vu-gathonik-prokriya
WB-Class-9

ভূ গাঠনিক প্রক্রিয়া সম্পর্কিত ধারণা

শ্রেণিঃ নবম | বিষয়: ভূগোল । অধ্যায় – ভূমিরূপ গঠনকারী প্রক্রিয়া (প্রথম পর্ব)


পৃথিবীর তিনভাগ জল এক ভাগ স্থল।

সেই স্থলভাগে স্থান বিশেষে বিভিন্নতা দেখা যায়। কোথাও সুউচ্চ পর্বতশ্রেণী তো কোথাও গভীর গিরিখাত, আবার কোথাও ঢেউ খেলানো মালভূমি।এই বৈচিত্র্যময় ভূমিরূপের গঠন প্রক্রিয়া কিন্তু এক মুহূর্তে হয়নি। এ এক নিরন্তর প্রক্রিয়া যা ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে।

ভূমিরূপের সংজ্ঞা

ভূমির এই বৈচিত্র্য অর্থাৎ ভূমির উচ্চতা আপেক্ষিক ঢাল, আয়তন, আকৃতির যে বিভিন্ন সমন্বয় আমরা দেখি তাকে ভূমিরূপ বলা হয়।

ভূমিরূপ গঠন এক দীর্ঘ মেয়াদি প্রক্রিয়া, যা বিভিন্ন উপায়ে সংগঠিত হয়।

ভূমিরূপ গঠনকারী প্রক্রিয়াসমূহ

শুরুতেই আমরা ভূমিরূপের বৈচিত্র্যতার কথা আলোচনা করেছি। এই সমস্ত ভূমিরূপ বিভিন্ন ভূমি গঠনকারী প্রক্রিয়া দ্বারা সৃষ্টি হয়। এই প্রক্রিয়া গুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়।
1. পার্থিব প্রক্রিয়া
2. অপার্থিব প্রক্রিয়া।

পার্থিব প্রক্রিয়ার সংজ্ঞা

শব্দটির মধ্যেই এর অর্থ লুকিয়ে আছে। যে প্রক্রিয়া পার্থিব অর্থাৎ পৃথিবীর আভ্যন্তরিক বিষয় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

অর্থাৎ বলা যায় যে সব ভূমিরূপ গঠনকারী প্রক্রিয়া পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ ও ভূঅভ্যন্তরে ক্রিয়াশীল হয় সেই সমস্ত প্রক্রিয়াকে পার্থিব প্রক্রিয়া বলা হয়।

পার্থিব প্রক্রিয়ার শ্রেণীবিভাগ

এই প্রক্রিয়া দুই ভাগে বিভক্ত।
ক) অন্তর্জাত প্রক্রিয়া
খ) বহির্জাত প্রক্রিয়া।

ক) অন্তর্জাত প্রক্রিয়ার সংজ্ঞা

পৃথিবীর অভ্যন্তরে বিভিন্ন শক্তি মিলিত হয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। এই অন্তর্জাত শক্তির বলে ভূমিরূপের পরিবর্তন বা বিবর্তন ঘটে থাকে। এই প্রক্রিয়াকে অন্তর্জাত প্রক্রিয়া বলা হয়। যেমন বিভিন্ন প্রকার আলোড়ন, ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত প্রভৃতি।

এই অন্তর্জাত প্রক্রিয়াটিকেও দুটি ভাগ করা যায়
a) ধীরপ্রক্রিয়া
b) আকস্মিক প্রক্রিয়া।

a) ধীরপ্রক্রিয়া

ধীর প্রক্রিয়ার হল এমন এক প্রক্রিয়া যা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ধীর গতিতে সম্পন্ন হয়।

বিভিন্ন প্রকার ধীর প্রক্রিয়া

ভূ গাঠনিক আলোড়ন

ভূ-অভ্যন্তরের বিভিন্ন ক্রিয়ার ফলে উৎপন্ন আলোড়ন যখন ভূত্বকের বিভিন্ন অংশের পরিবর্তন, বিবর্তন এবং নতুন ভূমিরূপ গঠন করে তখন তাকে ভূ গাঠনিক আলোড়ন বলা হয়। যেমন- মহীভাবক আলোড়ন,গিরিজনি আলোড়ন,ইউস্ট্যাটিক আলোড়ন,সমস্থিতিক আলোড়ন।

i) মহীভাবক আলোড়ন

মহীভাবক শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Epeirogeny। গ্রিক Epeiros শব্দের অর্থ হলো মহাদেশ ও Genesis শব্দের অর্থ হলো উৎপত্তি। অর্থাৎ Epeirogenic শব্দের অর্থ হলো মহাদেশের উৎপত্তি ও গঠন। মহীভাবক শক্তির একটি বৈশিষ্ট্য হল ইহা পৃথিবীর ভুকেন্দ্র থেকে ভূপৃষ্ঠ পর্যন্ত ব্যাসার্ধ বরাবর উলম্ব ভাবে কাজ করে। ফলে ভূত্বকের কোন অংশ উলম্বভাবে উঠে যায় বা বসে যায়। এর ফলে শিলাস্তরের উত্থান ঘটে বা অবনমন ঘটে।

যখন মহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এই আলোড়ন ঘটে তখন মহাদেশের অংশ সমুদ্র থেকে জেগে ওঠে কিংবা বসে গিয়ে মহাসাগর তৈরি করে একেই মহীভাবক আলোড়ন বলা হয়।

মহীভাবক আলোড়নের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ [Credit: DUCEPT Pascal_Getty ]

মহীভাবক আলোড়নের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপসমূহ

এই আলোড়নের ফলস্বরুপ যেহেতু ভূমিভাগ নেমে যায় বা উঠে আসে তাই বিভিন্ন গ্রস্ত উপত্যাকা, স্তূপ পর্বত, মালভূমি, বিভিন্ন প্রকার উপকূল ভাগের সৃষ্টি হয়।

ii) গিরিজনি আলোড়ন

গিরিজনি শব্দের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো orogeny। এখানে গ্রিক শব্দ Oros এর অর্থ হল পর্বত এবং Genesis শব্দের অর্থ হলো উৎপত্তি। অর্থাৎ Orogenic শব্দের অর্থ হলো পর্বত এর গঠন। এই ক্ষেত্রে অন্তর্জাত বল ভূমির সমান্তরালে অনুভূমিকভাবে ক্রিয়াশীল হয়। ভূ আলোড়নের ফলে; ভূমি ভাগের সংকোচন প্রসারণের কারণে শিলাস্তরের সংকোচন বা প্রসারণ ঘটে। এই আলোড়ন এর ফলে শিলাস্তরে ভাঁজ পড়ে এবং ভাঁজযুক্ত ভঙ্গিল পর্বতের সৃষ্টি হয়। সংকোচন বল তীব্র হলে চ্যুতির সৃষ্টি হয়। এই প্রক্রিয়ার ফলে ভঙ্গিল পর্বত গঠিত হয় বলে একে গিরিজনি আলোড়ন বলা হয়।

গিরিজনি আলোড়নের দ্বারা সৃষ্ট পর্বতের উদাহরণ [Credit: Frans-Banja Mulder, Attribution 3.0 Unported]

মহীভাবক ও গিরিজনি আলোড়নের পার্থক্য

iii) ইউস্ট্যাটিক আলোড়ন

পৃথিবীজুড়ে সাগর বা মহাসাগরের জল ধারণ ক্ষমতা হ্রাস বৃদ্ধির সাথে ভারসাম্য রেখে ভুমিভাগের উত্থান পতন ঘটাকে ইউস্ট্যাটিক আলোড়ন বলা হয়।

iv) সমস্থিতিক আলোড়ন

পৃথিবীর বিভিন্ন ভূমিরূপ এর মধ্যে উচ্চতা গত ভারসাম্য স্থাপনের জন্য যে আলোড়নের সৃষ্টি হয় তাকে সমস্থিতিক আলোড়ন বলা হয়।

b) আকস্মিক প্রক্রিয়া

ভূ-অভ্যন্তরের শক্তির প্রভাবে অতি দ্রুত ভূমিরূপের যে পরিবর্তন হয় সেই প্রক্রিয়াগুলিকে আকস্মিক প্রক্রিয়া বলা হয়।

উদাহরণস্বরূপ ভূমিকম্প এবং অগ্নুৎপাত জাতীয় প্রক্রিয়া গুলি আকস্মিক প্রক্রিয়ার অন্তর্গত।

এতক্ষণ আমরা ভূমিরূপ গঠনকারী অন্তর্জাত প্রক্রিয়াগুলি সম্পর্কে আলোচনা করলাম, কিন্তু ভূমিরূপ গঠনে বিভিন্ন বহিরজাত প্রক্রিয়ার গুরুত্বও অনস্বীকার্য।

খ)  বহির্জাত প্রক্রিয়া

পৃথিবীর অভ্যন্তরের ন্যায় উপরিভাগের ভূমিরূপের পরিবর্তন ঘটায় কিছু প্রাকৃতিক শক্তি। এই প্রাকৃতিক শক্তিগুলি হল বায়ু, নদী, হিমবাহ ও সমুদ্র তরঙ্গ। এইসব প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলো ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগে ক্রিয়াশীল হয়ে বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটায়।

পৃথিবীর বহির্ভাগে বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি ক্রিয়াশীল হওয়ার কারণে যদি ভূমিরূপের পরিবর্তন হয়, সেই সকল প্রক্রিয়াসমূহকে বহিরজাত প্রক্রিয়া বলে।

এই সকল বহির্জাত প্রক্রিয়াগুলি ক্ষয়, অপসারণ, বহন ও সঞ্চয় কাজের মাধ্যমে ভূমিরূপের পরিবর্তন ঘটায়। পৃথিবীর উপরিভাগে অবস্থিত উঁচু নিচু ভূভাগকে সমুদ্রপৃষ্ঠের সমান উচ্চতায় আনাই হল বহিরজাত প্রক্রিয়া।

subscribe-jump-magazine-india

পর্যায়ন

ক্ষয়, অপসারণ, বহন ও সঞ্চয় কাজের মাধ্যমে ভূভাগের সমউচ্চতায় আসার প্রক্রিয়াকেই বলা হয় পর্যায়ন।
পর্যায় বা গ্রেড কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন জি কে গিলবার্ট। পর্যায়ন দুটি ভাবে সাধিত হয়।

1. অবরোহণ
2. আরোহণ।


[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – ভৌত বিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – জীবন বিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – গণিত ]

অবরোহণ

এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠের উঁচু স্থান গুলির ক্ষয়ের মাধ্যমে উচ্চতা হ্রাস পায় বা অবনমন ঘটে। অবরোহণ কয়েকটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে।
সেগুলি হল-

ক) আবহবিকার –যখন বায়ুর দ্বারা শিলাস্তর চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে মূল শিলা থেকে আলাদা হয়ে যায় তখন তাকে আবহবিকার প্রক্রিয়া বলে।
খ) পুঞ্জক্ষয় – যখন আবহবিকারের ফলে আলগা শিলাস্তর অভিকর্ষ বলের প্রভাবে ভূমির ঢাল বরাবর নিচে নেমে আসে তাকে পুঞ্জক্ষয় বলে।
গ) ক্ষয়ী ভবন- বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে আলগা শিলাস্তরের অন্যত্র অপসারণ ও মূল শিলার নিম্নস্তরের উন্মুক্তকরণ যখন ঘটে তখন তাকে ক্ষয়ীভবন বলে।


[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – বাংলা | নবম শ্রেণি – ইতিহাস | নবম শ্রেণি – ভূগোল]

আরোহণ

এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি দ্বারা ক্ষয়জাত শিলাচূর্ণ সঞ্চিত হয় এবং ভূপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ঘটে, একে আরোহণ প্রক্রিয়া বলা হয়। নদীর নিম্ন গতিতে সৃষ্ট বদ্বীপ, প্লাবন ভূমি হল আরোহণ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন ভূমিরূপ।

2. অপার্থিব প্রক্রিয়া

উল্কা এবং ধুমকেতু জাতীয় মহাজাগতিক বস্তুর আঘাতে পৃথিবীপৃষ্ঠের যে পরিবর্তন হয় তাকে অপার্থিব প্রক্রিয়া বলা হয়।

আজ থেকে প্রায় 23 কোটি বছর আগে পৃথিবীর মহাদেশগুলি কিন্তু একটিমাত্র ভূ খণ্ডের অন্তর্গত ছিল। বিখ্যাত ভূবিজ্ঞানী আলফ্রেড ওয়েগনার এই ভূখণ্ডের নাম দেন প্যানজিয়া এবং প্যানজিয়াকে ঘিরে থাকা সমুদ্রের নাম দেন প্যানথালাসা। ওয়েগনারের মতে পৃথিবীর কেন্দ্র বহির্মুখী শক্তি ও জোয়ার ভাটার প্রভাব এ মেসোজোয়িক ভূতাত্ত্বিক যুগের শেষের দিক থেকে এই প্যানজিয়া ভাঙতে শুরু করে এবং সাতটি মহাদেশ পাঁচটি মহাসাগর নিয়ে পৃথিবী তার বর্তমান রূপ ধারণ করে।

প্রথম পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → পৃথিবীর বিভিন্ন ভূমিরূপ সমূহ


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখিকা পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রাক্তনী শ্রেয়সী বিশ্বাস। পড়াশোনা এবং লেখালিখির পাশাপাশি, ছবি আঁকা এবং বাগান পরিচর্যাতেও শ্রেয়সী সমান উৎসাহী।



এছাড়া,পড়াশোনা সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ের আলোচনায় সরাসরি অংশগ্রহন করতে যুক্ত হতে পারেন ‘লেখা-পড়া-শোনা’ ফেসবুক গ্রূপে। এই গ্রুপে যুক্ত হতে ক্লিক করুন এখানে।