pralayollas-kobitar-sorolartho
Madhyamik

প্রলয়োল্লাস কবিতার সরলার্থ

বাংলা দশম শ্রেনি – প্রলয়োল্লাস (পদ্য) ২য় পর্ব

আগের পর্বে আমরা ‘বিদ্রোহী কবি’ কাজী নজরুল ইসলাম রচিত প্রলয়োল্লাস কবিতার সারাংশ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এই পর্বে আমরা প্রলয়োল্লাস কবিতার সরলার্থ নিয়ে আলোচনা করবো।


প্রলয়োল্লাস কবিতার বিস্তারিত আলোচনা দেখে নাও এই ভিডিও থেকে↓


প্রলয়োল্লাস কবিতার সরলার্থ

নূতনের আগমন বার্তা সূচিত হয়েছে। সেই ‘নূতন’কে স্বাগত জানাতে তার জয়গান দিকে দিকে ধ্বনিত করে তুলতে চাইছেন কবি। কবিতার শুরুতেই আমরা দেখি জয়ধ্বনির উল্লাস। এই জয়গান নবীনের জয়গান। ভারতের তরুণ দামাল বিপ্লবী সন্তানেরা প্রলয়ের নেশায় মত্ত – পরাধীনতার গ্লানি দূর করতে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আর সেই কল্যাণযজ্ঞ অসুররূপী ব্রিটিশ শক্তির নিধনের মধ্য দিয়ে সফল হবে। বিপ্লবের আবেগে যেন কালবৈশাখির মত্ত ঝড় উঠেছে দেশজুড়ে – এই ঝড়ে ঘুচে যাবে সব শৃঙ্খল। তাই কবি লেখেন –

‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়’

কবি নজরুল স্বপ্ন দেখেছেন বিপ্লবের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ভারতে উঠবে স্বাধীনতার সূর্য। সমস্ত ভারতবাসীর মনে একযোগে বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা-মুক্তির স্বপ্ন জাগরিত হলে তবেই আসবে অখণ্ড স্বাধীনতা। অনাগত প্রলয় যেন উদ্দাম নৃত্যে মেতেছে, মহাকাল উন্মত্ত হয়ে প্রতীক্ষা করছে এক ভয়ঙ্করের। কবি এই ভয়ঙ্করের আবির্ভাব চান।


jump magazine plus


সিন্ধুপারের সিংহদ্বার বলতে ব্রিটিশ শক্তিকেই বোঝানো হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সমগ্র ভারতবাসীর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এক প্রবল রুদ্রতেজে ব্রিটিশ শাসনের ভিত নড়িয়ে দিতে শুরু করেছে। কবি সমগ্র কবিতাটিতে অনাগত বিপ্লবকে ‘ভয়ংকর’ বলেছেন। এই শব্দপ্রয়োগ আসলে প্রতীকী। এই ভয়ংকরের কোলে আছে রক্তমাখা তরবারি, তার চুলের ঝাপটায় আকাশ দুলে ওঠে, জ্বালামুখী পুচ্ছ নাচিয়ে মুক্তিদাতার মতোই আবির্ভাব ঘটবে সেই ভয়ংকরের, এমনটাই কবি স্বপ্ন দেখেছেন।

আসলে তরুণ সব বিপ্লবীদের সংগ্রামে, উন্মত্ত অট্টহাসিতে যেন চরাচর স্তব্ধ হয়ে আছে। নজরুল বারবার মহাকাল, প্রলয় এবং আরো নানা পৌরাণিক অনুষঙ্গ কবিতায় আনেন প্রতীক হিসেবে। মহাকাল বা প্রলয় আসলে দেবাদিদেব মহাদেব যার দুই রূপ – রক্ষক এবং সংহারক। ধ্বংস এবং সৃষ্টির লীলায় তিনি জগতকে লালন-পালন করেন। মহাদেবের প্রলয় নৃত্যের ধ্বংসের মধ্য দিয়েই সৃষ্টির নতুন নিশান উড়বে। নজরুল বিপ্লবী তরুণ ভারতীয়দের মহাদেবের সঙ্গে তুলনা করেছেন এভাবে। আসলে বিপ্লবও তো ধ্বংসের মধ্য দিয়ে নতুন সৃষ্টির কথা বলে। আর এই নতুন আসবে ভয়ংকরের বেশে যাকে প্রতিহত করার ক্ষমতা কারোর নেই। কবি লিখছেন –

‘দ্বাদশ রবির বহ্নিজ্বালা ভয়াল তাহার নয়নকটায়,

দিগন্তরের কাঁদন লুটায় পিঙ্গল তার ত্রস্ত জটায়।’

