ganer vit editorial
Editorial (সম্পাদকীয়)

জ্ঞানের ভিত

আমরা যখন বাড়ি তৈরি করি, আমাদের সবাইকে প্রথমে বাড়ির ভিত খুঁড়তে হয়।

পৃথিবীর কোনো কিছুই ভিত্তি ছাড়া অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে না। ঠিক যেমন গাছের মূল শুকিয়ে গেলে গাছ তার অস্তিত্ব হারায়, তেমনই আজ আমাদের প্রিয় দেশের ভবিষ্যৎ ও অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখে। কারণ, যে দুটি মূল দিয়ে যে কোনো দেশ তার ভবিষ্যতের রসদ সংগ্রহ করে, সেই দুটি মূলই আজ শুকিয়ে যেতে বসেছে। একটি স্বাস্থ্য, অপরটি শিক্ষা।

শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে একটি ব্যাপার দেখে আমরা অত্যন্ত পীড়ায় রয়েছি। আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, যাদের দায়িত্বে রয়েছে আগামী দিনের দেশের সুখ ও সমৃদ্ধি , তাদের নিজেদেরই শিক্ষার ভিত কাঁচা থেকে যাচ্ছে।

সদ্য প্রকাশিত এক সর্বভারতীয় রিপোর্টে এটা পাওয়া গেছে যে মাত্র 54% অষ্টম শ্রেণীতে পড়া ছাত্র বা ছাত্রী, তৃতীয় শ্রেণীর পাঠ্যে থাকা সাধারণ ভাগ সাফল্যের করতে পারে।

তাহলে বাকিরা যখন ভবিষ্যতে পড়াশোনা শেষ করে কাজের বাজারে নিজেদের মেলে ধরবে, তখন এদের নিয়োগশীলতা (recruitability) নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে নাতো?
আজকের দিনে ইঙ্গিত স্পষ্ট যে ভবিষ্যতে বহু কাজ অটোমেশনের হাতে উঠতে চলেছে। যেভাবে একদিন মোটরে টানা ট্রামের জন্য ঘোড়ারা বেকার হয়ে পড়েছিল, মোবাইল ফোনের আসার ফলে টেলিফোন বুথগুলো খালি পড়ে ছিল, সেরকম ভাবে ভবিষ্যতে আজকের মেট্রো, প্রাইভেট গাড়ি টানবে কম্পিউটার (driverless car, driverless মেট্রো), শপিং মল এ আপনাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে রোবট। অর্থাৎ আগামী প্রজন্মের কাছে এই সব menial কাজও দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠবে।

সবথেকে বড় ব্যাপার, 200 বছর আগে যে পরিবর্তন আসতে 20 বছর লাগতো, এখন সেই হারের পরিবর্তন আসতে 2 মাসও লাগছে না, সুতরাং এই পালাবদলের সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে ভিত মজবুত করা ছাড়া উপায় নেই।

এই ভিত মজবুত করতে গেলে কি করতে হবে?

ভিত দুর্বল হওয়ার কারণগুলো চিনে নিয়ে সেগুলো একে একে নির্মূল করতে হবে। পড়াশোনার ভিত দুর্বল হওয়ার যে কারণগুলি বিশেষজ্ঞরা দেখেছেন তা মূলত তিনটি।

  • অনাগ্রহ
  • ভীতি
  • তাৎক্ষণিক লাভের আশা

অনাগ্রহ মূলত প্রয়োজনীয়তাবোধের অভাব থেকে এবং পরিবেশনার দুর্বলতা থেকে আসে।

পরিণতমনস্ক পিতামাতা যেভাবে শিক্ষা বা তার কোনো বিষয়ের উপযোগিতা বুঝতে পারে, শিশুটি তা পারে না। যতদিনে তার সেই বোধ উদ্রেক হয়, ততদিনে তার শেখার সময় পেরিয়ে যায়। (সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়।) সেই কারণেই শিশুকে সরল ভাবে, সহজ শিক্ষায় শিশুর মতো করে প্রয়োজনীয় বস্তুটি তুলে দেওয়া উচিৎ এবং সেটা তার মাতৃভাষায় হওয়া বাঞ্চনীয়।

