bojhapora
WB-Class-8

বোঝাপড়া – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

শ্রেণিঃ অষ্টম | বিষয়: বাংলা । অধ্যায় – বোঝাপড়া (Bojhapora)

বোঝাপড়া কবিতার কবি পরিচিতি

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালে জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন অসামান্য প্রতিভার অধিকারী। কলকাতার বিরাট অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও বাল্যকালে চাকরদের মহলে অনাড়ম্বরেই কেটেছে তাঁর বাল্যকাল। শিশু বয়সে স্কুলে ভর্তি হলেও সেই বাঁধাধরা গতানুগতিক শিক্ষা তাঁকে আকর্ষণ করেনি। তাই শিক্ষাসহ আরো বিভিন্ন বিষয়ে বিদ্যালাভ তিনি করেন বাড়িতেই। তিনি ছিলেন কবি, গীতিকার, ছোট গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, চিত্রশিল্পী ইত্যাদি। তাঁর বিখ্যাত কিছু সৃষ্টি মানসী, গীতাঞ্জলী, কথা কাহিনী, ক্ষণিকা, শেষের কবিতা, গোরা, যোগাযোগ, ডাকঘর, তাসের দেশ আগামী প্রজন্মের কাছে অমোঘ বিস্ময়।

এই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রবিঠাকুর, ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলী কাব্যগ্রন্থের অনুবাদ ‘Song Offerings’ এর জন্য পেয়েছেন পৃথিবীর সেরা সাহিত্য সন্মান ‘নোবেল’।

ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা এই বিশ্বকবির আধ্যাত্মিকতা ও বেদান্ত ভাবনা তাঁর অসামান্য সাহিত্য কীর্তিগুলি আজও বহন করছে। পরাধীন ভারতের আকাশের এই উজ্বল নক্ষত্রের পতন ঘটে ১৯৪১ সালের ২২শে শ্রাবণ।

বোঝাপড়া কবিতার উৎস

পাঠ্যাংশের ‘বোঝাপড়া’ কবিতাটি ‘ক্ষণিকা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত।

বোঝাপড়া কবিতার সারাংশ

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা বোঝাপড়া চারটি স্তবকে বিভক্ত। কবিতার প্রতিটি স্তবকের সারমর্মে যাওয়ার আগে বলে রাখতে চাই এই বোঝাপড়া মানব মনের সাথে মস্তিস্কের বা আরো পরিস্কার করে বললে আবেগের সাথে বুদ্ধি বা যুক্তির।

প্রথম স্তবক

মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।
কেউ বা তোমায় ভালোবাসে
কেউ বা বাসতে পারে না যে,
কেউ বিকিয়ে আছে, কেউ বা
সিকি পয়সা ধারে না যে,
কতকটা যে স্বভাব তাদের
কতকটা বা তোমারো ভাই,
কতকটা এ ভবের গতিক–
সবার তরে নহে সবাই।
তোমায় কতক ফাঁকি দেবে
তুমিও কতক দেবে ফাঁকি,
তোমার ভোগে কতক পড়বে
পরের ভোগে থাকবে বাকি,
মান্ধাতারই আমল থেকে
চলে আসছে এমনি রকম–
তোমারি কি এমন ভাগ্য
বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম!
মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।

কবিতার শুরুতে কবি বলছেন সত্য সুন্দর, তা যেমনই হোক না কেন, ভাল-মন্দ মানুষের জীবনের অংশ। তাই প্রত্যেকটি মানুষেরই উচিত মনকে সত্যের দিকে চালনা করা। সত্যকে সহজে গ্রহণ করা। এই পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ ভিন্ন, কেউ ভালবাসতে জানে, কেউ হয়তো জানেনা; কেউ বা ধার-বাকিতে জীবন কাটায়, আবার কেউ কখনো ধার করেনা, তাই বলা চলে সকলের স্বভাবগত পার্থক্য রয়েছে। কিছু ঘটনায় সত্যি দোষ থাকে অন্যদের, আবার কিছুক্ষেত্রে দোষ আমাদের ব্যাক্তিগত স্বভাবেরও। কখনও কখনও আমরা-ওরার মধ্যে দোষ উভয়েরই থাকেনা, উভয়েই উভয়পক্ষকে ঠকিয়ে চলে। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে দোষগুণ সব কিছুই সবার মধ্যে বর্তমান। তাই কোনো ঘটনায় দুঃখ পেলে আমাদের মনকে বোঝানো উচিত সেই চিরন্তন সত্য- “ভাল-মন্দ সব কিছুকেই সহজভাবে গ্রহণ করা”।


অষ্টম শ্রেণির অন্য বিভাগ – গণিত | বিজ্ঞান | ইতিহাস

দ্বিতীয় স্তবক

অনেক ঝঞ্ঝা কাটিয়ে বুঝি
এলে সুখের বন্দরেতে,
জলের তলে পাহাড় ছিল
লাগল বুকের অন্দরেতে,
মুহূর্তেকে পাঁজরগুলো
উঠল কেঁপে আর্তরবে–
তাই নিয়ে কি সবার সঙ্গে
ঝগড়া করে মরতে হবে?
ভেসে থাকতে পার যদি
সেইটে সবার চেয়ে শ্রেয়,
না পার তো বিনা বাক্যে
টুপ করিয়া ডুবে যেয়ো।
এটা কিছু অপূর্ব নয়,
ঘটনা সামান্য খুবই–
শঙ্কা যেথায় করে না কেউ
সেইখানে হয় জাহাজ-ডুবি।
মনেরে তাই কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।

কবিতার দ্বিতীয় স্তবকে আমরা পাই, আরো কিছু দিক জীবনের। এই পার্থিব জগতে সবকিছুই ক্ষণিকের। সুখ-দুঃখ মিলিয়েই জীবন। সুখের রাস্তা মসৃণ হলেও তার আড়ালে আকস্মিক চ্যালেঞ্জ বহু সময়েই অপেক্ষা করে থাকে আমাদের জন্য। বহুক্ষেত্রেই মতানৈক্য আমাদের বন্ধু আত্মীয়স্বজন সকলের সাথে বিরোধ সৃষ্টি করে। কিন্তু সেখানে বিবাদ করা কি উচিত! না, কবিই আমাদের উপায় বাতলে দিচ্ছেন। এই পৃথিবীর সকল জীবকেই ভারসাম্যাবস্থায় চলতে হয়। কখনো হয়ত আমরা দুঃখ পাই, আবার কখনও সুখ। তবে কোনো কিছুতেই ডুবে যাওয়া উচিত নয়। সবচেয়ে বুদ্ধিমানের মত কাজ এই ক্ষণিকের জীবন নদীতে ভেসে থাকা আর তা না করতে পারলে কালের গহ্বরে চিরকালের জন্য ডুবে যাওয়াই হবে ভবিতব্য।

কবি আরো বলছেন শঙ্কাহীন জীবন হয়না তবে আমরা যা নিয়ে ভয়ে ডুবে থাকি জীবন কিন্তু তার নিয়মে চলে চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে অন্য কোনো দিক থেকে। তাই কবি আবারও বলছেন, অকাতরে সহজে ভাল-মন্দ সকল সত্যকে গ্রহণ করতে।

তৃতীয় স্তবক

তোমার মাপে হয় নি সবাই
তুমিও হও নি সবার মাপে,
তুমি মর কারো ঠেলায়
কেউ বা মরে তোমার চাপে–
তবু ভেবে দেখতে গেলে
এমনি কিসের টানাটানি?
তেমন করে হাত বাড়ালে
সুখ পাওয়া যায় অনেকখানি।
আকাশ তবু সুনীল থাকে,
মধুর ঠেকে ভোরের আলো,
মরণ এলে হঠাৎ দেখি
মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো।
যাহার লাগি চক্ষু বুজে
বহিয়ে দিলাম অশ্রুসাগর
তাহারে বাদ দিয়েও দেখি
বিশ্বভুবন মস্ত ডাগর।
মনেরে তাই কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।

কবিতার এই তৃতীয় স্তবকটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের দুঃখ, বিবাদ, একাকীত্ব ইত্যাদির মধ্যেও কবি যেন আশার আলো দেখাচ্ছেন তাঁর পাঠক-পাঠিকাদের। আমরা অনেক সময়েই নিজের মনের মত মানুষ না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ি, আমরা বুঝতে পারিনা যে আমরা প্রত্যেকেই অনন্য বা প্রত্যেকের মত। কেউ কারো মাপে না, আর তা হওয়াও সম্ভব না। আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যেকের সাথে যুক্ত এটাই এই মানবজাতির শক্তি। বিবাদ, বিরোধ ঝেড়ে ফেলে বাড়িয়ে দেওয়া বন্ধুত্বের হাত মেটাতে পারে অনেক সমস্যা। হয়ত সেখানে এক পা এগোতে আগে কাউকে হয়, কিন্তু সেই উদ্যোগ আমাদের জীবনের প্রতিটা ভোরকেই যেন আরো রঙিন করে তোলে। সেখানে অবসাদে ভোগা, রোজ মৃত্যুকে কামনা করা মানুষটাও যেন বুঝতে পারে জীবনের সৌন্দর্য।


অষ্টম শ্রেণির অন্য বিভাগ – বাংলা | ইংরেজি | ভূগোল

জীবনে কোনো কোনো মানুষের অনুপস্থিতি আমাদের দুঃখ দেয় ঠিকই। কিন্তু, তাকে বাদ দিয়েও এই পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধের কোনোরূপ পরিবর্তন হয়না। এই বিশ্ব তার বিরাট সম্পদের ঝুলি নিয়ে যেন দাঁড়িয়ে থাকে আমাদেরই অপেক্ষায়। তাই কবি বারেবারে আমাদের স্মরণ করাচ্ছেন সেই চিরন্তন সত্যের, ভালো মন্দ যাহাই আসুক,
সত্যরে লও সহজে।

চতুর্থ স্থবক

অস্তাচলে বসে বসে
আঁধার করে তোল যদি
জীবনখানা নিজের দোষে,
বিধির সঙ্গে বিবাদ করে
নিজের পায়েই কুড়ুল মার,
দোহাই তবে এ কার্যটা
যত শীঘ্র পার সারো।
খুব খানিকটে কেঁদে কেটে
অশ্রু ঢেলে ঘড়া ঘড়া
মনের সঙ্গে এক রকমে
করে নে ভাই, বোঝাপড়া।
তাহার পরে আঁধার ঘরে
প্রদীপখানি জ্বালিয়ে তোলো–
ভুলে যা ভাই, কাহার সঙ্গে
কতটুকুন তফাত হল।
মনেরে তাই কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে।

কবিতার শেষ স্তবকে এসে কবি তাঁর পাঠক-পাঠিকাদের তাই অবসাদগ্রস্ততা ঝেড়ে ফেলে ঘরের অন্ধকার থেকে বেড়িয়ে আসতে বলছেন। নিজের জীবনের দুঃখের জন্য পরমেশ্বরের সাথে বিবাদ না করে জীবনকে উপভোগ করতে বলেছেন। কান্নাকাটি করে মনের সাথে ‘বোঝাপড়া’ সেরে জীবন পথে আলো জ্বালিয়ে জীবনের এই যাত্রার সবটুকু আস্বাদ নেওয়ার অপর নামই জীবন, আর সেই জীবনে চলার মূল পাথেয়ই হল ‘সত্য’।

বোঝাপড়া কবিতার সরলার্থ

এই কবিতা এক জীবনমুখী কবিতা। সেই প্রাচীন যুগে রচিত মুন্ডক উপনিষদ পৃথিবীকে জানিয়েছিল ‘সত্যমেব জয়তে’। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, সত্যের জন্য সবকিছুকে ত্যাগ কর, কিন্তু কোনো কিছুর জন্যই সত্যকে ত্যাগ কোরোনা।”

এই কবিতায় কবিও এই সত্যেরই পূজা করেছেন। জীবন সুন্দর, আর সেই সৌন্দর্যের আসল চাবিকাঠি সকল পরিস্থিতিতে সত্যকে সহজে গ্রহণ করার মধ্যেই নিহিত।

কারণ, সত্য যেমনই হোক তা সুন্দর।

বর্তমান আত্মকেন্দ্রিক জীবনে বিবাদ, দুঃখ, বিচ্ছেদ, একাকীত্ব যেন এক নিত্যসঙ্গী। হতাশা-অবসাদে আত্মহত্যা থেকে সামান্য বিষয়ে মনোমালিন্য, বিবাদ আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্য। এর মাঝে জীবন কখন ফুরিয়ে যায় তা আমরা বুঝতেই পারিনা। তাই এই কবিতার প্রতি স্তবকে কবি মানব হৃদয়কে বলিষ্ঠ করার ডাক দিয়েছেন। জীবনের প্রতিটা সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস জুগিয়েছেন। প্রতিটি মানুষ যাতে অবসাদের নাগপাশ কেটে বেড়িয়ে এসে জীবনটাকে প্রাণ ভরে উপভোগ করতে পারে, সেই বাণী যেন দূরদর্শী রবিঠাকুর দিয়েছেন এই কবিতার মাধ্যমে।

সমাপ্ত। আরো পড়ো → চন্দ্রগুপ্ত নাটকের আলোচনা

লেখিকা পরিচিতিঃ

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত প্রত্যুষা মুখোপাধ্যায়। বিভিন্ন বিষয় চর্চার পাশাপাশি নাচ,গান, নাটকেও প্রত্যুষা সমান উৎসাহী।



এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

VIII_Beng_Bojhapora