dictetor-Bonaparte
WB-Class-9

স্বৈরাচারী ও সাম্রাজ্যবাদী নেপোলিয়ন

ইতিহাসনবম শ্রেণি – বিপ্লবী আদর্শ, নেপোলিয়নীয় সাম্রাজ্য ও জাতীয়তাবাদ (তৃতীয় পর্ব)

ফরাসী বিপ্লবের ফলেই উত্থান হয়েছিল নেপোলিয়নের, কিন্তু তিনি কি সেই বিপ্লবের প্রধান তিনটি আদর্শ; স্বাধীনতা, সাম্য এবং মৈত্রী-কে মেনে চলেছিলেন? সম্ভবত না।

এই পর্বে আমরা নেপোলিয়নের একনায়কচিত শাসনতন্ত্র (স্বৈরতান্ত্রিক) এবং তাঁর সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপ নিয়ে আলোচনা করবো।

স্বৈরাচারী নেপোলিয়ন

আগের পর্বগুলিতে আমরা জেনেছি যে ডাইরেক্টরির শাসন ব্যবস্থা উচ্ছেদের পরে নেপোলিয়নের নেতৃত্বে ফ্রান্সে শুরু হয় ‘কনসুলেটের’ শাসন। এই শাসন ব্যবস্থায় সেনানায়ক নেপোলিয়ন ‘প্রথম কনসাল’ রূপে নিযুক্ত হন। ফ্রান্সে শুরু হয় নেপোলিয়নের যুগ।

‘কনসুলেটের’ শাসন

১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে নেপোলিয়ন ‘প্রথম কনসাল’ রূপে দায়িত্ব নেবার পরে শাসন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার কাজ শুরু করেন। কনসুলেটের সংবিধান অনুযায়ী সংবিধানে তিনজন কনসাল রাখার সিদ্ধান্ত হয়। এরা দশ বছরের জন্য মনোনীত হন। এই তিনজনের মধ্যে প্রথম কনসাল সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।

কনসুলেটের শাসন
কনসুলেটের শাসন

সেই সময় ফ্রান্সের আইনসভা চারটি কক্ষে বিভাজিত ছিল – সেনেট, কাউন্সিল অফ স্টেট, ট্রিবিউনেট এবং লেজিসলেটিভ বডি।

কাউন্সিল অফ স্টেট আইনের প্রস্তাব রচনা করতো, ট্রিবিউনেট আইন প্রস্তাব আলোচনা করতো, লেজিসলেটিভ তা ভোট গ্রহণের দ্বারা গ্রহণ বা বর্জন করতো। সর্বোপরি সেনেট ঐ আইনের যৌক্তিকতা বিচার করে চূড়ান্ত অনুমোদন দিত অথবা বর্জন করতো। নতুন আইন বলবৎ করার দায়িত্ব নিয়োজিত হত কনসালদের উপরে। মনে রাখতে হবে সেনেটের এবং কাউন্সিল অফ স্টেটের সকল সদস্যরাই কিন্তু  জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হতেন না, তারা মনোনীত হতেন কনসালদের দ্বারা। এইভাবে আইন প্রণয়নের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই সম্পূর্ণভাবে দুর্বল করে দেওয়া হয়েছিল।

সবচেয়ে বড় ব্যাপার প্রথম কনসাল ‘কাউন্সিল অফ স্টেটের’ মাধ্যমে দেশের আইন রচনায় হস্তক্ষেপ করতে পারতেন এবং এর জন্য তাঁকে আইনসভার কাছে কোনরূপ জবাবদিহি করতে হতো না। অর্থাৎ এককথায় নেপোলিয়নের উপর দেশের কোন সাংবিধানিক নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এই ক্ষমতার ব্যাপক অপব্যবহার করেছিলেন নেপোলিয়ন।

তিনি তাঁর ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে প্রদেশের সমস্ত শাসকদের নির্বাচন প্রথাকে অবলুপ্ত করে মনোনয়ন প্রথা চালু করেন। এই ‘কনসুলেট’-এর সংবিধানের মাধ্যমে নেপোলিয়ন গণতন্ত্রের নামে একনায়কতন্ত্র চালু করেন।

প্রসঙ্গত, আমরা জানি যে একটি দেশের আইন প্রণয়ন এবং পরিচালনার দায়িত্ব থাকে সেই দেশের সরকারের। গণতন্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা হল জনসাধারণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার, যেমন ভারতবর্ষ, বাংলাদেশ ইত্যাদি। আর স্বৈরাচারী শাসনব্যাবস্থা হল কোন ব্যাক্তি বা একটি দল দ্বারা পরিচালিত সরকার, যিনি জনগনের দ্বারা নির্বাচিত নন, যেমন উত্তর কোরিয়া, চীন ইত্যাদি।

নেপোলিয়নের রাজ্যাভিষেক
নেপোলিয়নের রাজ্যাভিষেক

সম্রাট নেপোলিয়ন

‘কনসুলেটের শাসনের অতিকেন্দ্রিকতাও নেপোলিয়নকে খুশী করতে পারেনি।

১৮০২ খ্রিস্টাব্দে নেপোলিয়ন তাঁর প্রথম কনসালের পদকে যাবজ্জীবনের কনসাল পদে রূপান্তরিত করেন। এর পরে ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে ‘কনসুলেটের শাসন ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে তুলে দিয়ে নিজেকে ফ্রান্সের সম্রাট পদে অধিষ্ঠিত করেন।

তাঁর শাসন কালে দেশের সামগ্রিক আইনের উন্নতি হলেও, বিরোধীদের দমনের জন্য তিনি ‘লেতর দ্য ক্যাশে’ অর্থাৎ সন্দেহের বশে বিনা বিচারে গ্রেফতার করার ‘কালা আইন’ আবার ফিরিয়ে আনেন। শুধু তাই নয়, সংবাদপত্রের উপর সেন্সরশিপ আনা, বিরোধীদের উপর গুপ্তচর ব্যবহার করা ইত্যাদি আবার ফ্রান্সে ফিরে আসে।

এইভাবে ‘বিপ্লবের সন্তান’ নেপোলিয়ন বিপ্লবের গনতান্ত্রিক আদর্শকে তিলে তিলে হত্যা করে ‘একনায়কোচিত’ স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।

নেপোলিয়নের সিংহাসন

সাম্রাজ্যবাদী নেপোলিয়ন

মনে রাখতে হবে ফ্রান্সে বিপ্লবের ধ্বজা উড়লেও, ইউরোপে তখনও ‘পুরাতনতন্ত্র’ পুরোমাত্রায় চালু ছিল। নেপোলিয়ন ইউরোপের যে সকল দেশে তাঁর সাম্রাজ্যবিস্তার করেছেন সেখানেই ‘পুরাতনতন্ত্রের’ কাঠামো ভেঙে পড়ে। এই কারণে যেখানেই তার সেনাবাহিনী প্রবেশ করেছিল সেখানকার মানুষ তাঁকে ‘মুক্তিদাতা’ হিসাবে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।

নেপোলিয়ন শাসিত ফরাসী সাম্রাজ্য
নেপোলিয়ন শাসিত ফরাসী সাম্রাজ্য

তাঁর বিপ্লবী আদর্শের কথা মাথায় রেখে বিজিত দেশের জনসাধারণ তাঁর থেকে অনেককিছু আশা করেছিলেন; কিন্তু ক্রমশ তাঁদের হতাশা বৃদ্ধি পায়।

ইউরোপের অন্যতম তিন প্রধান শক্তি অস্ট্রিয়া, রাশিয়া এবং প্রুশিয়াকে পরাজিত করে তিনি বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন।

এই দেশগুলিকে তিনি পুনঃগঠন করেন এবং পুরানো শাসকদের ক্ষমতাচ্যুত করে তাঁর ঘনিষ্ঠদের ক্ষমতায় আনেন। যেমন হল্যান্ডে তাঁর ভাই লুই, ওয়েস্টফিলিয়ায় তাঁর আরেক ভাই জেরোম, নেপল্‌স-এ ভগ্নীপতি মুরাট, স্পেনে ভাই জোসেফ এবং ইতালিতে তাঁর সৎ পুত্র ইউজিনকে ক্ষমতায় বসান।


নেপোলিয়নের স্বৈরাচারী এবং সাম্রাজ্যবাদী শাসন ↓


তিনি নিজে জাতীয়তাবাদী আদর্শের কথা উল্লেখ করলেও, তিনি কিন্তু বিজিত দেশগুলিতে সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব দেখিয়েছিলেন। অর্থাৎ অন্য এক দেশের নাগরিক বা শাসক যখন অন্য একদেশের শাসক হয়ে ওঠেন তখন তাকে কোনভাবেই জাতীয়তাবাদী মনোভাব বলা যায় না।

এছাড়াও মাত্রাতিরিক্ত কর বৃদ্ধি এবং মহাদেশীয় অবরোধের ফলে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের ভাব বৃদ্ধি পায়।


[আরো পড়ো – ট্রাফালগারের যুদ্ধ এবং মহাদেশীয় অবরোধ]

নেপোলিয়নের এই একনায়কোচিত আচরণের ফলে বিজিত দেশগুলিতে ক্রমশ তাঁর সাম্রাজ্যবাদী ও স্বৈরাচারী মনোভাব প্রকাশ হয়ে ওঠে। ফলে তাঁর বিপ্লবী ভাবমূর্তি অস্বচ্ছ হয়ে যায়।

তৃতীয় পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → ইউরোপের পুনঃগঠন


নবম শ্রেণির অন্যান্য বিভাগগুলি দেখুন –



এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

IX-His-2c