কারণ সেই ভাষা শুনে, পাঠ্য বিষয়গুলি বুঝতে তাকে আলাদা করে পরিশ্রম করতে হচ্ছে না। কেউ যদি এমন পরিমণ্ডলে বড়ো হয় যেখানে কোনো বিদেশী ভাষাই ব্যবহারিক, তবে তার জন্য সেটাই সেখানে উপযোগী হবে। কিন্তু এর উল্টোটা করা ‘বিষময়’ প্রমাণ হতে পারে। আজকের দিনে পৃথিবীর কোনো প্রগতিশীল বা অগ্রসর দেশই বিদেশী ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা দেয় না। কিন্তু ‘কলোনিয়াল হ্যাংওভার’ থেকে উঠে না আসতে পারা এবং মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরির ক্ষেত্রে ইংলিশ বলার দক্ষতাকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় আমাদের প্রিয় দেশে এক ‘খিচুড়ি’ অবস্থা তৈরী হয়েছে। তাতে যাদের মাতৃভাষায় পঠনপাঠন হচ্ছে, তাদের ইংলিশে ভীতি ও যাদের বিদেশী ভাষায় পঠনপাঠন হচ্ছে, তাদের বিষয়ভিত্তিক অনাগ্রহ তৈরী হবার প্রবল সুযোগ থেকে যাচ্ছে।

Children whose primary language is not the language of instruction in school are more likely to drop out of school or fail in early grades. ~ Global Partnership for Education

দ্বিতীয় কারণটি হলো ভীতি। আগ্রহ তো হলো, কিন্তু তৃষ্ণায় বারিবর্ষণ করবে কে?

পাঠ্যবই ও শিক্ষক। যতক্ষণ ছাত্রছাত্রী নিজেদের গল্পের বই নিয়ে ছিল সে তার বন্ধু ছিল, যেই সেই গল্প পাঠ্যবই হয়ে উঠলো, এবং বৎসরান্তে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো “কি বুঝেছো বলো” সাথে সাথে সেই প্রীত, পীড়িত হয়ে পীড়ন দিতে লাগলো। তার ওপর উপস্থাপক (শিক্ষক) তাকে সহবৎ শিক্ষা দিতে ও পাঠ্যসূচী গলাধঃকরণ করাতে অসীমিত ছাত্রগুচ্ছের মধ্যে থেকে দাঁড়িয়ে যখন বিষয়টি বিশ্লেষণ করেন তখন তা বিষ হয়ে যায় এবং ভয় আরোই বেড়ে চলে । একে ‘মোটা মোটা’ বই তার ওপর ‘মোটা গোঁফওয়ালা’ মাস্টারমশাই বা ‘মোটা বিনুনিওয়ালা’ দিদিমণি।

[আরো পড়ুন – পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না কেন?]

এদিকে ক্লাসে একটি বাচ্চা সব উত্তর দিয়ে দিচ্ছে অতি উৎসাহের সাথে, বাকি ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ ‘প্রতিদ্বন্দিতায়’ পড়ে গেল আরো মৃদু হয়ে। যদি কখনো কোনোদিন কোনো প্রশ্ন, কোনো সন্দেহ মনে তৈরিও হয়ে থেকে থাকে, তবে “প্রশ্নটা অত্যন্ত লঘু”, “স্যার/ম্যাডাম বকবে”, “বন্ধুরা হাসবে” এসব ভেবে চুপ করে গেল। ব্যাস, ভয় আরো বাসা বাঁধতে শুরু করলো।

বাড়িতে তার জন্য গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা করা হলো, সেখানেও বিপদ। ডবল হোমটাস্কের জ্বালা, কখনো হাতের নাগালে পেয়ে কানমলা। পরীক্ষার আগে শরীরের ওপর চাপ দিয়ে রাত জেগে পড়া। পরীক্ষা হলের টেনশন, এবং আশানুরূপ ফল না হওয়ায় বিষয় বিষ হয়ে ওঠা, ভীতি চিরতরে মনে গেঁথে গেল।

আরো যেটা বিশেষ সর্বজনীন ভয়, সেটা হলো ইংলিশ ও অঙ্কে। আমাদের দেশের সাধারণ ধারণাই হলো, ইংলিশে যে চোস্ত সে ‘স্মার্ট’। কিন্তু স্মার্টনেস এর সাথে বিদেশী ভাষা বলতে পারার সম্পর্ক নেই। তাহলে যে হিন্দি বা ওড়িয়া বলছে সে কেন স্মার্ট নয়? আসলে ইংলিশ একটি আন্তর্জাতিক ভাষা যা বহুজাতিক সংস্থায় কাজ করতে আবশ্যক হয়ে উঠেছে। পাঠক ভাববেন না যে লেখক ইংলিশ ভাষার বিপক্ষে। চীনের মাতৃভাষা ম্যান্ডারিনের পরেই বিশ্বব্যাপী ব্যবহারের নিরিখে ইংলিশ ভাষার স্থান দ্বিতীয়। সুতরাং এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য্য।
এটা সকল মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীদের বোঝা উচিত, যে মাতৃভাষা ভালো করে রপ্ত করতে পারে, তার কাছে অন্য বিদেশী ভাষা রপ্ত করা কোনো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার নয়।

আন্তর্জাতিক বহু রিসার্চে এই তথ্য উঠে এসেছে। বরং, যারা মাতৃভাষায় বিজ্ঞান ও ইতিহাসের চর্চা করে তাদের কাছে নিজের ভাব প্রকাশের দক্ষতা বেশি হয়ে থাকে। ইংলিশ সেখানে একটা অতিরিক্ত স্কিল। সুতরাং ভয় না পেয়ে ইংলিশকে ভালোবেসে, একটি বিদেশী ভাষা হিসেবে সম্মান দিয়ে সঠিক পদ্ধতিতে শিখলেই খুব অল্প সময়ে ইংলিশে দক্ষ হয়ে ওঠা যায়।

অপরদিকে অঙ্ক বা গণিতের ভীতি আসে গণনার দুর্বলতা ও তার ফলস্বরূপ ব্যর্থতা থেকে। গণিতের একজন শিক্ষক যদি তার ছাত্রকে গণনা ও গণিতের প্রভেদ শেখাতে পারেন, গণিত অনেক ভারমুক্ত হয়. গণনার কিছু পদ্ধতি আছে. সেগুলো পৃথক ভাবে অভ্যাস করা দরকার। গণিতের কাজ যুক্তি সাজিয়ে গণনার উপযুক্ত ফর্ম তৈরী করা। ছাত্রছাত্রীদের সেই যুক্তিবাদের সাথে পরিচিত করাটাই ভীতি দূর করার উপায়।

[আরো পড়ুন – মাধ্যমিকে ভালো নম্বর কিভাবে পাওয়া যেতে পারে]

তৃতীয় কারণ, তাৎক্ষণিক লাভের আশা।

অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীদের কাছে পাঠ্য বিষয়গুলি বোঝার থেকে পরীক্ষার আশু ফলাফলের ওপর নির্ভরতা বেশি হয়ে যায়। তার জন্য নোটস মুখস্থ, সাজেশন ইত্যাদি চটজলদি পন্থা অনেক সহজ বলে বোধ হয়। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে বা উঁচু শ্রেণীতে উঠে বোঝা যায় যে একটি বিষয় রপ্ত করতে সেই বিষয়ের নম্বরটাই শেষ কথা নয়। যে বা যারা এমনিতেই বিষয়টিতে দড়ো তাদের জন্য সময় ধরে লেখা অভ্যাস করা, সীমিত শব্দে নিজের বক্তব্য পেশ করা রপ্ত হলেই নম্বর উঠে আসে। কিন্তু যারা বাকি পন্থা গুলো আপন করে, তাদের জন্য দীর্ঘকালীন দুর্ভোগ অপেক্ষা করে থাকে। আজকের সময়ে বহু ছাত্রছাত্রীকে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে উঠে শুধুমাত্র তার পূর্বপাঠের ভিত কাঁচা থাকার দরুন পাঠ্য বিষয়গুলি নিয়ে হিমশিম খেতে হয়। সর্বভারতীয় পরীক্ষাতে এরাই পিছিয়ে পড়ে সবার আগে। বিভিন্ন বোর্ড দ্রুত মুখস্থ করে লেখা উত্তরের রাস্তা থেকে সরে আসছে। জানা থেকে বোঝা ব্যাপারটায় জোর দিচ্ছে। সেখানে ওই প্রাচীন সাজেশন বা নোটস ব্যাপারটা আর খাটছে না। বুঝে না পড়লে পরীক্ষা হলে বসে যুক্তিবাদী প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এটা যতদিনে তারা বুঝছে, তাদের ততদিনে বোর্ড পরীক্ষা চলে আসছে। তাৎক্ষণিক লাভের আশা সুদূরপ্রসারী ফলাফলে ক্ষতিসাধন করছে। মুখস্থবিদ্যা অধিতবিদ্যাকে দূরে ঠেলে ভবিষ্যৎ পিষে দিচ্ছে।

এর থেকে মুক্তির রাস্তা কি?

কোনো দূরহ রোগের যেমন তাৎক্ষণিক সমাধান হয় না তেমনই এই সমস্যার কোনো চটজলদি উপায় নেই। একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকে জোর দিতে হবে ছাত্রছাত্রীদের পড়া বোঝার উপরে, লক্ষ্য রাখতে হবে তারা যেন ভয় পেয়ে অথবা শুধু নম্বর পাবার জন্য না পড়াশোনা করে। তারা যেন জানার আনন্দে পার করে চলে ভবিষ্যতের একটার পর একটা সোপান।

শিক্ষার শেকড়ের স্বাদ তেঁতো হলেও এর ফল মিষ্টি
– এরিস্টটল


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –