akashe-satti-tara
WB-Class-9

আকাশে সাতটি তারা

বাংলানবম শ্রেণি – আকাশে সাতটি তারা (পদ্য)

কবি পরিচিতি

বাংলা কবিতার ধারায় রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী প্রজন্মের অন্যতম মহৎ কবি জীবনানন্দ দাশ। ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশালে (অধুনা বাংলাদেশে) জন্মগ্রহণ করেন জীবনানন্দ দাশ। তাঁর পিতা সত্যানন্দ দাশ বরিশালের ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তাছাড়াও সত্যানন্দ দাশ ‘ব্রহ্মবাদী’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। জীবনানন্দ দাশের মাতা কুসুমকুমারী দেবী ছিলেন সেকালের অন্যতম লেখিকা।

‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে

কথায় না বড়ো হয়ে কাজে বড়ো হবে’

এই কবিতাটা কে না পড়েছি আমরা। এটি কুসুমকুমারী দেবীরই লেখা।

১৯১৭ সালে শ্রী জীবনানন্দ ব্রজমোহন কলেজ থেকে আই.এ পাশ করেন এবং ১৯১৯ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বি.এ পাশ করেন। তাঁর কর্মজীবন খুব একটা স্থিতিশীল ছিল না। প্রথমে ১৯২২ সালে সিটি কলেজের চাকরি, তারপর সেখান থেকে বরখাস্ত হয়ে দিল্লির রামযশ কলেজে অধ্যাপনার কাজ পান। সেই চাকরিও থাকেনি বেশিদিন।


আরো পড়ো → আর্কিমিডিসের সূত্র সহজে বুঝে নাও

গৃহশিক্ষকতা আর চরম অনটনে কেটেছে তাঁর জীবন। ১৯৫২ সালে ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের জন্য নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলন কর্তৃক পুরস্কৃত হন তিনি। যদিও তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ছিল ‘ঝরা পালক’ (১৯২৭)। অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ (১৯৩৬), ‘মহাপৃথিবী’ (১৯৪৪), ‘সাতটি তারার তিমির’ (১৯৪৮), ‘রূপসী বাংলা’ (১৯৫৭), ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ (১৯৬১) ইত্যাদি। জীবৎকালে তাঁর খুব কম কবিতাই প্রকাশিত হয়েছে। মৃত্যুর এত বছর পরেও তাঁর বহু কবিতা এখনও অনাবিষ্কৃত। ১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর ট্রামের ধাক্কায় আহত হয়ে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ভর্তি হন এবং ২২ অক্টোবর সেখানেই মারা যান তিনি।

আকাশে সাতটি তারা কবিতার আলোচনা দেখে নাও এই ভিডিও থেকে↓


আকাশে সাতটি তারা কবিতার উৎস

আলোচ্য কবিতাটি জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থের অংশ, ক্রমানুসারে 6 নং কবিতা। ‘রূপসী বাংলা’র সমস্ত কবিতাতেই ঘুরে ফিরে আসে বাংলার নদী-মাঠ-প্রকৃতির প্রতি কবির অন্তরের টান, বিচ্ছেদ বেদনায় কাতর কবি বাংলার রূপ ফিরে পেতে চান। দিল্লির রামযশ কলেজে থাকাকালীন এই কবিতাগুলি তিনি লিখেছিলেন। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ পেয়েছে কবির মৃত্যুর পরে এবং সকলের জ্ঞাতার্থে বলা যায় যে কাব্যগ্রন্থের এই ‘রূপসী বাংলা’ নামকরণ কবির নিজের নয়, নামকরণ করেছিলেন তাঁর ভাই অশোকানন্দ দাশ। জীবনানন্দ পাণ্ডুলিপিতে নাম দিয়েছিলেন ‘বাংলার ত্রস্ত নীলিমা’।


নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

আকাশে সাতটি তারা কবিতার সারাংশ

সনাতন পল্লী বাংলার এক শান্ত সমাহিত সন্ধ্যার চিত্রকল্প ফুটে উঠেছে এই কবিতায়। আকাশে সাতটি তারা আসলে সপ্তর্ষিমণ্ডল। বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে কবি বাংলার প্রকৃতিকে পৃথক করে দেখেন না, নিজেকেও মনে করেন ব্রহ্মাণ্ডের অংশ। সেই সাতটি তারা আকাশে ফুটে উঠলে কবি ঘাসের উপর বসে থাকেন। পল্লীবাংলার চিরন্তন সান্ধ্য-শোভা মন ভরে দেখতে থাকেন তিনি। পড়ন্ত গোধূলিবেলায় সূর্য অস্ত যায়, আকাশের মেঘ যেন লাল কামরাঙার মতো হয়ে উঠে গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে যায়। কবির মনে হয় যেন এক মৃত মনিয়ার রক্তে সাগরের জল লাল হয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে সূর্যের শেষ আভাটুকুও মিলিয়ে যায়, আলো-আঁধারিতে শান্ত নিস্তব্ধ নীল সন্ধ্যা নেমে আসে গ্রামবাংলায়।

কবির মনে হয় যেন আকাশে কোনো কেশবতী কন্যা এসেছে। আকাশের কালো রঙ আর কেশবতী কন্যার খোলা চুল চিত্রকল্পে একাকার হয়ে যায়। কবি তার স্পর্শ অনুভব করেন। কেশবতী কন্যার চুল তার মুখের ওপর, চোখের উপর ভাসে। আসলে এই কেশবতী কন্যা হলো গ্রামবাংলার সান্ধ্যকালীন রূপ। কবি এই স্নিগ্ধ রূপ যেভাবে অনুভব করেছেন, তা আর কোথাও অনুভব করেননি। বাংলার প্রকৃতি, হিজল-কাঁঠাল-জাম প্রভৃতি গাছের পাতাও এই কন্যার চুলের স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হয়নি। কবি শুধু এই রূপসী কন্যার চুলের স্পর্শ অনুভব করেননি, তাঁকে মোহিত করেছে রূপসীর চুলের গন্ধও, যা পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই।

ধানের নরম গন্ধ থেকে কলমি শাক, হাঁসের ভেজা পালক, শরের মৃদু গন্ধ, পুকুরের জলের সোঁদা গন্ধ, চাঁদা-সরপুঁটি প্রভৃতি মাছের আঁশটে গন্ধ, এমনকি কিশোরী মেয়ের চালধোয়া ভিজে ঠাণ্ডা হাতের গন্ধ তিনি অনুভব করেছেন। সন্ধ্যেবেলায় কিশোর যখন বাড়ি ফিরেছে ঘাসের উপর দিয়ে, সেই কিশোরের পায়ে দলা মুথা ঘাসের গন্ধ কবি টের পেয়েছেন। তিনি ব্যথিত হয়েছেন লাল লাল বটের ক্লান্ত নীরব গন্ধে। সৌন্দর্য ও মধুময় ঘ্রাণে মনকে মোহিত করার মতো একটা আমেজ তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে কবি খুঁজে পেয়েছেন বাংলার প্রাণকে।

এইভাবে কবি সহজ-সরল গ্রাম্য প্রকৃতি আর মানুষের মধ্যেই তিনি তার রূপসী বাংলাকে খুঁজে পেয়েছেন, ভালোবেসেছেন তাঁর রূপসী বাংলাকে।


নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

মূল বক্তব্য

রূপসী বাংলার গুণমুগ্ধ কবির দৃষ্টিতে গ্রামীণ বাংলার বুকে ঘনায়মান সন্ধ্যার এক অপরূপ চিত্র ফুটে উঠেছে। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা আর দ্রুত নগরায়ণের পরিস্থিতে ‘রূপসী বাংলা’র কবিতাগুলি হয়ে উঠেছিল প্রাচীন পল্লী বাংলার স্মৃতিচিত্র।

জীবনানন্দের এই কবিতাটিও বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য, সনাতন রূপ-লাবণ্য ফুটিয়ে তুলেছে নানা অনুষঙ্গ, উপমা এবং চিত্রকল্পে। কবি এক কিশোরী রূপসীর চুলের সোহাগ চুম্বন উপলব্ধি করেন। বাংলার বুকে শান্ত নিবিড় সন্ধ্যা নেমে আসলে বাংলার প্রকৃতির মহৎ রূপ কবির কাছে উন্মোচিত হয়। প্রতিটি তুচ্ছ ধুলিকণাও কবির পরম মমতায় জীবিত হয়ে ওঠে, বাংলার প্রতি কবির গভীর মমত্ববোধ এবং ভালোবাসা এই কবিতার প্রাণ। কেশবতী কন্যা যেন বাংলার প্রকৃতিরই প্রত্নপ্রতিমা। সব মিলিয়ে এই কবিতাটি বাংলার চিরন্তন পল্লী প্রকৃতির প্রতি কবির গভীরতর ভালোবাসার এক দৃষ্টান্ত।


আরো পড়ো → পশ্চিমবঙ্গের কৃষিকাজ নবম শ্রেণি ভূগোল

‘আকাশে সাতটি তারা’ – নামকরণের সার্থকতা

যে-কোনো কবিতার নামকরণ তার বিষয়ের গভীর অর্থকে প্রকাশ করে। কখনও তা হয় রূপকধর্মী আবার কখনো তা হয় ব্যঞ্জনাধর্মী। কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থের কোনো কবিতার নামকরণ করেননি। শ্রদ্ধেয় সংকলকগণ এই নামকরণ করেছেন। আমাদের আলোচ্য বিষয় ‘আকাশে সাতটি তারা’ নামকরণের সার্থকতা কতখানি বজায় আছে।

কবি এই কবিতায় প্রকৃতি চেতনার গভীরে ডুব দিয়েছেন। ঘাসের উপর বসে সন্ধ্যা সমাগমকে লক্ষ্য করেছেন। আকাশে যখন প্রথমবার সাতটি তারা ফুটে উঠেছে, কবি সন্ধ্যার আগমনকে বুঝতে পেরেছেন। সূর্যাস্ত পরবর্তী আকাশের কামরাঙা লাল মেঘ, তাঁকে মনে করিয়েছে মৃত মনিয়া বা গঙ্গা সাগরের জলের অতলে ডুবে যাওয়া বিসর্জিত কন্যাকে। পল্লীগ্রামে শান্ত-অনুগত নীল সন্ধ্যা নেমে আসে। এই চঞ্চলতা হীন, ধীর অথচ সপ্রতিভ অন্ধকার কবিমনে কেশবতী কন্যার চুলের কল্পনা ফুটে ওঠে। তাঁর চোখের উপর, মুখের উপর নেমে আসে অন্ধকার, কবি অনুভব করেন বাংলার অতি পরিচিত হিজল-কাঁঠাল-জাম গাছ সেই কেশবতী কল্পিত কন্যার চুলের স্পর্শে আচ্ছাদিত হয়। সন্ধ্যার স্নিগ্ধ গন্ধে কবি ডুব দেন। কবি নূতন করে খুঁজে পান গ্রাম বাংলার সাধারণ অথচ অসাধারণ গন্ধকে। কিশোরীর কিশোরীর ভিজে হাত, কিশোরের পায়ে দলা মুথাঘাস, লাল লাল বটের ফলে ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত নীরবতা কবিকে পল্লী বাংলার সৌন্দর্যে অভিভূত করে। কবি বাংলার প্রাণকে খুঁজে পান। যখন ‘আকাশে সাতটি তারা’র ঔজ্জ্বল্য, নীল সন্ধ্যায় জেগে থাকে, কবি তা টের পান।

এই কবিতায় ‘আকাশে সাতটি তারা’ শব্দবন্ধ কবি দুই বার ব্যবহার করেছেন। সাতটি তারার প্রথম ফুটে ওঠা (যা সন্ধ্যার সূত্রপাত) এবং উজ্জ্বলভাবে জেগে থাকার (সন্ধ্যা শেষে রাত্রির আগমন) মধ্যে দিয়ে সম্ভবত কবি সন্ধ্যার সময়টুকু বোঝাতে চেয়েছেন।

এই কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই কবিতাটির মাধ্যে দিয়ে গ্রাম বাংলার সান্ধ্যকালীন স্নিগ্ধরূপ কবি ফুটিয়ে তুলেছেন। তাই বলা যায়, আকাশে সাতটি তারা নাম এই কবিতার জন্য একেবারেই যথার্থ।

পরবর্তী পর্বআকাশে সাতটি তারা কবিতার সরলার্থ

লেখক পরিচিতিঃ

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।



এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

IX_Beng_Akashe-satti-tara