protyoy
Study (পড়াশোনা)

প্রত্যয় – সহজে ব্যাকরণ

সহজে ব্যাকরণ সিরিজ (একাদশ পর্ব) – প্রত্যয়


আবার আমরা নতুন একটি ক্লাস নিয়ে চলে এসেছি তোমাদের কাছে। এই সহজে ব্যাকরণের ক্লাস তোমাদের কেমন লাগছে জানাতে ভুলো না। তোমাদের জন্যেই সহজ করে, সহজ ভাষায় ব্যাকরণের বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করি। বাংলা ভাষার ব্যাকরণে তোমাদের অভ্যস্ত করে তুলতেই এই প্রয়াস।

আজ আমরা পড়বো প্রত্যয়।

বন্ধুরা তোমাদের নিশ্চয় মনে আছে ক্রিয়া পদ পড়ার সময় আমরা বলেছিলাম ধাতুর সঙ্গে প্রত্যয় আর বিভক্তি যুক্ত হয়ে ক্রিয়া পদ তৈরি হয়। এখন আমরা সেই প্রত্যয়ের বিষয়েই আরো বিশদে জানবো। তোমরা নিশ্চয় জানো ক্রিয়ার মূল হল ধাতু আর ব্যাকরণে শব্দের মূল উপাদানকে বলা হয় প্রকৃতি।

এখন এই প্রকৃতি দুই রকম। ক্রিয়াপদের মূলকে বলা হয় ধাতু-প্রকৃতি আর বাকি অন্য সমস্ত নামপদের মূলকে বলা হয় শব্দ-প্রকৃতি।

এই প্রকৃতির সঙ্গে যে বর্ণ বা বর্ণগুচ্ছ যোগ করে নতুন শব্দ তৈরি হয় তাকে বলে প্রত্যয়।

প্রত্যয়

তাহলে এবারে এর ব্যাকরণসম্মত সংজ্ঞাটি জেনে নেওয়া যাক –
ধাতু বা শব্দের প্রকৃতির সঙ্গে যে বর্ণ বা বর্ণগুচ্ছ যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ তৈরি করে তাকেই বলা হয় প্রত্যয়।
যেমন ধরো, ‘পড়া’ এই ক্রিয়াপদটিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এর মূলে ‘পড়্‌’ ধাতু রয়েছে। আর এই পড়্‌ ধাতুর সঙ্গে ‘আ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়েছে।

পড়্‌ + আ = পড়া
একইভাবে, চল্‌ + অন্ত = চলন্ত
বৃধ্‌ + মান = বর্ধমান
রঘু + ষ্ণ = রাঘব

নিশ্চয় এবারে ভাবতে বসেছো তোমরা প্রথমটা তো বুঝলাম, পরে এই অন্ত, মান, ষ্ণ এগুলি আবার কী বস্তু! কী ধরনের প্রত্যয়! একটুখানি ধৈর্য ধরো। সবই আমি তোমাদের বলবো। এটুকু তো তোমরা বুঝেই গেছো প্রত্যয় যে কোনো ধাতু বা শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ তৈরি করে। প্রত্যয়ের নিজস্ব কোনো অর্থ নেই।

এবারে তোমাদের জানতে হবে প্রত্যয় কয় প্রকার ও কী কী।
জেনে নাও বন্ধুরা, প্রত্যয় হল দুই প্রকার –
• কৃৎ প্রত্যয়
• তদ্ধিত প্রত্যয়
আগেই বলেছি প্রত্যয় ধাতু এবং শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়।

ধাতুর সঙ্গে যে প্রত্যয় যুক্ত হয় তাকে বলে কৃৎ প্রত্যয় আর শব্দ বা নামপদের সঙ্গে যে প্রত্যয় যুক্ত হয় তাকে বলে তদ্ধিত প্রত্যয়।

তাহলে বুঝতে পারলে নিশ্চয়। এখন দেখতে হবে কৃৎ প্রত্যয় হল দুই রকম – সংস্কৃত কৃৎ প্রত্যয় আর বাংলা কৃৎ প্রত্যয়। একইভাবে তদ্ধিত প্রত্যয় আবার তিন রকম – সংস্কৃত তদ্ধিত প্রত্যয়, বাংলা তদ্ধিত প্রত্যয় আর বিদেশি তদ্ধিত প্রত্যয়।

এবারে তো আমাদের উদাহরণ দেখে নেওয়ার পালা।

তার আগে একটা বিষয় বুঝিয়ে দিই। দেখো কৃৎ প্রত্যয় আর তদ্ধিত প্রত্যয় উভয় ক্ষেত্রেই সংস্কৃত আর বাংলা এই হিসেবে ভাগ রয়েছে।

কেন এমন হল?

আসলে বাংলা ব্যাকরণের প্রায় বেশিরভাগ বিষয়ই সংস্কৃত ভাষা থেকে ধার করা। বিখ্যাত বৈয়াকরণ পাণিনির ‘অষ্টাধ্যায়ী’ হল সংস্কৃত ভাষার আকর ব্যাকরণের বই আর এ থেকেই বেশিরভাগ ব্যাকরণের ধারণা বাংলায় গৃহীত হয়েছে।

তাই প্রত্যয়ের ক্ষেত্রেও কিছু কিছু প্রত্যয় আমরা দেখবো সেগুলি একেবারে খাঁটি সংস্কৃত প্রত্যয় আর কিছু কিছু প্রত্যয় আমরা দেখবো সেগুলি মৌলিক বাংলা প্রত্যয়। এবারে চলো দেখে নিই প্রত্যয়গুলির চেহারা ঠিক কিরকম।

দেখো কৃৎ প্রত্যয়ের মধ্যে রয়েছে নিম্নলিখিতগুলি-
• সংস্কৃত কৃৎ প্রত্যয় – ক্ত, ক্তি, শান্‌চ, তৃচ্‌, তব্য, অনট্‌, ইষ্ণু ইত্যাদি
• বাংলা কৃৎ প্রত্যয় – অন্‌, আ, অনা, অন্ত, আই, আন, আরি, ই, ইলে, উক্‌, অক্‌ ইত্যাদি

আর বন্ধুরা তদ্ধিত প্রত্যয়ের মধ্যে রয়েছে নিম্নলিখিতগুলি-
• সংস্কৃত তদ্ধিত প্রত্যয় – ষ্ণ, ষ্ণি, ষ্ণীয়, ষ্ণিক, ময়ট্‌, ইমন্‌ ইত্যাদি
• বাংলা তদ্ধিত প্রত্যয় – আ, আই, আর, আরি, ইয়া, উয়া, টিয়া, পানা, পনা ইত্যাদি
• বিদেশি তদ্ধিত প্রত্যয় – আনা, ওয়ান, খোর, চি, দার, গিরি, নবিশ, বাজ, খানা ইত্যাদি

আশা করি প্রত্যয়গুলি কিরকম হয় তা বাইরের চেহারা দেখে বোঝা গেছে। এবারে আমরা পরপর উদাহরণের মাধ্যমে একে একে এগুলির ব্যবহারগুলি বুঝে নেবো। প্রথমে কৃৎ প্রত্যয়টা দেখে নেওয়া যাক। এই উদাহরণে দুটি জিনিস তোমাদের খেয়াল রাখতে হবে সেটা হল – ক্রিয়ার ক্ষেত্রে ধাতুটি কী আর তার সঙ্গে কোন প্রত্যয় যুক্ত হচ্ছে, শব্দের ক্ষেত্রে মূল শব্দ-প্রকৃতি কোনটা আর তার সঙ্গে কি প্রত্যয় যুক্ত হচ্ছে। কৃৎ প্রত্যয়ের ক্ষেত্রে ক্রিয়ার ধাতু নিরুপণ করা জরুরি।


আরো পড়ো→ ধ্বনির ধারণা | বর্ণ | বাক্য | সন্ধি

যেমন তোমাদের সুবিধের জন্য বলি, যাওয়া (গমন), করা, খাওয়া, দেখা, বলা এই ক্রিয়াগুলির ধাতু হল যথাক্রমে গম্‌, কৃ, খা, দৃশ্‌, বচ্‌ ইত্যাদি। এভাবে উদাহরণগুলি ভালোভাবে অধ্যয়ন করলে তোমরা দেখতে পাবে আপনা আপনিই তোমরা ক্রিয়ার ধাতুগুলি শিখে গেছ। কিছু কিছু প্রত্যয় চেনার কিছু বিশেষ কৌশল রয়েছে সেগুলিও তোমাদের বলবো এখানে। আগে উদাহরণ দেখে নাও।

