Chandranath
WB-Class-9

চন্দ্রনাথ

বাংলানবম শ্রেণি – চন্দ্রনাথ

চন্দ্রনাথ গল্পের লেখক পরিচিতি

আলোচ্য ‘চন্দ্রনাথ’ গদ্যাংশের লেখক তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা ভাষার একজন অনন্য ঔপন্যাসিক এবং ছোটগল্পকার। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে ২৪ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে এক জমিদার পরিবারে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মা প্রভাবতী দেবী।

বীরভূমের লাভপুরের যাদবলাল হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। মূলত রাঢ় বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য তাঁর সাহিত্যের অন্যতম বিষয়। বীরভূমের রাঢ় মাটির গন্ধ, বীরভূমের লোকজীবন তাঁর গল্প-উপন্যাসে ফুটে উঠেছে এবং বলা হয় তাঁর বেশিরভাগ সাহিত্য-রচনাই মূলত আঞ্চলিকতাধর্মী।

তাঁর বিখ্যাত কিছু উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’, ‘কালিন্দী’, ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’, ‘জলসাঘর’, ‘চৈতালি ঘূর্ণি’, ‘রাইকমল’, ‘নাগিনী কন্যার কাহিনী’, ‘রাধা’, ‘মঞ্জরী অপেরা’, ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘সপ্তপদী’ ইত্যাদি। তিনি প্রায় ৬৫টি উপন্যাস লিখেছেন এবং একইসঙ্গে তাঁর গল্পগ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৫৩টি। ‘রসকলি’, ‘তারিণী মাঝি’, ‘নারী ও নাগিনী’, ‘বেদেনী’, ‘অগ্রদানী’, ‘পৌষ লক্ষ্মী’ ইত্যাদি তাঁর অন্যতম বিখ্যাত গল্প।

যদিও তাঁর সাহিত্য জীবনের শুরু হয়েছিল নাটক রচয়িতা হিসেবে। কতগুলি মৌলিক নাটক রচনা করেছিলেন তিনি এবং তাঁর নিজের কতগুলি গল্প-উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছেন। রবীন্দ্র পরবর্তী বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের ‘ত্রয়ী বাঁড়ুজ্জে’র মধ্যে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম। তাঁর রচনায় বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার দ্বন্দ্ব। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়।

চন্দ্রনাথ গল্পের উৎস

‘চন্দ্রনাথ’ গদ্যাংশটি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা একটি অনালোচিত উপন্যাস ‘আগুন’-এর প্রথম অংশের সম্পাদিত রূপ। এই উপন্যাসে মোট উনিশটি অধ্যায় আছে। প্রথম অধ্যায়ের পুরোটা আর দ্বিতীয় অধ্যায়ের সিংহভাগ একত্র করে ‘চন্দ্রনাথ’ এই নামকরণ করে পাঠ্যাংশে সংকলিত হয়েছে। একেবারে পরিসংখ্যানভিত্তিক তথ্য দিতে গেলে বলতে হয় পাঠ্যাংশের ‘২’ চিহ্নিত অংশে মূল উপন্যাস থেকে প্রথম ৬টি অনুচ্ছেদ নেওয়ার পরে আবার পরবর্তী ৩টি অনুচ্ছেদ বাদ দেওয়া হয়েছে। আবার মূল উপন্যাসের দ্বিতীয় অধ্যায় থেকে শেষ ৯টি অনুচ্ছেদ বাদ দেওয়া হয়েছে। এভাবে পাঠ্যাংশটি সংযোজন বিয়োজন এবং পরিমার্জন করে নির্মিত হয়েছে।


চন্দ্রনাথ গল্পের আলোচনা দেখে নাও এই ভিডিও থেকে↓


চন্দ্রনাথ গল্পের বিষয়সংক্ষেপ

শুরুতেই জেনে রাখা ভালো আগুন উপন্যাস প্রথমে ‘কালপুরুষ’ নামে ধারাবাহিকভাবে সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৩৪৩ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসের ৯ তারিখ থেকে কার্তিক মাসের ২১ তারিখ পর্যন্ত। পরে ১৯৩৭ সালে এই উপন্যাস ‘আগুন’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।

[জেনে রাখো, তারাশঙ্করের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘আমার সাহিত্য জীবন’ থেকে জানা যায় মনোহর পুকুর লেনের ভাড়া বাড়িতে থাকার সময় ‘আগুন’ উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি। তবে এই উপন্যাসের খসড়া করেছিলেন বিহারের মগমা নামক স্থানে বিহার ফায়ার ব্রিকস্‌ কারখানায় তাঁর পিসতুতো ভাইয়ের বাড়িতে থাকার সময়। মূল উপন্যাস যেভাবে শুরু হয়েছে পাঠ্যাংশের সূচনাও একইভাবে। তবে পাঠ্যাংশের কাহিনি মাঝপথে থেমে গেছে। মূল উপন্যাসে এর পরে আরো ২৭টি অধ্যায় ছিল।]

পাঠ্যাংশের কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র চন্দ্রনাথ। লেখক নরুর বয়ানে সমস্ত কাহিনিটি বিধৃত করেছেন। স্কুলজীবনে নরু আর তাঁর দুই সহপাঠী হীরু এবং চন্দ্রনাথের সঙ্গে সম্পর্কের আলোকপাত করার মাধ্যমে কাহিনি এগিয়েছে। নরুর আসল নাম নরেশ। নরুর বয়ানে জানা যায় আকাশের কালপুরুষ নক্ষত্রের সঙ্গে চন্দ্রনাথের চরিত্রের মিল লক্ষ করা যায়।

নক্ষত্রমণ্ডলীর মধ্যে কালপুরুষ যেমন তমসাঘন আকাশে ভীমকায় খড়্গ হাতে দীপ্ত ভঙ্গিতে প্রতীয়মান হয়, তেমনি চন্দ্রনাথের চরিত্রেও সেই দীপ্তি রয়েছে। কালপুরুষের মতোই জীবনের অন্ধকার পথে একাই পাড়ি দেয় চন্দ্রনাথ। চন্দ্রনাথ নামের অর্থ হল শিব। লেখক শিবের অনুষঙ্গ আনার জন্য চন্দ্রনাথের চেহারার বর্ণনায় নাকের উপর ত্রিশূলের মতো শিরার উপস্থিতির কথা বলেছেন।


নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

চন্দ্রনাথের দাদা নিশানাথ। স্কুলের পরীক্ষায় বরাবর প্রথম হয়েছে চন্দ্রনাথ, কিন্তু শেষ বার্ষিক পরীক্ষায় সে দ্বিতীয় হয়। তাঁর বদলে প্রথম হয় স্কুলের সেক্রেটারির ভাইপো হীরু। চন্দ্রনাথ এই ঘটনা মেনে নিতে পারেনি। তাঁর মতে পরীক্ষায় হীরু তাঁর খাতা দেখেই তিনটে প্রশ্নের উত্তর লিখেছে। এমনকি সে বিশ্বাস করে হীরুর প্রথম হওয়ার পিছনে সহকারী শিক্ষকদের সহায়তা রয়েছে এবং সেক্রেটারির ভাইপো হওয়ার সুবিধেও পেয়েছে হীরু। তাই এর প্রতিবাদে স্কুলের দ্বিতীয় পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে চন্দ্রনাথ প্রধানশিক্ষককে চিঠি দেয়।

চিঠিতে সে জানায় দ্বিতীয় পুরস্কার গ্রহণ করা তাঁর কাছে ‘beneath my dignity’ অর্থাৎ তাঁর মর্যাদার পরিপন্থী, অপমানজনকও বটে।

তাঁর দাদাকে এ কথা জানালে নিশানাথ তাঁকে প্রত্যাখ্যানপত্র ফিরিয়ে নিতে বলেন এবং প্রধানশিক্ষকের কাছে ক্ষমাও চেয়ে নিতে বলেন। এই নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে প্রচুর তর্কবিতর্ক হয়। কিন্তু চন্দ্রনাথ নিজ সিদ্ধান্তে অটল। মতবিরোধ চরমে উঠলে নিশানাথ চন্দ্রনাথের সঙ্গে থাকতে অস্বীকার করে, দুই ভাইয়ের চিরবিচ্ছেদ ঘটে। চন্দ্রনাথ শান্ত স্তিমিত ভঙ্গিতে দাদার সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠেও দেখা যায় হীরু চন্দ্রনাথকে পিছনে ফেলে স্কলারশিপ পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। এই আনন্দে বাড়িতে উৎসব আয়োজন করে হীরু। চন্দ্রনাথসহ অন্যান্য বন্ধুরাও সেখানে নিমন্ত্রিত হয়।

কিন্তু চন্দ্রনাথ সেদিনই কাউকে কিছু না জানিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়।

শুধু অনুপস্থিতির জন্য মার্জনা চেয়ে হীরুকে একটা চিঠি লিখে যায়। তাঁর গন্তব্য কোথায় তা জানে না কেউ। তাঁর মাস্টারমশাই অর্থাৎ স্কুলের প্রধানশিক্ষক অত্যন্ত ছাত্রদরদী, চন্দ্রনাথকে তিনি চিঠি লিখে ডেকে পাঠালেও চন্দ্রনাথ যায়নি।

বরং সে অত্যন্ত অহঙ্কারী কন্ঠে জানিয়েছে গুরুদক্ষিণার দিন আর নেই, সে স্কুলের সমস্ত বেতন পরিশোধ করে দিয়েছে।


নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

ফলে তার সঙ্গে স্কুলের বা শিক্ষকের আর কোনোরূপ সম্পর্কই থাকতে পারে না। নরেশ মাস্টারমশাইকে চন্দ্রনাথ আর তাঁর দাদার বাকবিতণ্ডা এবং বিচ্ছেদের কথা জানালে তিনি অত্যন্ত অনুতপ্ত হন। তাঁর মনে হতে থাকে চন্দ্রনাথের দাদাকে এ ব্যাপারে না জানালেই ভালো হতো। আবার পরে হীরুর বাড়িতে অনুষ্ঠানে নরেশকে তিনি উপদেশ দিয়েছেন সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে, লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করতে উৎসাহ দিয়েছেন।

স্নেহশীল মাস্টারমশাই সেই প্রসঙ্গেই একটি উদ্ধৃতি দেন – ‘Shame in crowd but solitary pride’ যার অর্থ শখের সাহিত্যচর্চা জনসমক্ষে কুণ্ঠার বিষয় হলেও নিজের কাছে নিভৃতে তা অত্যন্ত গর্বের বস্তু।

[এই উদ্ধৃতিটি আসলে অলিভার গোল্ডস্মিথের লেখা ‘দ্য ডেসার্টেড ভিলেজ’ কবিতার অংশ। যদিও কবিতার পংক্তিটি ছিল একটু আলাদা – ‘My shame in crowds, my solitary pride.’]

একপ্রকার আত্মাভিমানী চন্দ্রনাথকে গদ্যাংশে একসময় দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় কে কত নম্বর পাবে তা বিচার করতে। চন্দ্রনাথের অনুমান ছিল সে সাড়ে পাঁচশোর বেশি পেলে স্কুলের ফলাফলে দেখা যাবে অমিয় এবং শ্যামা অকৃতকার্য হবে। আর যদি সে পাঁচশো পঁচিশের কম পায়, তবে স্কুলে দশজন ফেল করবে এবং নরুকে সে জানায় নরু তৃতীয় বিভাগে পাশ করবে।

কাহিনিতে দেখা যায় চন্দ্রনাথের কথা হুবহু মিলে গিয়েছিল।

মূল উপন্যাসের পরবর্তী অংশে দেখা যায় চন্দ্রনাথের এক অভূতপূর্ব জীবনের পরিণতি। স্কুলজীবনে অত্যন্ত মেধাবী চন্দ্রনাথ সেই যে অজানার উদ্দেশে বাড়ি ছাড়লো ধরা-বাঁধা সংসারে তাঁর আর ঠাঁই হল না। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে জীবিকার তাড়নায় সে প্রথমে একটি ব্যবসা খোলে, কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয়। পরে লোহার কারখানা খোলে, সেটি ভালোই চলতে থাকে। এমনকি শেষে সে শেয়ার-বাজারেও বিনিয়োগ করে।

কিন্তু কোনো এক অজানা নিয়তির ছোবলে লোহার ব্যবসায় লক্ষ লক্ষ টাকা ঋণ হয়ে যায়।

আমরা উপন্যাসে দেখি, যে হীরুকে সে মনে মনে হিংসা করতো, সেই হীরুই তাঁকে টাকা দিয়ে ঋণমুক্ত করতে উদ্যত হয়। কিন্তু আজন্ম একরোখা চন্দ্রনাথ মরে গেলেও হীরুর টাকায় ঋণমুক্ত হতে চায় না। উপন্যাসে আমরা জানতে পারি, চন্দ্রনাথ পরে বিবাহ করেছিল মীরা নামের এক মেয়েকে। গল্পকথক নরু অর্থাৎ নরেশের সঙ্গে তাঁদের দুইবার দেখা হয়েছিল। মূল উপন্যাসও নরুর বয়ানে এগোলেও চন্দ্রনাথের খোঁজ সর্বদা জারি থেকেছে।

চন্দ্রনাথ গল্পের মূল বক্তব্য

পাঠ্যাংশে চন্দ্রনাথের চরিত্রের যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে তাঁকে আত্মম্ভরি, অহংকারী এবং বেশি মাত্রায় ‘megalomaniac’ বলেই মনে হয়েছে।

যেন কাউকেই সে তোয়াক্কা করে না। জগতের কোনো কিছুই তাঁকে তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারে না। তাঁর বন্ধুদের থেকেও সে নিজেকে আলাদা করে ভাবতো। নিজের সম্পর্কে দীর্ঘদিনের সাফল্যের কারণে একটা উচ্চাশা জন্মেছিল তাঁর মনে। আর তাঁর একরোখা, একগুঁয়ে মনোভাবের জন্য নিজের দাদা নিশানাথের সঙ্গেও তাঁর বিচ্ছেদ ঘটেছে। সব মিলিয়ে চন্দ্রনাথের চরিত্রে এক দীপ্তি চোখে পড়ে, যেমন প্রতিভায় তেমনই চারিত্রিক সংগঠনে। আর তাঁর আশ্চর্য অন্তর্ধানকে ঘিরে প্রধানশিক্ষক, বন্ধু-বান্ধব প্রত্যেকের দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে, এতে গদ্যাংশে সে যেন অতিরিক্ত গুরুত্ব পেয়েছে।
সমাপ্ত।


লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।



এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

IX_Beng_Chandranath