upsonghar
Madhyamik

সিরাজদ্দৌলা – উপসংহার

বাংলা দশম শ্রেনি – সিরাজদ্দৌলা (নাটাংশ্য) – উপসংহার

সিরাজদ্দৌলা নাট্যাংশের শেষে আমরা দেখতে পাই যে সিরাজ তথা তাঁর অমাত্য ও সেনাপতিগণ ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য পলাশী প্রাঙ্গণের উদ্দেশ্যে রওনা হন।

এর পর কি ঘটেছিল তা আমরা ইতিহাসের পাতায় পড়েছি।

আমরা সবাই জানি পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পরাজয় ঘটে এবং ধীরে ধীরে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা তথা ভারতকে অধিগ্রহণের পথে অগ্রসর হয়। কিন্তু সিরাজের প্রধান সেনাপতি মীরজাফর, সিরাজের মাসি ঘসেটি বেগম এবং প্রধান অমাত্যরা ইংরেজদের সঙ্গে নিয়ে যে ষড়যন্ত্র রচনা করেছিলেন তার ফল কি হয়েছিল?

ষড়যন্ত্রীরা কি তাঁদের স্বার্থসিদ্ধি করতে পেরেছিল?

ইতিহাস এই ঘটনার সাক্ষী থাকলেও, এই অংশটি তোমাদের অনেকেরই অজানা। তাই ‘সিলেবাস বহির্ভূত’ এই বিশেষ অংশটি তোমাদের জানানোর আগ্রহে আমরা ‘উপসংহার’ হিসাবে প্রকাশ করলাম।


[সিরাজদৌল্লা নাট্যাংশের আলোচনা তিনটি পর্বে আগেই প্রকাশিত হয়েছে। পর্বগুলি পড়ুন → প্রথম পর্ব | দ্বিতীয় পর্ব | তৃতীয় পর্ব ]

উপসংহার

সিরাজের বিরুদ্ধে প্রধান ষড়যন্ত্রকারী ছিলেন তাঁর প্রধান সেনাপতি মীরজাফর আলি। সিরাজ জানতেন যে  মীরজাফর তাঁর পতন চান এবং তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, কিন্তু তা সত্বেও সিরাজ মীরজাফরকে বিশ্বাস করেছিলেন। শোনা যায় পলাশীর যুদ্ধের পূর্বে মীরজাফর পবিত্র কোরান হাতে নিয়ে শপথ করেছিলেন যে তিনি সিরাজের পক্ষে যুদ্ধ করবেন। কিন্তু বলাই বাহুল্য তিনি তা করেননি। সিরাজের বিপুল সৈন্যবাহিনীর দায়িত্ব প্রধানত ছিল মীরজাফরের হাতে, কিন্তু মীরজাফরের অধীনস্ত সেই বিপুল বাহিনী যুদ্ধে অংশগ্রহনই করেনি।

jump magazine smart note book

কারণ, যুদ্ধক্ষেত্রে মীরজাফর তাঁর সেনাদের যুদ্ধের কোন আদেশই দেন নি। শুধু তাই নয়, মীরজাফর ক্রমশ চেষ্টা করেছেন কিভাবে ভুল মন্ত্রনা দিয়ে সিরাজকে বিপথে চালনা করা যায়। যুদ্ধের শুরুতে গোলন্দাজ বাহিনীর সেনাপতি এবং সিরাজের অনুগত মীরমদনের মুহুর্মুহু গোলার আক্রমণে, ক্লাইভ পরিচালিত ইংরেজ বাহিনী পিছু হটতে শুরু করে।

কিন্তু, দিনটা বোধহয় সিরাজের অনুকূলে ছিল না। অতর্কিত বৃষ্টির ফলে গোলন্দাজ বাহিনীর বারুদ ভিজে যায় এবং হটাৎ মীরমদন গোলার আঘাতে প্রাণ হারান।

এর পরেই ধীরে ধীরে যুদ্ধের রাশ ইংরেজদের পক্ষে চলে যায়। কারণ মীরমদনের মৃত্যুর পরে, একমাত্র মোহনলাল ছাড়া আর সব সেনাপতি সেদিনের জন্য যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব করেন এবং সিরাজ তা মেনে নেন। এর ফল হয় মারাত্মক, আচমকা আক্রমণে এবং প্রায় বিনা বাধায়, ক্লাইভের বাহিনী সিরাজের বাহিনীকে হারিয়ে দেয়। সিরাজ ছদ্মবেশে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন ও পরে তাঁর প্রাণ যায়।

পলাশীর যুদ্ধ
পলাশীর যুদ্ধের কল্পিত চিত্র [চিত্র সৌজন্য – IndiaToday.in]

এর পর?

সিরাজের অমাত্যরা ভেবেছিলেন, সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করে তাদের প্রিয় কাউকে সিংহাসনে বসাবেন এবং বাংলাকে শাসন করবেন। এর জন্যই তাঁরা ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন।

বাঘ যেমন মানুষের রক্তের স্বাদ পেলে আর  বনের পশু পাখির দিকে ফিরেও তাকায় না, ঠিক তেমনই বিশ্বের অন্যতম বিত্তশালী ধনভাণ্ডার বাংলাকে অধিকার করার সুযোগ পেয়ে ইংরেজরা আর সেই সুযোগ হারায়নি।

কথিত আছে পলাশীর যুদ্ধের পরে সাত জাহাজ ভরা অর্থ, মণি – মানিক্য উপঢৌকন ইংল্যান্ডে গিয়েছিল। বাংলার এই বিপুল অর্থ শিল্পবিপ্লবে ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় ইংরেজদের অনেকটাই এগিয়ে  দিয়েছিল।

এদিকে মীরজাফর বাংলার পরবর্তী নবাব হলেও, তিনি ছিলেন ইংরেজদের হাতের পুতুল। মাত্র কয়েকবছর শাসনের পরেই ইংরেজরা তাকে সিংহাসনচ্যুত করে। অর্থাৎ, সিরজের মৃত্যুর পরে বাংলার শাসনভার প্রায় অধিকাংশরূপে ইংরেজদের হাতে চলে যায়। ভারত অধিগ্রহণে এরপর ইংরেজদের আর পেছনে  ফিরে তাকাতে হয় নি। সিরাজের পতন, ভারতে ইংরেজ দাসত্বের একটা ‘মাইলস্টোন’।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

ষড়যন্ত্রীদের কি হল?

নাট্যাংশে আমরা পড়েছি যে রাজবল্লভ সিরাজকে বলছেন যে “পাপ কখনও চাপা থাকে না”।

ঠিক তাই হয়েছিল ষড়যন্ত্রীদের। এরা প্রত্যেককেই হয় ক্ষমতার লোভে কিংবা অর্থের লোভে সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু একমাত্র ইংরেজ ছাড়া এই ষড়যন্ত্র থেকে কারুর কোন লাভ হয় নি। নবাব হবার পরে ষড়যন্ত্রীকারীদের অর্ধেককে মিরজাফর ও তার পরবর্তী নবাব হত্যা করে আর অর্ধেককে প্রাপ্য অর্থ থেকে প্রতারিত করে ইংরেজরা।

siraj

২৫০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, গঙ্গা দিয়ে বহু জল অতিবাহিত হয়েছে। দীর্ঘদিন হল ভারতবর্ষ ইংরেজদের দাসত্ব মোচন করে পৃথিবীর বুকে এক অন্যতম শক্তিশালী দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। কিন্তু আজও ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদৌল্লা ও তাঁর ‘নিমকহারাম’ সেনাপতি মীরজাফর।
whats-app subscrition_jump-mag

সিরাজদ্দৌলা চরিত্রের বিশ্লেষণঃ

‘সিরাজদ্দৌলা’ নাট্যাংশের প্রধান চরিত্র হলেন সিরাজদৌলা। এই নাট্যাংশটি সিরাজের দরবারের একটি ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ হলেও, এই অল্প সময়ের মধ্যেও আমরা সিরাজের চরিত্রের নানান প্রতিফলন দেখতে পাই।

siraj-ud-daulah
সিরাজ।

প্রথমত, সিরাজ ছিলেন অনভিজ্ঞ।

তার জীবনী থেকে আমরা জানি যে সিরাজের দাদু আলীবর্দি খাঁ তার জীবদশায় সিরাজকে তার উত্তরসুরি ঘোষণা করেছিলেন, তখন সিরাজের বয়স ছিল মাত্র সাতেরো বছর। এর পরে আলীবর্দি খাঁ-য়ের মৃত্যুর পরে মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে সিরাজ সিংহাসন লাভ করেন। বিত্তশালী ও সুবিশাল বাংলার মসনদে বসার অভিজ্ঞতা তরুণ সিরাজের ছিল না। শুধু তাই নয়, সিংহাসন আরোহণের পর থেকেই, সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ফলে অনভিজ্ঞ সিরাজ পরামর্শদাতা হিসাবে কাউকে পাননি।

jump magazine smart note book

তার এই অনভিজ্ঞতার আরো একটি পরিচয় আমরা পাই পলাশীর যুদ্ধে, সিরাজের সৈন্যবাহিনী ছিল সুবিশাল (50,000 সৈন্য এবং 53টি কামান) সেই তুলনায় ইংরেজ সেনাপতি ক্লাইভের সেনা ছিল অতি সামান্য (1000 ইউরোপিয়ান সৈন্য এবং কিছু ভাড়া করা ভারতীয় সেনা, 7টি কামান)। সুতরাং, সেনাবাহিনীর জোরে সিরাজের যুদ্ধে জয় ছিল নিশ্চিত। কিন্তু অনভিজ্ঞ সিরাজ কমজোরি ইংরেজদেরও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবন বিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

দ্বিতীয়ত, সিরাজ ছিলেন অদূরদর্শি।

তাঁকে তার জীবন দিয়ে অদূরদর্শিতার পরিনাম দিতে হয়েছিল। যেসকল সমস্যা তিনি রাজনৈতিক ভাবে মেটাতে পারতেন তা তিনি গায়ের জোরে মেটাবার চেষ্টা করেছিলেন আবার তিনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাতে তিনি টিকে থাকতে পারেননি।

যেমন, সিরাজ বিপুল সেনাবাহিনী নিয়ে কলকাতায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করেন এবং ফোর্ট উইলিয়াম দখল নেন। কিন্তু পরবর্তি সময়ে ইংরেজরা তা দখল করে এবং সিরাজ ইংরেজদের সাথে আলিনগরের সন্ধির করতে বাধ্য হন। এই চুক্তির ফলে সিরাজ রাজনৈতিক ভাবে আরো দুর্বল হয়ে পড়েন। তাঁর স্বল্প  মেয়াদের শাসনকালের প্রথমদিকে তিনি আমাত্যদের সঙ্গে নিয়ে চলতে পারেননি। তাই প্রধান অমাত্য এবং প্রভাবশালি ব্যাক্তিরা সিরাজের উপর খুশি ছিলেন না। এর মাশুল হিসাবে, পরবর্তি সময়ে অমাত্যদের একটা বিরাট অংশ সিরাজের বিপক্ষে চলে যান।

whats-app subscrition_jump-mag

তৃতীয়ত, সিরাজ ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক।

সিরাজের অনেক দোষ থাকলেও একটি বিষয়ে তিনি ছিলেন আপসহীন, আর তা ছিল তার দেশপ্রেম। তাঁর কাছে বাংলার স্বাধীনতা ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। আলচ্য নাট্যাংশে আমরা দেখেছি যে, সিরাজ কীভাবে বারংবার তাঁর সেনাপতি এবং অমাত্যদের দ্বারা অপমানিত এবং সমালোচিত হয়েছেন,  অপরদিকে সিরাজ বুঝতে পেরেছিলেন যে তার সেনাপতি এবং অমাত্যরা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, কিন্তু নিজের বিপদ বুঝেও সিরাজ তাদের অপসারণ করেননি। নিজের বিপদ বুঝেও সত্বেও তিনি তাদের অনুরোধ করেছেন যে তারা যেন বাংলার দুর্দিনে সিরাজের পাশে দাঁড়ান। এমনকি বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার পরিবর্তে তিনি নিজের সিংহাসন ত্যাগ করতেও পিছপা ছিলেন না।

সমাপ্ত। আরো পড়ো – পথের দাবী গল্পের সম্পূর্ণ আলোচনা


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X_Ben_Siraj_4