কৃৎ প্রত্যয়

গম্‌ + ক্ত = গত
কৃ + ক্ত = কৃত
স্না + ক্ত = স্নাত
গম্‌ + ক্তি = গতি
দৃশ্‌ + ক্তি = দৃষ্টি
শম্‌ + ক্তি = শান্তি
বৃৎ + শানচ্‌ = বর্তমান
বিদ্‌ + শানচ্‌ = বিদ্যমান
ধা + তৃচ্‌ = ধাতা
নী + তৃচ্‌ = নেতা
দা + তৃচ্‌ = দাতা
কৃ + তৃচ্‌ = কর্তা
গম্‌ + অনট্‌ = গমন
নী + অনট্‌ = নয়ন
দৃশ্‌ + অনট্‌ = দর্শন
স্মৃ + অনট্‌ = স্মরণ
গম্‌ + তব্য = গন্তব্য
স্মৃ + তব্য = স্মর্তব্য
ধৃ + তব্য = ধর্তব্য
কৃ + অনীয় = করণীয়
পূজ্‌ + অনীয় = পূজনীয়
পা + অনীয় = পানীয়
নে + অক্‌ = নায়ক
পঠ্‌ + অক্‌ = পাঠক
গৈ + অক্‌ = গায়ক
কৃ + অক্‌ = কারক
এভাবে তোমরা নিশ্চয় খেয়াল করেছো কোন ক্রিয়াপদের কি ধাতু হচ্ছে, কিভাবে কোন প্রত্যয় যুক্ত হচ্ছে। এগুলি সব সংস্কৃত কৃৎ প্রত্যয়। এই যে আমরা যেভাবে বিশ্লেষণ করছি সেই পদ্ধতিকে বলা হয় প্রকৃতি-প্রত্যয় নির্ণয় করা বা ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করা। আরো কিছু সংস্কৃত কৃৎ প্রত্যয় রয়েছে দেখে নাও একঝলকে –
পা + য্যৎ = পেয়, সহ্‌ + য্যৎ = সহ্য, কৃ + ণ্যৎ = কার্য, দৃশ্‌ + ক্যপ্‌ = দৃশ্য
বৃধ্‌ + ইষ্ণু = বর্ধিষ্ণু, সহ্‌ + ইষ্ণু = সহিষ্ণু

এইবার তোমাদের কিছু কৌশল বলি মনে রাখার বা চেনার। খুবই সহজ। দেখো বন্ধুরা ক্রিয়ার শেষে ত, তি, তা ইত্যাদি থাকলে প্রত্যয় হবে ক্ত, ক্তি, তৃচ্‌। এটা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ। একইভাবে ক্রিয়ার শেষে তব্য, অন, অনীয় ইত্যাদি থাকলে যথাক্রমে তব্য, অনট্‌, অনীয় প্রত্যয় হবে। এভাবে খুব সহজেই কিছু সাধারণ প্রত্যয়কে তোমরা চিনে নিতে পারবে। এবারে আমরা দেখে নিই বাংলা কৃৎ প্রত্যয়গুলি কিভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

দেখ্‌ + আ = দেখা
গড়্‌ + অন্‌ = গড়ন
কাঁদ্‌ + অনা = কান্না
বাড়্‌ + অন্ত = বাড়ন্ত
লড়্‌ + আই = লড়াই
ঘির্‌ + আও = ঘেরাও
হাতা + আনো = হাতানো
নাচ্‌ + উনি = নাচুনি
নিন্দ্‌ + উক্‌ = নিন্দুক
পড়্‌ + উয়া = পড়ুয়া
ডুব্‌ + উরি = ডুবুরি
রাঁধ্‌ + উনি = রাঁধুনি
এইগুলি সব বাংলা প্রত্যয়। এগুলি মনে রাখা আরো সহজ কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখো বন্ধুরা প্রত্যয়গুলি সন্ধির মতো যুক্ত হয়েছে। ফলে তোমরা ঐ সন্ধির মতো করেই এগুলিকে মনে রাখবে।
এরপরে চলো দেখে নিই তদ্ধিত প্রত্যয়ের উদাহরণ।
সংস্কৃত তদ্ধিত প্রত্যয়ের ক্ষেত্রে বেশিরভাগই দেখা যায় মূল শব্দের সঙ্গে প্রত্যয়গুলি যুক্ত হয়ে নতুন শব্দ তৈরি হয়েছে তবে তারও একটা যুক্তি থাকে।
যদু + ষ্ণ = যাদব, দশরথ + ষ্ণি = দাশরথি, অগ্নি + ষ্ণেয় = আগ্নেয়, বেদ + ষ্ণিক = বৈদিক


আরো পড়ো→ সর্বনাম | বিশেষণ | ক্রিয়া | ধাতু

এখানে শব্দের অর্থ বুঝলেই প্রত্যয় বোঝা হয়ে যাবে। যদুর পুত্র যাদব, দশরথের পুত্র দাশরথি, অগ্নি থেকে জাত যা তাই হল আগ্নেয় আর একইভাবে বেদ থেকে সৃষ্ট যা তাকে বলে বৈদিক। অর্থাৎ এই ষ্ণ, ষ্ণি, ষ্ণেয়, ষ্ণিক এই প্রত্যয়গুলি জাত বা সৃষ্ট অর্থে বসে। আরো অন্যান্য তদ্ধিত প্রত্যয়গুলি হল –
দরিদ্র + ষ্ণ্য = দারিদ্র্য, নর + ষ্ণায়ণ = নারায়ণ, চিৎ + ময়ট্‌ = চিন্ময়, নীল + ইমন্‌ = নীলিমা
এই প্রত্যয়গুলির আরো উদাহরণ তোমরা ব্যাকরণের বইগুলিতে দেখতে পাবে। তোমাদের কেবল ধারণা পরিস্কার করার গুরুদায়িত্ব এই ক্লাসের। আশা করি তোমরা প্রত্যয়ের বিষয়টা বুঝতে পেরেছ।
এরপরে চলো দেখবো বিদেশি আর বাংলা কিছু তদ্ধিত প্রত্যয়।
তেল + আ = তেলা, বড় + আই = বড়াই, শাঁখা + আরি = শাঁখারি, কীর্তন + ইয়া = কীর্তনিয়া, মাছ + উয়া = মাছুয়া ভাড়া + টিয়া = ভাড়াটিয়া পাগল + পারা = পাগলপারা
দুরন্ত + পনা = দুরন্তপনা

এইগুলি হল সবই বাংলা তদ্ধিত প্রত্যয়। এগুলিও দেখো আগের মতোই সব সন্ধির নিয়মে হচ্ছে। তবে বিদেশি প্রত্যয়ের ধরন একটু আলাদা। দাঁড়াও উদাহরণ দিই –
বাঙালি + আনা = বাঙালিয়ানা
দর + ওয়ান = দারোয়ান
ঘুষ + খোর = ঘুষখোর
কারি + গর = কারিগর
তবলা + চি = তবলচি
ঝাড়ু + দার = ঝাড়ুদার
কেরানি + গিরি = কেরানিগিরি
চাল + বাজ = চালবাজ
পছন্দ + সই = পছন্দসই
ডাক্তার + খানা = ডাক্তারখানা
ফুল + দানি = ফুলদানি
বিদেশি তদ্ধিত প্রত্যয় যুক্ত হয়ে বিদেশি শব্দ গঠিত হয়। উপরের শব্দগুলি সবই বিদেশি শব্দ যা বাংলায় আমরা ব্যবহার করে থাকি।
এই ছিল আজকের প্রত্যয়ের ক্লাসের সাত-সতেরো। তোমরা আশা করি উদাহরণগুলি দেখে কিভাবে শব্দ দেখেই প্রত্যয় নির্ণয় করা যায় তা খানিক রপ্ত করে ফেলেছো। বাকিটা অভ্যাস, অভ্যাস আর অভ্যাস। তাহলে আজ এখানেই ক্লাস শেষ। এবার তোমাদের অভ্যাস শুরু হোক।

একাদশ পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → কারকের ধারণা – সহজে ব্যাকরণ

এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখাটি, অডিও, ভিডিও বা অন্য কোন ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতিঃ

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –

Protyoy