podarther-obosthar-poriborton-kothinibhobon
WB-Class-8

পদার্থের অবস্থার পরিবর্তন (কঠিনীভবন)

শ্রেণিঃ অষ্টম | বিষয়: বিজ্ঞান । অধ্যায় – তাপ(দ্বিতীয় পর্ব)


আগের পর্বে আমরা জেনেছি তাপের পরিমাপ ও তার একক সম্পর্কে। এই পর্বে আমরা আলোচনা করবো পদার্থের অবস্থা পরিবর্তন ও লীনতাপের ধারণা সম্পর্কে।

আমরা আমাদের চারপাশে বিভিন্ন পদার্থকে কঠিন, তরল বা গ্যাসীয় অবস্থায় দেখতে পাই। এই পদার্থগুলি উপযুক্ত তাপের প্রভাবে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তিত হতে পারে।

পদার্থের অবস্থার পরিবর্তন কাকে বলা হয়?

তাপ প্রয়োগে বা নিষ্কাশনের ফলে কোন পদার্থের এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তরিত হতে পারে, যাকে পদার্থের অবস্থার পরিবর্তন বলা হয়।

লীনতাপ কাকে বলে?

তাপমাত্রা স্থির থেকে পদার্থের অবস্থান্তর ঘটানোর জন্য যে পরিমাণ তাপ গৃহীত বা বর্জিত হয় তাকে ঐ পদার্থের একক ভরের অবস্থার পরিবর্তনের লীনতাপ বলা হয়।

গলনাঙ্ক কাকে বলে?

কোন কঠিন পদার্থকে তাপ প্রয়োগ করা হলে এক সময় কঠিন পদার্থ গলে তরলে পরিণত হয়। পদার্থের কঠিন থেকে তরলে পরিণত হবার এই ঘটনাকে গলন বলে। এই গলন পারিপার্শ্বিক চাপের উপর নির্ভরশীল হয়।
নির্দিষ্ট চাপে কোন বিশুদ্ধ কঠিন পদার্থ যে উষ্ণতায় তরলে পরিণত হতে শুরু করে সেই নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বা উষ্ণতাকে ওই পদার্থের গলনাঙ্ক বলা হয়।

একইভাবে নির্দিষ্ট চাপে কোন বিশুদ্ধ তরল পদার্থ যে উষ্ণতায় জমে কঠিনে পরিণত হতে শুরু করে সেই উষ্ণতাকে ওই পদার্থের হিমাঙ্ক বলা হয়। পদার্থের তরল থেকে কঠিনে পরিণত হবার এই ঘটনাকে কঠিনীভবন বলা হয়।

যেকোন পদার্থের গলনাঙ্ক (Melting point) ও হিমাঙ্ক (Freezing point) পারিপার্শ্বিক চাপের উপর নির্ভরশীল।

প্রমাণ চাপ কাকে বলে?

আমরা জানি যে 76 সেন্টিমিটার পারদস্তম্ভের চাপকে প্রমাণ বায়ুমণ্ডলীয় চাপ বা প্রমাণ চাপ বলা হয়। এই প্রমাণ চাপে জলের হিমাঙ্ক 0˚C। একই ভাবে প্রমাণ চাপে বরফের গলনাঙ্ক 0˚C। যতক্ষণ পর্যন্ত পদার্থের গলন বা কঠিনীভবন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ না হয়, ততক্ষণ পদার্থের তাপমাত্রা অপরিবর্তিত থাকে।

সাধারণত প্রায় সকল কেলাসিত (crystalline) পদার্থের গলনাঙ্ক ও হিমাঙ্ক সমান সুনির্দিষ্ট হয়। যেমন¬– জল, লোহা, তামা, সোনা, পারদ প্রভৃতি।

জলের গলনাঙ্ক ও হিমাঙ্ক সুনির্দিষ্ট

তবে কয়েকটি এমন অকেলাসিত (Non–crystalline) পদার্থ দেখা যায়,
যাদের গলনাঙ্ক ও হিমাঙ্ক সমান নয় এবং এদের কোন নির্দিষ্ট গলনাঙ্ক নেই। যেমন- কাচ, চর্বি, মোম, মাখন প্রভৃতি। এগুলি গলনের পূর্বে একরকম থকথকে অবস্থায় উপনীত হয়।
যেমন– মাখন 28˚C থেকে 33˚C এর মধ্যে গলে যায়, আর 23˚C থেকে 20˚C এর মধ্যে জমে কঠিনে পরিণত হয়।

সাধারণ ভাবে কঠিন পদার্থ তরলে পরিণত হলে আয়তনে বাড়ে এবং তরল কঠিনে পরিণত হলে আয়তনে হ্রাস পায়। এই কারণের জন্যই তরল মোম জমে কঠিন হলে তার মধ্যে একটি গভীর খাঁজ সৃষ্টি হয়, কারণ মোম জমে কঠিন হবার সময় তার আয়তন সংকোচন ঘটে।

মোম জমে কঠিন হয়ে আয়তনে সংকুচিত হয়েছে

অন্যদিকে জল, পিতল, লোহা প্রভৃতি পদার্থ তরল থেকে কঠিন হলে আয়তন প্রসারিত হয় এবং কঠিন থেকে তরল অবস্থায় গেলে আয়তন সংকুচিত হয়। এই ধর্ম অনেক সুবিধা সৃষ্টি করে। মুদ্রা, মূর্তি প্রভৃতি বিভিন্ন প্রকার জিনিস তৈরির সময় তরল ধাতু ছাঁচের মধ্যে ঢেলে দেওয়া হয়। জমে কঠিন হবার সময় এরা আয়তনে বাড়ে এবং ছাঁচের সূক্ষ্ম খাঁজে ঢুকে যায়। ফলে নিখুঁত বস্তু তৈরি হয়।

কোন বস্তু তরল থেকে কঠিনে পরিণত হবার আয়তন বৃদ্ধি পেলে তার ঘনত্ব হ্রাস পায়। যেমন জলের তুলনায় বরফের ঘনত্ব 9% কমে হয়। এই কারণে বরফ জলে সম্পূর্ণ ডুবে যায় না, তার 1/10 ভাগ অংশ জলের উপরে থাকে।

হিমশৈলের ভাসমান অবস্থা; জলের নীচের অংশ ওপরের তুলনায় অনেক বেশি হয়

শীত প্রধান দেশে গভীর জলাশয়ের নীচে মাছ ও অন্যান্য জলচর প্রাণী কি ভাবে বেঁচে থাকে?

শীত প্রধান দেশে বা মেরু অঞ্চলে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জলাশয়ের জলের উপরিস্তর জমে বরফে পরিণত হয়। বরফ জল অপেক্ষা হালকা তাই জলের উপরতলে ভেসে থাকে। এছাড়া বরফ তাপের কুপরিবাহী বলে নীচের জল 4˚C থেকে খুব বেশি তাপ বায়ুতে পরিবাহিত হতে পারে না। ফলে গভীর জলাশয়ের নীচের জল তাপমাত্রায় তরল অবস্থায় থাকে। ফলে মাছ ও অন্যান্য জলচর প্রাণী প্রচণ্ড শীতেও বেঁচে থাকতে পারে।

জল বরফে পরিণত হলে আয়তন বেড়ে যায়— এই ঘটনার নানা অসুবিধাও আছে। শীত প্রধান দেশে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জলের পাইপের জল জমে বরফে পরিণত হয়। এর ফলে বরফের আয়তন বৃদ্ধি পায়, যার ফলে প্রচণ্ড বল সৃষ্টি হয় এবং পাইপ অনেক সময় ফেটে যায়।

একই কারণে শীতকালে পার্বত্য অঞ্চলে পাথরের খাঁজে জমে থাকা জল কঠিন বরফে পরিণত হয় এবং প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। এই প্রচণ্ড চাপের প্রভাবে পাথরে ফাটল সৃষ্টি হয় ও পাথর ভেঙে পড়ে। শীতের দেশে জমিতেও অনেক সময় এরকম ফাটল সৃষ্টি হয়, যা কৃষিকাজে সুবিধা সৃষ্টি করে।

কোন পদার্থের গলনাঙ্ক পদার্থের উপর চাপ ও পদার্থে বর্তমান অপদ্রব্য (Impurity)–এর উপর নির্ভর করে।

কোন পদার্থের গলনাঙ্ক চাপের সাথে পরিবর্তিত হয়। সোনা, রূপা, তামা প্রভৃতি যেসব পদার্থ কঠিন থেকে তরলে পরিণত হবার সময় আয়তনে বাড়ে, সেগুলির ক্ষেত্রে চাপ বাড়লে গলনাঙ্ক বৃদ্ধি পায়।

অর্থাৎ তারা আগের চেয়ে বেশি উষ্ণতায় গলে। এর কারণ হল, চাপ বৃদ্ধির ফলে পদার্থগুলির আয়তন বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়, তাই গলনাঙ্ক বৃদ্ধি পায়।

অন্যদিকে ঢালাই লোহা, পিতল, বরফ, বিসমাথ প্রভৃতি যে সব পদার্থ কঠিন থেকে তরলে পরিণত হলে আয়তন কমে যায়, তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় চাপ বাড়লে গলনাঙ্ক কমে যায়।
কারণ চাপ বাড়লে পদার্থের আয়তন কমে, যা গলনে সাহায্য করে।


অষ্টম শ্রেণির অন্য বিভাগ – বাংলা | ইংরেজি | গণিত | বিজ্ঞান

দুটি বরফের টুকরো হাতে নিয়ে জোরে চাপ দিলে টুকরো দুটি জোড়া লেগে যায়। এর কারণ হল চাপ প্রয়োগের ফলে বরফের স্পর্শকারী তল দুটির গলনাঙ্ক 0˚C এর থেকে কমে যায়। ফলে এই স্থানের বরফ গলে জল হয়ে যায়। চাপ সরিয়ে নিলে গলনাঙ্ক বেড়ে 0˚C হয়ে যায় এবং ওই জল জমে যায়। ফলে বরফের টুকরো দুটি জোড়া লেগে যায়।

চাপ প্রয়োগের ফলে বরফের গলে যাওয়া এবং চাপ সরিয়ে নিলে আবার তার কঠিন অবস্থায় ফিরে আসার এই ঘটনাকে পুনঃশিলীভবন বা Regelation বলা হয়।

এই একই কারণের জন্য বরফ ঢাকা রাস্তায় মোটর গাড়ি চললে তার টায়ারের ফাঁকে বরফ জমে থাকতে দেখা যায়। ঢাকা বিহীন স্লেজ গাড়িও বরফের উপর দিয়ে এই পদ্ধতিতে চলতে পারে।

কোন পদার্থের গলনাঙ্ক বা হিমাঙ্ক পদার্থে উপস্থিত অপদ্রব্য দ্বারা প্রভাবিত হয়। আমরা জানি, বরফের তাপমাত্রা 0˚C। কিন্তু তিনভাগ গুঁড়ো বরফের সাথে এবং একভাগ পরিষ্কার লবণ মেশানো হলে মিশ্রণের তাপমাত্রা হয় প্রায় -23˚C। এই প্রকার মিশ্রণ হিমমিশ্র নামে পরিচিত।

হিমমিশ্র বা Freezing mixture

দুটি পদার্থের মিশ্রণ, যাদের অন্তত একটি বা উভয়ই সাধারণ উষ্ণতায় গলে যায় এবং মিশ্রণের উষ্ণতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায় তাকে হিমমিশ্র বা Freezing mixture বলে। যেমন- সম পরিমাণ জল ও অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট তার তাপমাত্রা হয় -15˚C।

হিমমিশ্রের ব্যবহারিক প্রয়োগ

• মাছ, মাংস প্রভৃতি দূর স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য হিমমিশ্র দিয়ে ঢেকে রাখা হয়।
• কুলপি, বরফ, আইসক্রিম প্রভৃতি বানাতে বরফ–লবণ হিমমিশ্র ব্যবহার হয়।
• বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক কাজে হিমমিশ্র ব্যবহার করা হয়।

শীতের দেশে মোটর গাড়ির রেডিয়েটরের জল জমে বরফে পরিণত হয়, যা রেডিয়েটরের পাইপ ফাটিয়ে দিতে পারে।

এই কারণে শীতের দেশে রেডিয়েটরে জলের সাথে ইথিলিন গ্লাইকল (Ethylene Glycol) নামক অ্যালকোহল বা গ্লিসারিন মিশিয়ে দেওয়া হয়।

মিশ্রণের হিমাঙ্ক অনেক কম হওয়ায় রেডিয়েটরের জল জমে যায়না।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → বাষ্পীভবন ও স্ফুটন

এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখিকা পরিচিতিঃ

বিজ্ঞান স্নাতক এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষিতা নন্দিতা বসুর পেশা শিক্ষকতা।তিনি বই পড়তে বড় ভালোবাসেন। কাজের ফাঁকে, অবসরে, বাসে ট্রামে তো বটেই, শোনা যায় তিনি নাকি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও বই পড়তে পারেন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করতে ভুলো না।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –