lav-khoti-profit-and-loss
WB-Class-9

লাভ ও ক্ষতির ধারণা (Profit & Loss)

গণিতনবম শ্রেনি – লাভ ও ক্ষতি (প্রথম পর্ব)


পূবালীর কথা

নবম শ্রেণির ছাত্রী পূবালীর হাতের কাজ খুব ভালো। প্রতিবছর রাখীর সময় সে নিজে হাতে রাখী বানিয়ে ভাইদের পরায়। তার তৈরি রাখীগুলো খুব সুন্দর দেখতে হয় আর সবাই খুব প্রশংসা করে। তাই, এই বছর সে ঠিক করেছে তার বানানো কিছু রাখী সে বন্ধুদের মধ্যে বিক্রি করবে।

আগেই আমরা জেনেছি যে পূবালী নবম শ্রেণির ছাত্রী, তাই সে লাভ – ক্ষতির সমস্যার সমাধান করতে শিখেছে। পূবালীর খুব ইচ্ছা যে সে রাখী বিক্রির লাভের টাকায় পরিবারের সবাইকে মাটন বিরিয়ানি খাওয়াবে। এই ভাবনা নিয়ে সে অঙ্ক কষতে বসলো।

প্রথমেই সে হিসাব কষে দেখলো যে চার প্যাকেট মাটন বিরিয়ানির দাম 600 টাকা অর্থাৎ তাকে মোট 600 টাকা লাভ করলেই চলবে।

এবার সে রাখী তৈরির খরচ হিসাব করে দেখলো, যে তার একটা রাখী তৈরির খরচ হচ্ছে 30 টাকা

পূবালী হিসাব করে দেখলো যে সে যদি 20 টাকা লাভে 30টি রাখী বিক্রি করতে পারে তাহলেই তার চারটি মাটন বিরিয়ানির খরচ উঠে যাবে অর্থাৎ মোট লাভ 600 টাকা (20 × 30) হয়ে যাবে

সুতরাং, সে প্রতিটি রাখীর দাম সে 50 (30 + 20) টাকা ধার্য করলো এবং সে মোট 30 টি রাখী বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা রাখলো।

অঙ্ক কষার পরে পূবালী মনে মনে ভাবলো যে লাভ-ক্ষতি এতো সহজ একটা ব্যাপার আর তার কিনা পাঠ্য বইয়ের গাণিতিক সমস্যা সমাধানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়! যাইহোক ভাবনা ছেড়ে সে রাখী তৈরির প্রস্তুতি শুরু করে দিল।

লাভ ক্ষতির ধারণা

আমাদের জীবনে লাভ – ক্ষতির ধারণা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কেবলমাত্র ব্যবসায়ীদের জন্য নয়, যেকোন সাধারণ মানুষের জন্যই এই ধারণায় সিদ্ধিলাভ ভীষণ দরকারি।

আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে কথা বলার সময় দেখেছি যে বহু ছাত্রছাত্রী এই ধরনের সমস্যার সমাধান করতে হিমশিম খায়। এর কারণ দুটি, প্রথমত সুত্র মুখস্থ করা এবং দ্বিতীয়ত অঙ্কের মানে বুঝতে না পারা। আমারা এই পর্বে এই দুটি ব্যাপার সহজে তোমাদের বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করবো।

ক্রয়মুল্য বা উৎপাদন মুল্য কি?

কোন বস্তু বা পরিষেবা তৈরি করতে যে খরচ হয় তাকে উৎপাদন খরচ বলে যেমন পূবালীর রাখী তৈরির খরচ। আবার কিছু ক্ষেত্রে কোন বস্তু অন্য কারুর কাছ থেকে কিনে বিক্রয় করা হয়, যেমন সবজি বিক্রেতারা সবজির আড়ত থেকে সবজি কিনে আমাদের বিক্রি করেন, ঐ সবজি বিক্রেতা যে দামে আড়ত থেকে সবজি কেনেন তাকে ক্রয়মুল্য (চলতি ভাষায় একে কেনাদাম) বলা হয়।

বিক্রয়মুল্য কি?

কোন বস্তু বা পরিষেবা হস্তান্তর করার সময় যে দাম নেওয়া হয় তাকে বিক্রয়মুল্য বলা হয়। যেমন পূবালী তার তৈরি করা রাখী যদি তার বান্ধবী মিতালিকে 50 টাকায় বিক্রি করে সেক্ষেত্রে ঐ রাখীর বিক্রয়মুল্য 50 টাকা হবে।

লাভ বা ক্ষতি কি?

যদি ক্রয়মুল্য বা উৎপাদন মুল্য, বিক্রয়মুল্যের থেকে কম হয় তাহলে তাকে লাভ বলা হয়। আর যদি ক্রয়মুল্য বা উৎপাদন মুল্য, বিক্রয়মুল্যের থেকে বেশি হয় তাহলে তাকে ক্ষতি বলা হয়।

উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, যদি পূবালী তার রাখী 50 টাকায় বিক্রি করে সেক্ষেত্রে তার 20 টাকা লাভ হয়। (উৎপাদন মুল্য 30 টাকা যা বিক্রয়মুল্য 50 টাকার থেকে 20 টাকা কম)

আবার, কোন কারণে যদি পূবালী তার রাখী 25 টাকায় বিক্রি করে সেক্ষেত্রে তার 5 টাকা ক্ষতি হয় । (উৎপাদন মুল্য 30 টাকা যা বিক্রয়মুল্য 25 টাকার থেকে 5 টাকা বেশি)।

লাভ – ক্ষতির সম্পর্ক

উপরের উদাহরণ থেকে একটা ব্যাপার বোঝা যাচ্ছে যে ক্রয়মূল্য ও বিক্রয়মুল্যের মধ্যেকার সম্পর্ক থেকেই লাভ ও ক্ষতি পাওয়া যায়।

বিক্রয় মুল্য – উৎপাদন মুল্য বা ক্রয়মুল্য = লাভ (প্রথম সুত্র)

উৎপাদন মুল্য বা ক্রয়মুল্য – বিক্রয়মুল্য = ক্ষতি (দ্বিতীয় সুত্র)

এই সুত্র দুটি না বুঝে মুখস্থ করার কোন প্রয়োজন নেই। এটা সহজ ভাবে মনে রাখার জন্য এই কৌশলটি ব্যবহার করো-

ধরো বাজার থেকে তুমি একটা কলম 10 টাকায় কিনেছ এবং কোন এক বন্ধুকে 12 টাকায় বিক্রি করেছ। এক্ষেত্রে তোমার লাভ তোমার লাভ 12 – 10 = 2 টাকা (প্রথম সুত্র)

আবার, ধরো কোন কারণে ঐ 10 টাকা দামে কেনা কলম তুমি 8 টাকায় বিক্রি করে দিলে। এক্ষেত্রে তোমার ক্ষতি 10 – 8 = 2 টাকা (দ্বিতীয় সুত্র)

শতকরা লাভ ও শতকরা ক্ষতি

আমারা আগের শ্রেণিতে জেনেছি যে কোন সংখ্যার সম্পর্ককে 100 এর নিরিখে পরিমাপ করাকে শতকরা বলা হয়। আমরা সাধারণত লাভ বা ক্ষতি বোঝার জন্য শতকরা হিসাব ব্যবহার করি।

শতকরা লাভ

এই সুত্রে আসার আগে আমরা তোমার কলম বিক্রির উদাহরণটি আরো একবার দেখেনি।

তুমি যখন 10 টাকায় কেনা কলমটি 12 টাকায় বিক্রি করেছ তখন তোমার লাভ হয়েছে 2টাকা। এই 2 টাকা লাভের ভিত্তি হল 10 টাকা বা তোমার কেনা দাম।

সুতরাং, শতকরা লাভের হিসাব বের করতে হলে তা কেনা দামের উপর করতে হবে।

\frac{2}{10}\times 100 = 20% লাভ

এই সমস্যাটিকে এবার সুত্রের আকারে দেখা যাক।

profit-percentage

এবার, প্রথম সুত্র থেকে লাভের বিশ্লেষণ থেকে পাই।

profit-percentage-2 (তৃতীয় সূত্র)



শতকরা ক্ষতি

আমরা আবার কলমের উদাহরণে ফিরে যাই, তুমি যখন 10 টাকা দামে কেনা কলম 8 টাকায় বিক্রি করে দিলে। সেক্ষেত্রে তোমার ক্ষতি হয়েছিল 10 – 8 = 2 টাকা। এই 2 টাকা ক্ষতির ভিত্তি হল 10 টাকা বা তোমার কেনা দাম।

সুতরাং, এক্ষেত্রেও শতকরা ক্ষতির হিসাব বের করতে হলে তা কেনা দামের উপরই করতে হবে।

\frac{2}{10}\times 100 = 20% ক্ষতি

এই সমস্যাটিকে এবার সুত্রের আকারে দেখা যাক।

loss_percentage

এবার, দ্বিতীয় সুত্র থেকে ক্ষতির বিশ্লেষণ থেকে পাই।

loss_percentage_2(চতুর্থ সূত্র)

[বিশেষ দ্রষ্টব্য – এই সুত্রগুলিকে না বুঝে মুখস্থ করলে গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে সমস্যা হবেই। তাই না বুঝে এগুলি মুখস্ত করা একেবারেই উচিৎ নয়।]

কয়েকটি গাণিতিক সমস্যার সমাধান

এই বিষয়ে আসার আগে আমরা আরো একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। লিখিত গাণিতিক সমস্যার (word based mathematical problems) সমাধান করার ক্ষেত্রে নিজেকে সমস্যার বিশ্লেষণ করে সমীকরণ গঠন করতে হয়। তাই এই ধরনের অঙ্কগুলি করার সময় ছাত্রছাত্রীরা সমস্যার সম্মুখীন হয়।

আমাদের পরামর্শ –  লিখিত গাণিতিক সমস্যার (যেমন লাভক্ষতি, রৈখিক সহ সমীকরণ ইত্যাদি) ক্ষেত্রে লাইন প্রতি বিশ্লেষণ করে মূল সমস্যার সমাধান করা উচিৎ। আমরা এই বিষয়ে এখন আলোচনা করবো।

প্রথম উদাহরণঃ সুবীরকাকা 176 টাকা মুল্যে একটি ঘড়ি বিক্রি করেছেন। যদি ঘড়ি বিক্রি করে সুবীরকাকার 12% ক্ষতি হয়, তাহলে হিসাব করে দেখি তিনি কত টাকায় ঘড়িটি কিনেছিলেন।

সমাধান

সমস্যাটি পড়ে আমরা বুঝতে পারলাম যে আমাদের ঘড়িটির ক্রয়মুল্য বের করতে হবে।

সুতরাং অঙ্কের শুরুতেই আমরা ঘড়ির ক্রয়মূল্য ধরে নিলাম x।

এবার প্রতিটা লাইনকে আমরা গাণিতিক ভাবে প্রকাশের চেষ্টা করবো।

[প্রথম লাইন –   সুবীরকাকা 176 টাকা মুল্যে একটি ঘড়ি বিক্রি করেছেন।]

∴ সুবীরকাকার ঘড়ির বিক্রয় মুল্য = 176 টাকা

[দ্বিতীয় লাইন – যদি ঘড়ি বিক্রি করে সুবীরকাকার 12% ক্ষতি হয়]

প্রশ্নানুসারে, ঘড়ি বিক্রি করে শতকরা ক্ষতি = 12%

[আমরা ঘড়ির ক্রয়মুল্য এবং বিক্রয়মূল্য জানি সুতরাং শতকরা ক্ষতি কষে নিতে পারবো]

\frac{x-176}{x}\times 100 = শতকরা লাভ [তৃতীয় সূত্র ব্যবহার করে পাই]

প্রশ্নানুসারে,\frac{x-176}{x}\times 100 =12

\implies 100x -17600 = 12x

\implies 100x - 12x = 17600

\implies 88x = 17600

\implies x = \frac{17600}{88}

\implies x= 200

সুতরাং, ঘড়িটির ক্রয়মূল্য 200 টাকা।



দ্বিতীয় উদাহরণঃ নিয়ামতচাচা প্রতিটি 5 টাকা দরে 150টা ডিম কিনেছেন। কিন্তু দোকানে এসে দেখলেন 8টি ডিম ফেটে গেছে এবং 7টি ডিম পচা। প্রতিটি ডিম 6 টাকা দরে বিক্রি করলে নিয়ামতচাচার শতকরা কত লাভ বা ক্ষতি হবে?

[প্রথম লাইন – নিয়ামতচাচা প্রতিটি 5 টাকা দরে 150টা ডিম কিনেছেন। সুতরাং 150 টি দিমের ক্রয়মূল্য হল 150 × 5]

সবকটি ডিমের ক্রয়মূল্য = 150 × 5 = 750 টাকা।

[দ্বিতীয় লাইন – কিন্তু দোকানে এসে দেখলেন 8টি ডিম ফেটে গেছে এবং 7টি ডিম পচা। অর্থাৎ মোট 15 টি ডিম বতিল হয়েছে।]

যেহেতু 15টি ডিম বাতিল হয়েছে তাই নিয়ামতচাচার কাছে এখন 135টি (150 – 15) বিক্রয়যোগ্য ডিম আছে।

[তৃতীয় লাইন – প্রতিটি ডিম 6 টাকা দরে বিক্রি করলে নিয়ামতচাচার শতকরা কত লাভ বা ক্ষতি হবে? অর্থাৎ তিনি 135 টি ডিম প্রতিটি 6 টাকা দরে বিক্রি করেছেন। এই বিক্রয়মুল্যের সাপেক্ষে আমাদের শতকরা লাভ বা ক্ষতি কষে নিতে হবে।]

ডিমের মোট বিক্রয়মুল্য = 135 × 6 টাকা = 810 টাকা

আমরা প্রথমেই জেনেছি যে মোট ক্রয়মূল্য ছিল 750 টাকা; সুতরাং তিনি লাভ করেছেন।

মোট লাভ = 810 টাকা – 750 টাকা = 60 টাকা

সুতরাং শতকরা লাভ =  \frac{60}{750}\times 100

= 8%

সুতরাং, নিয়ামতচাচার শতকরা 8শতাংশ লাভ হয়েছে।



তৃতীয় উদাহরণঃ রবীনকাকু 36000 টাকার চাল কিনলেন। তিনি 1/3 অংশ 20% ক্ষতিতে এবং 2/5 অংশ 25% লাভে বিক্রি করলেন। শতকরা কত লাভে তিনি বাকি অংশ বিক্রি করলে তাঁর মোটের উপর 10% লাভ হবে?

[প্রথম লাইন –রবীনকাকু 36000 টাকার চাল কিনলেন। অর্থাৎ তাঁর মোট ক্রয়মুল্য হল 36000 টাকা]

চালের মোট ক্রয়মুল্য হল 36000 টাকা।

[দ্বিতীয় লাইন – তিনি 1/3 অংশ 20% ক্ষতিতে এবং 2/5 অংশ 25% লাভে বিক্রি করলেন।]

প্রশ্ন অনুযায়ী, রবিনকাকু 1/3 অংশ 20% ক্ষতিতে বিক্রি করেছেন।

সুতরাং, 36,000 টাকার 1/3 অংশ হল → 36000\times \frac{1}{3}=12000 টাকা

রবিনকাকু এই 12,000 টাকা ক্রয়মূল্যের চাল 20% ক্ষতিতে বিক্রি করেছেন। সুতরাং এক্ষেত্রে তাঁর বিক্রয়মুল্য হল → 12000 - \left (12000\times \frac{20}{100} \right )= 9600 টাকা।

এবার, বাকি চালের 2/5 অংশ 25% লাভে বিক্রি করেছেন।

বাকি থাকা চালের মুল্য = 36000 – 12000 = 24000 টাকা।

সুতরাং বিক্রিত চালের অংশ → 24000 \times \frac{2}{5} = 9600 টাকা।

এই 9600 টাকার চাল উনি 25% লাভে বিক্রি করেছেন।

সুতরাং, ঐ চালের বিক্রয় মুল্য হল → 9600 + \left ( 9600 \times \frac{25}{100} \right )= 12000 টাকা।

রবিনকাকু 12000 এবং 9600 টাকার চাল বিক্রি করেছেন। তাঁর কাছে থাকা অবিক্রিত চালের পরিমাণ হল → 36000 – (12000 + 96000) = 14400 টাকা।

প্রশ্ন অনুযায়ী, রবিনকাকু মোট 10% লাভ করতে চান।

সুতরাং, মোট প্রয়োজনীয় লাভ → 36000 \times \frac{10}{100} = 3600 টাকা।

তাহলে, রবিনকাকুকে 14400 টাকা মুল্যের চালে 3600 টাকা লাভ করলেই মোটের উপর 10% লাভ হবে।

সুতরাং, অবিক্রিত চালের উপরে প্রয়োজনীয় লাভ →  \frac{3600}{14600}\times 100=25%

সুতরাং, বাকি অংশ রবিনকাকুকে 25% লাভে বিক্রি করতে হবে।

[বিশেষ দ্রষ্টব্য – তৃতীয় ব্র্যাকেটের মধ্যে দেওয়া মন্তব্যগুলো শুধুমাত্র তোমাদের বোঝাবার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে, অঙ্ককষার সময় এগুলি উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই]

আশা করছি লাভ ও ক্ষতির ধারণা তোমাদের অনেকটাই পরিষ্কার হয়েছে। এর পরবর্তী পর্বে ধার্যমুল্য এবং ছাড়ের ধারণা নিয়ে আলোচনা করা হল।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –