিবেক যা আসলে বারুদের মতো, তাকে মজুত করে রাখেন কবি বিস্ফোরণের প্রাক্‌-প্রস্তুতি হিসেবে।

কারণ তিনিই তো অন্য একটি কবিতায় প্রশ্ন তুলেছেন—
‘বিস্ফোরণ ছাড়া কোনও ঘটনা সম্ভব?’

আর বিস্ফোরণ মানেই তো অবস্থার পরিবর্তন – কবি যার স্বপ্ন দেখেন নিরন্তর। ‘ক্রন্দনরতা জননীর পাশে’ কবিতায় নির্যাতিত মানুষদের থেকে কবি মুখ ফিরিয়ে না থাকতে পারার কথা বলেছেন। নিখোঁজ মেয়েটির ছিন্নভিন্ন শরীর জঙ্গলে দেখতে পেয়ে কবি নিজের কাছেই প্রশ্ন করেছেন—

‘আমি কি তাকাব আকাশের দিকে/বিধির বিচার চেয়ে?’

এবং তার উত্তরে নিজেই বিধির বিচারের জন্য অপেক্ষা করতে না পারার অক্ষমতার কথা জানিয়ে প্রশ্নোদ্ধৃত মন্তব্যটি করেছেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিধির বিচার চাওয়া একদিকে যেমন ঈশ্বর-নির্ভরতার প্রকাশ, তেমনি অন্যদিকে আত্মশক্তির অভাব ও অসহায়তাকেও নির্দেশ করে। কিন্তু মানুষের অধিকার যখন বিপন্ন হয়, বেঁচে থাকার সুস্থ পরিবেশ আর থাকে না, এমনকি রাষ্ট্রশক্তি নিজেকে নিরঙ্কুশ করতে তার নখ দাঁত বিস্তার করে—তখন ঈশ্বরের কাছে ন্যায়বিচার চেয়ে বসে থাকা আসলে অনাবশ্যক কালক্ষেপ।

whats-app subscrition_jump-mag

বিধির হাতে নিজেকে ছেড়ে দেওয়ার অর্থ শোষকের বা ক্ষমতাবানের অবাধ বিচরণের সুযোগ করে দেওয়া। মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ এবং সহানুভূতিশীল কবি তাই চেয়েছেন এই অত্যাচারীর আনুগত্য বর্জন করতে।

এক একটি সামাজিক ঘটনাপ্রবাহ বা মানবিক লাঞ্ছনা কবির মধ্যে তাই ক্রোধের জন্ম দেয়। তাঁর কাছে এই ক্রোধই হয় সমাজের প্রতি ভালোবাসা, দায়বদ্ধতা আর মূল্যবোধের প্রকাশ। কবিতায় কবি জাগিয়ে তুলতে চান নিজের বিবেক। আধ্যাত্মিকতা বা বাস্তব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া নয়,

কবি চান তাঁর কবিতাকে প্রতিবাদের অস্ত্র করে তুলতে।

মৃদুল দাশগুপ্তের কবিতা মূলত বিষয়মুখী। কবি হিসেবে তিনি বিশ্বাস করেন —

“কাঠ খোদাই-এর সঙ্গে কবিতার তফাত আছে সর্বদাই।”
এবং
“আঙ্গিক কিছুটা আকাশ থেকেই নেমে আসে।”

এই মন্তব্যই স্পষ্ট করে দেয় মৃদুল দাশগুপ্তের কবিতা একেবারেই বিষয়প্রধান। সেই বিষয়কে রূপ দিতে গিয়েই তাঁর কবিতায় আঙ্গিক আসে অবধারিতভাবে। ‘ক্রন্দনরতা জননীর পাশে’ কবিতাটিতে চারটি স্তবক আছে। প্রতি স্তবকে রয়েছে চারটি পংক্তি। তার মধ্যে প্রতিটি স্তবকের দ্বিতীয় আর চতুর্থ পংক্তিতে অন্ত্যমিল নিয়ে এসেছেন কবি। শোষণ আর রক্তাক্ততা কবির মধ্যে যে আবেগের জন্ম দিয়েছে, অন্ত্যমিলের নমনীয়তায় তাকেই আন্তরিকভাবে ধরতে চেয়েছেন কবি।

সমগ্র কবিতাটি উত্তম পুরুষের জবানিতে লেখা। অশান্ত সময়ের মাঝখানে কবি নিজেকে দাঁড় করিয়ে প্রতিবাদকে প্রত্যক্ষ ও জীবন্ত করতে চেয়েছেন। ‘আমি’ এবং ‘আমার’ শব্দগুলি তাই ঘুরে-ফিরে আসে কবিতায়। কবিতাটির আর একটি লক্ষণীয় গঠনগত বৈশিষ্ট্য হল, প্রতিটি স্তবক শেষ হচ্ছে প্রশ্ন বা বিস্ময় চিহ্ন দিয়ে। যেন কবি চারপাশে উত্তর খুঁজছেন। আর তা খুঁজতে খুঁজতেই শেষ স্তবকে পৌঁছে যাচ্ছেন সিদ্ধান্তে। সেখানে ঘোষণা করে দিচ্ছেন কবিতায় বিবেক জাগিয়ে রাখার অঙ্গীকার।

মৃদুল দাশগুপ্তের এই কবিতার আর একটি বিশেষত্ব হল— প্রতিবাদের কবিতা হলেও শব্দ ব্যবহারের মুনশিয়ানায় অদ্ভুত একটা গীতিকাব্যিক মেজাজও আলোচ্য কবিতায় নিয়ে এসেছেন কবি। কবিতার নামই তার নিদর্শন। “ক্রন্দনরতা জননীর পাশে / এখন যদি না থাকি / কেন তবে লেখা, কেন গান গাওয়া / কেন তবে আঁকাআঁকি?”

বোধের সঙ্গে, অনুভূতির সঙ্গে মিলে এভাবেই প্রতিবাদের ভাষা বিশিষ্ট হয়ে ওঠে ‘ক্রন্দনরতা জননীর পাশে’ কবিতায়।

সমাপ্ত।


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

XII_Beng_Krondonrota_jononir_pashe_2