এখানে দ্বাদশ রবি আসলে পুরাণের অনুষঙ্গ। এই দ্বাদশ রবি হল – বিবস্বান, অর্যমা, পুষা, ত্বষ্টা, সবিদা, ভগ, ধাতা, বিধাতা, বরুণ, মিত্র, শত্রু, উরুক্রম। এই দ্বাদশ রবির তেজ মিশে আছে সেই ভয়ংকরের চোখে, হতাশাগ্রস্ত দেশের আকাশে সে তার উন্মত্ত জটায় ছড়িয়ে দিচ্ছে নতুনের তেজ। তার চোখের জলে সাতটি মহাসাগর দুলে উঠেছে। এই ভয়ংকর যেন বিশ্বপ্রকৃতিরই অনুরূপ। সর্বশক্তিমান প্রকৃতিও যেন এই পরাধীনতার বিরুদ্ধে জাগ্রত হয়েছে।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

রবীন্দ্রনাথ যেমন লিখেছিলেন ‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা / আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’। এই নবীনের জয়গান নজরুলও গাইছেন, তাঁর মতোই নজরুল আধমরাদের বাঁচাতে, ‘জরায়-মরা মুমূর্ষুদের’ জাগিয়ে তুলতে বলেছেন ঐ ভয়ংকরকে। আর তারপরই –

‘এবার মহানিশার শেষে

আসবে উষা অরুণ হেসে’

অরুণ আসলে নবোদিত সূর্য হলেও এখানে কবি মৃত্যুঞ্জয়ী বীর বিপ্লবীদের বোঝাতে ‘অরুণ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। পরাধীনতার বঞ্চনা-শোষণ-অত্যাচারের অবসানের মধ্য দিয়ে নতুন দিনের সূর্য উঠবে। মহাদেব প্রলয়ের মধ্যে, ধ্বংসের মধ্যে নতুন সৃষ্টির বীজ জন্ম দেন। তাঁর কপালে থাকে চাঁদ, ধ্বংসের মধ্যে যা সুন্দরের বার্তা। তাই কবি বলেন –

 ‘দিগম্বরের জটায় হাসে শিশু-চাঁদের কর – ’

এই নূতনের, এই ভয়ংকরের আসার সময় সূচিত হয়েছে, ঘনিয়ে এসেছে মহাপ্রলয়ের কাল। ভয়ংকরের রথের চাকার শব্দ শুনতে পাচ্ছেন কবি। সুদিন সমাগত। বারবার তাই কবি এই ভয়ংকরের জয়ধ্বনি করতে বলছেন। গানের মতোই ধুয়ো উঠেছে বারবার এই কবিতায়। ‘প্রলয়োল্লাস’ আসলে একটি কোরাসধর্মী গীতিকবিতা তাই এমন ধুয়ো। জগত জুড়ে প্রলয়ের মেঘ ঘনিয়ে উঠেছে।


jump magazine plus


বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে অন্যান্য দেশে। রুশ বিপ্লব, আয়ারল্যাণ্ডের বিপ্লব, তুরস্কে কামাল পাশার উত্থান ইত্যাদি ঘটনা সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার জন্য বিপ্লবের জাগরণকে সূচিত করেছে।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবন বিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

কবি এইসব ঘটনায় গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। ব্রিটিশ সরকার যখন ভারতের বিপ্লবীদের কণ্ঠরোধ করতে পাঠিয়ে দিচ্ছিল আন্দামানের কুখ্যাত সেলুলার জেলে, সমুদ্রপারের অত্যাচারে তখনো বিপ্লবকে দমিয়ে রাখা যায়নি। ভারতমাতার পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনে মাভৈঃ মন্ত্র ধ্বনিত হচ্ছে দিকে দিকে। ভারতমায়ের বীর সন্তানদের ‘জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন’। তারাই প্রলয়, তারাই মহাকালের ভয়ংকর শক্তি। আন্দামানের কারাগারে এই ধ্বংসের দেবতারা বন্দি, তাই কবি লেখেন –

‘অন্ধ কারার বন্ধ কূপে

দেবতা বাঁধা যজ্ঞ-যূপে’

সত্য-শিব-সুন্দরের পূজারি কবি নজরুল ধ্বংসের মধ্যে সুন্দরের প্রকাশ দেখেছেন। মহাদেবের সৃষ্টি-ধ্বংসের ভাঙা-গড়ার খেলায় ভয় নেই। নবীনের জয়গান গেয়ে যা কিছু অসুন্দর তা ধ্বংস করার ডাক দিয়েছেন কবি। প্রলয়ের উল্লাসে সমস্ত ভারতবাসীকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন স্বাধীনতার কামনায় আর তাই বারবার সেই নূতনের- সেই ভয়ংকরের জয়ধ্বনি করতে বলেছেন তিনি।

সমাপ্ত।


লেখক পরিচিতিঃ

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –