flatworm-article
Article (প্রবন্ধ)

এক বিস্ময়কর প্রাণী – হ্যামারহেড ফ্ল্যাটওয়ার্ম



‘প্রাণীজগৎ বড়োই বিচিত্র’ – এইকথা আমরা সকলেই জানি।

প্রাণীদের স্বভাব – ধর্ম সর্বদা আমাদের বিস্মিত করে। যেমন জোনাকি পোকা বিস্মিত করেছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে , তিনি রচনা করেছিলেন একটি সুন্দর গান এই প্রাণীটিকে নিয়ে, যে গানের প্রথম লাইনটি -“ও জোনাকি, কি সুখে ওই ডানাদুটি মেলেছো”।

ঠিক এরকম ভাবেই এই প্রাণীজগৎ আকৃষ্ট করে অক্ষয়কে।

অক্ষয় আমাদের পাশের বাড়ির ছেলে, নবম শ্রেণীর ছাত্র। স্বাভাবিক যে বিষয় তাকে বিশেষ ভাবে আনন্দ দান করে সেটি হলো জীববিজ্ঞান। বিভিন্ন প্রাণী সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে খুব পছন্দ করে সে। আর একথাও আমাদের সকলের জানা যে মানুষের পূর্বে   অন্যান্য প্রাণীদের সৃষ্টি, সুতরাং প্রাণীদের নিয়ে জ্ঞানলাভ করাটাও যুক্তিযুক্ত। যাইহোক, কথা না বাড়িয়ে এবার আসি আসল প্রসঙ্গে যেটা বলবো বলে ঠিক করেছি, সেটা বলি।

নিশ্চয় এবার আপনাদের জানতে ইচ্ছে হচ্ছে কি সেই বিষয় ? চলুন তাহলে বলি-

গত রবিবার বৃষ্টির জল সিক্ত করছিলো রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, গাছপালাকে। আমি আমার  বাড়ির জানলায় বসে রসাস্বাদন করছিলাম সেই দৃশ্যের, এমন সময় হটাৎ দেখি অক্ষয় আমার পাশে স্বশরীরে উপস্থিত। আমি একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম -“কিরে, এই বৃষ্টির মধ্যে?”।

অক্ষয়  বললো “একটা অদ্ভুত প্রাণী দেখলাম, হয়তো তুমি জানবে সেইজন্যই জিজ্ঞেস করতে এলাম, আমি মোবাইল এ ছবি তুলে এনেছি। ”

আমি ওকে বললাম যে এক বছর হলো এই প্রাণী নিয়ে আর চর্চার সময় হয়না। এখন তো কলেজে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়ছি আর সত্যি বলতে আমি যে প্রচুর প্রাণী সম্পর্কে জানি  এমনটাও নয়, এই বিষয়ে জ্ঞান আমার সীমিত। তোর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো কিনা সেটাও নিশ্চত নই।  তুই তোর স্কুলের জীববিদ্যার স্যারকে জিজ্ঞেস করবি।”

ও বললো “না না ,তুমি দেখো তাও ছবিটা, জানতেও তো পারো।”

ওর আগ্রহ দেখে আমিও আর না করতে পারলাম না। ভাবলাম যদি আমার জানা না হয় তো আমাদের কলেজের প্রাণিবিদ্যার কোনো শিক্ষক মহাশয়ের কাছ থেকে জেনে নেবো দিয়ে বলবো। যাইহোক ওর কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে ছবিটা দেখলাম।

hammerheads
অক্ষয়ের তোলা ছবি [চিত্র সৌজন্যে – royaljozini]
ছবিটা প্রথমেই আমাকে আনন্দ দিলো এই কারণে যে এই প্রাণীটা আমাকেও একদিন একইভাবে বিস্মিত করেছিল, সেদিন স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এবং তারপর ইন্টারনেট ঘেঁটে জেনেছিলাম। সুতরাং উত্তরটি আমার পক্ষে দেওয়া  সহজ। মনে হলো অন্তত অক্ষয় আর নিরাশ হবেনা। স্বাভাবিকভাবেই পরিবেশ এর সাথে সাথে আমার আনন্দটাও বেড়ে গেলো খানিকটা।

ও বললো – “কি গো? জানো?”

আমি বললাম হ্যাঁ রে, এই প্রাণীটাকে কি বলে জানিস?

এই প্রাণীটা হলো বাইপালিয়াম (Bipalium sp), সহজ ভাবে বললে হ্যামারহেড ফ্ল্যাটওয়ার্ম (hammerhead flatworm), পর্ব হলো প্লাটিহেলমিনথিস (Platyhelminthes), জানিস কেন একে হ্যামারহেড ফ্ল্যাটওয়ার্ম বলে?

সঙ্গে সঙ্গে ও বললো – “না, তুমি বলে দাও “।

আমি বললাম মাথাটা কেমন দেখতে?

ও বললো “একদম অন্য রকমের – চ্যাপ্টা মতন, এরকম আগে দেখিনি ”

আমি বললাম, এরকম অদ্ভুত মাথা  বলেই তো এর নাম হ্যামারহেড

ও বললো – “আচ্ছা,তাহলে মাথার জন্যই এরকম নাম তাইতো?”

hammerheads-2
মাথাটি ঠিক যেন হাতুড়ির মতো [চিত্র সৌজন্য –Dangerous & Magic Science]
আমি পুনরায় বললাম হ্যাঁ  ঠিক, মাথার জন্য এর নাম হ্যামারহেড। হ্যামার মানে হাতুড়ি, দেখ হাতুড়ির যেমন মাথাটা হয় ঠিক তেমনি এর মাথা, ঐজন্য এইরকম নামকরণ।

এবারে আনন্দিত হয়ে বললো -বাঃ, কি মিল দেখো?

আমি বললাম  হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। তোকে আরো কিছু বিষয় বলি এই প্রাণীটা সম্পর্কে।

এই প্রাণীটি প্রথমে ট্রপিকাল ও সাবট্রপিক্যাল অঞ্চলে পাওয়া যেত।  কিন্তু বর্তমানে গোটা বিশ্বেই এদের পাওয়া যায়। এরা খুব সাধারণ, গ্রামে গঞ্জে অধিক দেখতে পাওয়া যায়। আর যেমন আগে বললাম এরা মুলত এদের চ্যাপ্টা মাথার জন্য পরিচিত। গ্রামবাংলায় এদের বিভিন্ন নাম ধরে ডাকা হয়। যে অঞ্চলে যে নামে পরিচিত, সেই  অঞ্চলের বাসিন্দারা সেই  নামেই সবাই চিনবে। তার ফলে এক প্রাণীরই  ভিন্ন  ভিন্ন নাম  ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে।  সেকারণেই বৈজ্ঞানিক নামকরণ করা হয় যাতে  সমগ্র বিশ্বের মানুষ একই নাম চিনতে পারে প্রাণীটিকে। মূলত এদের দেখতে পাবি  আর্দ্র অঞ্চলে, খুব গরমে এরা  থাকে না সেইজন্য মরুভূমিতে সচরাচর এদের  দেখতে পাওয়া যায় না। বুঝলি তাহলে?


আরো পড়ুন – JUMP ম্যাগাজিনের প্রবন্ধ বিভাগ

ও বললো এগুলো সব বুঝলাম, তুমি আরো বলো যা যা জানো।

আমি বললাম বলতো এরা কি খায়?

ও বললো পোকামাকড় নাকি?

আমি বললাম হুম, পোকামাকড়ের লার্ভাদের খায়, তাছাড়াও খায় স্লাগ নামক একটি প্রাণী, এরা কেঁচোকেও খায় । বলতে পারিস মাংসাশী। দেখবি, খুব আস্তে আস্তে চলা ফেরা করে, অনেকটা কেঁচো বা স্লাগ এর  মতন।

hammerheads-3
শিকার করছে Bipalium kewense [চিত্র সৌজন্যে wikimedia]

আর গায়ের রং কি বলতো?

ও একটু ভেবে উত্তর দিলো “কালো তো দেখলাম মনে হলো ”

আমি বললাম ঠিকই দেখেছিস, আসলে দূর থেকে দেখে কালো লাগে কিন্তু এদের গায়ের রং একটু ধূসর হয় তবে অন্যান্য বর্ণেরও হতে পারে।

বংশবিস্তার কি করে করে বলতো?

ও বললো জানি এই জাতীয় প্রাণীগুলো অযৌন জনন করে বেশি।

আমি বললাম বাঃ, খুব ভালো একদম ঠিক এরা অযৌন জনন করে। এক্ষেত্রে গ্যামেট তৈরি হয়না। এরা খণ্ডীভবন বা ফ্র্যাগমেন্টেশন দ্বারা  বংশ বিস্তার করে। নিজের লেজের ডগাকে কোনও পাতা বা অন্যান্য বস্তুতে আটকে দেয় যা পরে প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে বিকশিত হয়। তুই যদি এদের কেটেও দিস তাহলে প্রতি খন্ড থেকে নতুন তৈরি হবে। বলা যায় অমর।

ও বললো হুম হুম ,এগুলো জানি এরকম হয়? কিন্তু তাহলে যৌন জনন করেনা?

আমি বললাম হ্যাঁ, করে। জেনে অবাক হবি এদের একজনের শরীরে শুক্রাশয় ও ডিম্বাশয় দুটোই থাকে। জননের সময় একটি, অপর একটি হ্যামারহেড ফ্ল্যাটওয়ার্ম এর সাথে নিজেদের সিক্রেশন এর মাধ্যমে গ্যামেটের আদান প্রদান করে। নিষেকের পরে দেহের মধ্যেই ডিম তৈরি হয় এবং সেগুলো ক্যাপসুল আকারে বেরিয়ে আসে।

আচ্ছা অনেক কিছু জানলাম। এবার বলোতো এরা কি বিষাক্ত?

আমি বললাম, কিছু কিছু গবেষণা Bipalium kewense এবং Bipalium adventitium এর মধ্যে tetrodotoxin  বা TTX নামক নিউরোটক্সিনের উপস্থিতি ব্যাখ্যা করেছে যেগুলো এরা এদের শিকারকে পঙ্গু করতে ব্যবহার করে এবং এই TTX প্রচন্ত শক্তিশালী একটি নিউরোটক্সিন। খরিশ সাপের এই নিউরোটক্সিন থাকে মূলত যার জন্যই এতো মারাত্মক। এই নিউরোটক্সিন প্রাণীদের স্নায়ুকে (নার্ভ) একবারে অচল করে দেয়  সাইন্যাপ্সের মধ্যে দিয়ে আয়ন এর পরিবহন বন্ধ করে দিয়ে। এর ফলে আমাদের স্নায়ুতন্ত্র ঠিকমতন কাজ করতে পারেনা।

ও একটু ভয়ে ভয়ে বললো -বাপরে, তাহলে তো দূরে থাকতে হবে?

আমি বললাম ,আমি যতটা জানি তাতে এখনো এই নিয়ে গবেষণা চলছে তবে এদেরকে খালি হাতে ধরা অনুচিত এবং এদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখাই নিরাপদ। খুব কাছে যাবি না বা খালি হাতে ধরার চেষ্টা করবিনা, তাহলে ওরাও তোর কোনো ক্ষতি না করে চলে যাবে। এই কথাটি বলার পর দেখলাম অক্ষয়ের ভয়টা একটু কমল। বেশ আনন্দিত লাগছিলো ওকে দেখে।

ও বললো  “খুব আনন্দ  লাগছে ,আজকে একটা নতুন প্রাণী সম্পর্কে জানলাম। বাড়ি গিয়েই আমি আমার ডাইরিতে লিখে নেবো। ”

আমিও বললাম হুম, একদম এভাবেই প্রশ্ন ও আগ্রহ তোর জ্ঞান ভান্ডারকে বিস্তার করবে। সেইজন্য সবসময় জানার চেষ্টা করবি যেটাই মনে আসবে।

ও বললো, “একদম ,আমি তোমার উপদেশ মনে রাখবো সর্বদা।”

তথ্য সূত্র

  • https://www.thoughtco.com/hammerhead-worm-facts-4178101
  • https://www.livescience.com/62635-hammerhead-flatworms-invade-france.html
  • https://www.britannica.com/science/neurotoxin
  • https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC4070999/
  • https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC5367013/

লেখক পরিচিতি

সৌম্যদীপ মৈত্র –  জঙ্গীপুর কলেজ (কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় এর অন্তর্গত ) পদার্থবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের  ছাত্র; মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত জঙ্গীপুরের বাসিন্দা।

এই লেখাটি থেকে ভালো লাগলে হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –