varoter-hrod-upohrod-updated
Madhyamik

ভারতের হ্রদ ও উপহ্রদ

ভূগোলদশম শ্রেণি – আঞ্চলিক ভূগোল (অষ্টম পর্ব)


আগের পর্বে আমরা ভারতের নদনদী সম্পর্কে আলোচনা করেছি এই পর্বে আমরা ভারতের হ্রদ ও উপহ্রদ সম্পর্কে জেনে নেব।

ভারতবর্ষে দুই ধরনের হ্রদ দেখতে পাওয়া যায়। যথা –

1. সুপেয় জলের হ্রদ

সুপেয় কথার অর্থ যা পান যোগ্য; সুতরাং যে হ্রদের জল পান করা যায় সেই ধরণের হ্রদকে সুপেয় জলের হ্রদ বলা হয়।

জম্মু-কাশ্মীরের উলার হ্রদ হল ভারতের সর্ববৃহৎ সুপেয় জলের হ্রদ। এছাড়া ডাল হ্রদ, হিমালয়ের সাততাল, ভিমতাল, নৈনিতাল ও মনিপুরের লোকটাক হল সুপেয় জলের হ্রদের উদাহরণ।

সুপেয় জলের হ্রদ উলার (Imran Rasool Dar, Licensed under, CC BY-SA 4.0)

2. লবণাক্ত জলের হ্রদ

নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে এই ধরণের হ্রদে লবণ বা নুনের পরিমাণ বেশি থাকে। তাই এই জল পানযোগ্য নয়।

রাজস্থানের থর মরুভূমির পুষ্কর, সম্বর, দিদওয়ানা, পচপদ্রা, দেগনা, কাচমান, জম্বু কাশ্মীরের শুষ্ক লাদাখ মালভূমিতে অবস্থিত প্যাংগং ও সো-মোরিরি এছাড়া অন্ধ্রপ্রদেশের কোলেরু ও তামিলনাড়ুর পুলিকট হল লবণাক্ত হ্রদের উদাহরণ।

সম্বর হ্রদের উপগ্রহ চিত্র

মানব জীবনে হ্রদের গুরুত্ব

জল ছাড়া মানুষের বেঁচে থাকা অসম্ভব। নদীকে কেন্দ্র করে যেভাবে সভ্যতা গড়ে উঠেছে, সেই একই ভাবে হ্রদকে কেন্দ্র করেও মানুষ তার বাসস্থান গড়ে তুলেছে, শুধু মাত্র জল পানের জন্যই নয়, হ্রদ মানব জীবনকে নানা ভাবে প্রভাবিত করে।

● জলের উৎস

পানীয় জল, সেচ ও শিল্পের কাজে হ্রদের জল ব্যবহার করা হয়। যেমন দার্জিলিং শহরে পানীয় জল সিঞ্চল থেকে আসে।

● জীবিকা নির্বাহে

হ্রদে প্রচুর পরিমাণে মাছ জন্মায়। হৃদ সংলগ্ন অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষেরা মাছ ধরে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে।

যেমন ,ওড়িশার চিলকা হ্রদ ভারতের বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ মৎস্য আহরণ কেন্দ্র রূপে পরিচিত।

● জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ

হ্রদ হল বিভিন্ন রকমের জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের বাসস্থান। সুতরাং এটি অন্যতম জলজ বাস্তুতন্ত্রের ক্ষেত্র এবং জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষনাগার হিসাবে কাজ করে।

● জলাধার হিসাবে

নদী বাঁধের পিছনে অবস্থিত হ্রদ জল ধারক রূপে কাজ করে। হ্রদ অতিবৃষ্টির সময় অতিরিক্ত জলকে সংরক্ষণ করে সংলগ্ন এলাকাকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করে।

● পর্যটন ও বিনোদন

হ্রদের সৌন্দর্য পর্যটকদের আকৃষ্ট করে এবং এর জলে নৌকা বিহার করে পর্যটকরা খুব আনন্দ পায়। যেমন- কাশ্মীরের ডাল হ্রদ।

কাশ্মীরের ডাল লেকের মনোরম দৃশ্য (Suhail yousuff, Licensed under, CC BY-SA 4.0)

জলাশয়

ভারতবর্ষের দুই প্রকার জলাশয় দেখা যায়। যথা- প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট।

ভারতের পরিবেশ ও বনমন্ত্রকের পেশ করা তথ্য অনুসারে ভারতের মোট প্রাকৃতিক জলাশয়ে সংখ্যা প্রায় 2,100 এবং মনুষ্যসৃষ্ট জলাশয় সংখ্যা 65,250টি।

এই জলাশয়গুলি মূলত কৃষিকাজ, মৎস্য চাষ এবং বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য রক্ষার কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কলকাতার চিংড়ি ঘাটার কাছে অবস্থিত পূর্ব কলকাতা জলাভূমির বিভিন্ন জলাশয়ের একটি অন্যতম উদাহরণ। এছাড়া হিমাচল প্রদেশের চন্দ্রতাল কেরলের অষ্টমুদি ও ত্রিপুরার রুদ্রসাগর উল্লেখযোগ্য।

মানবজীবনে জলাশয় এর গুরুত্ব

● বন্যা প্রতিকার জলাশয়গুলি যেহেতু বেশিরভাগই প্লাবন সমভূমিতে অবস্থান করে সেই ক্ষেত্রে বর্ষার অতিরিক্ত জল, বাঁধভাঙ্গা জল বা জলাধার থেকে ছাড়া জল এই জলাশয়গুলি ধরে রেখে অন্যকে প্রতিহত করতে সাহায্য করে।

● জল পরিশোধনের স্থান রূপে

জলাশয়গুলি নর্দমার নোংরা ও দূষিত জলের ট্রিটমেন্টের স্থান হিসাবে কাজ কর।বিভিন্ন রাসায়নিক শোষণ ও বিভিন্ন দূষক ও পলিকে ছেঁকে নেওয়া এবং উপকারী ব্যাকটেরিয়া জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা এর আছে।

● মানুষের জীবনধারণের প্রয়োজনীয় উপাদান ও সরবরাহ

মানুষের জীবন ধারণের উপযোগী উপকরণ জলাশয় প্রদান করে থাকে। যেমন- মৎস্য, পানিফল, বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ, ঔষধি উদ্ভিদ, মাদুর তৈরি করার কাঠি ও বাড়িতে ছাওনি দেওয়ার হোগলা পাতা ইত্যাদি।

● স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্র ও জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ

এই জলাশয়গুলি 40% প্রজাতির প্রাকৃতিক বাসস্থান রূপে কাজ করে এবং জলজ বাস্তুতন্ত্রের ক্ষেত্র হিসেবে অবস্থান করে। প্রচুর পরিযায়ী পাখির আগমন ও জলাশয়ের উপস্থিতির জন্য হয়ে থাকে।

ওড়িশার চিল্কা হ্রদে পরিযায়ী পাখিদের দল (Government of Odisha, Licensed under, CC BY 4.0)

● সেচের কাজে জলের ব্যবহার

খরার মরসুমে জলাশয় জলকে কৃষিক্ষেত্রে সেচের কাজে ব্যবহার করা হয়।

খাল

ভারতবর্ষের প্রচুর খাল বর্তমান। এর মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য খাল হল –

● উচ্চ গঙ্গা খাল

হরিদ্বারের কঙ্খালে গঙ্গা থেকে একটি খাল কাটা হয়েছে এটি উচ্চ গঙ্গা খাল নামে পরিচিত।

● সারদা খাল

উত্তরাখণ্ডে ভারত ও নেপাল সীমান্তে অবস্থিত বনবাসার কাছে সারদা নদী থেকে যে খালটি কাটা হয়েছে তাকে সারদা খাল বলা হয়।

● নিম্ন গঙ্গা খাল

উত্তরপ্রদেশের নারোরার কাছে গঙ্গা থেকে কাটা খালটি নিম্ন গঙ্গা খাল নামে পরিচিত।

এছাড়াও কিছু উল্লেখযোগ্য খাল হল আগ্রা খাল (উত্তর প্রদেশ), গুরগাঁও খাল (হরিয়ানা), কোশি খাল (বিহার), ইন্দিরা গান্ধী খাল (রাজস্থান), ভাকরা খাল (পাঞ্জাব), কুর্নুল- কুডাপ্পা খাল (অন্ধপ্রদেশ), মেদিনীপুর খাল ও দুর্গাপুর (পশ্চিমবঙ্গ) প্রভৃতি।

মানবজীবনে খালের গুরুত্ব

● জলসেচের কাজে

নিত্যবহ প্লাবন খালকে কৃষি ক্ষেত্রে জল সেচের কাজে ব্যবহার করে উত্তর ভারতের কৃষি উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়েছে।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবন বিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

● বাণিজ্য ও নৌপরিবহনে

অভ্যন্তরীণ জলপথ হিসেবে খাল ব্যবহৃত হয়। খালের মাধ্যমে বিভিন্ন কৃষিজাত, শিল্প জাতীয় পণ্য পরিবহন করা হয়। যেমন দুর্গাপুর খালের মাধ্যমে দুর্গাপুর থেকে কয়লা কয়লা ইস্পাত প্রভৃতি আনা হয়।

● মৎস্য চাষ

খালের জলে মৎস্য চাষ করে সেই মাছ ধরে অনেক মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।

● জল নিকাশি

শহর এলাকার নর্দমা ও পয়ঃ প্রণালীর জলকে খালের মাধ্যমে বড় কোন জলাশয় বা ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট এ নিয়ে যাওয়া হয়।

জলসেচের বিভিন্ন পদ্ধতি

ভূ-প্রকৃতি, বৃষ্টিপাত, মৃত্তিকা, ভৌমজলের প্রাপ্তি, নদ নদীর প্রকৃতি, শস্যের চাহিদা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন রকম জলসেচ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। জলের চাহিদা পূরণের জন্য যখন কোন মূল নদী থেকে খাল কেটে, ভৌম জল মাটির উপর উত্তোলন করে বা বৃষ্টির জল সঞ্চয় করে ব্যবহার করা হয় তখন তাকে জলসেচ বলা হয়।

ভারতে প্রধানত কূপ, নলকূপ ও খালের মাধ্যমে জলসেচ করা হয়।

কূপ ও নলকূপ

এই ক্ষেত্রে সাধারণত 5 থেকে 15 মিটার গভীরতা পর্যন্ত কুপ্র ও নলকূপ খনন করে জলসেচ করা হয়।

ভারতবর্ষে প্রথম নলকূপ খনন করা হয়েছিল 1930 সালে উত্তরপ্রদেশে।

উত্তরপ্রদেশে কূপ ও নলকূপের মাধ্যমে সবথেকে বেশি জলসেচ হয়। এছাড়া রাজস্থান, পাঞ্জাব, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রে এই পদ্ধতিতে জলসেচ হয়ে থাকে।

● এই ক্ষেত্রে ভূগর্ভে স্বল্প গভীরতায় কূপ এবং বেশি গভীরতায় নলকূপ থেকে জল তোলা হয়।

● কূপ থেকে দৈহিক পরিশ্রমের মাধ্যমে এবং নলকুপ থেকে ডিজেল বা বিদ্যুৎচালিত শক্তির সাহায্যে জল তোলা হয়।

● কূপ ভূমি ভাগের উপরে খোলা অবস্থায় অবস্থান করে এবং নলকূপ ভূমির অভ্যন্তরে অবস্থান করে।

● কূপ স্থায়ী বা অস্থায়ী প্রকৃতির হতে পারে এবং নলকূপ গভীর বা অগভীর হয়ে থাকে।

সেচ খাল

সেচ খাল সাধারনত দুই প্রকারের হয়ে থাকে। যথা-

● নিত্যবহ খাল

নিত্যবহ খালে বাঁধ এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে জল সরবরাহ হয়ে থাকে। নিত্যবহ খালে সারা বছর জল থাকে। শুষ্ক ঋতুতে এইখালে জল থাকায় কৃষিকাজে এই খালের গুরুত্ব বেশি এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণে এর গুরুত্ব কম।

● প্লাবন খাল

বর্ষাকালে বন্যার অতিরিক্ত জল নদী থেকে এই প্লাবন খাল এর মাধ্যমে নিষ্কাশন করা হয়। নদীতে জল বাড়লেই প্লাবন খালের জল বাড়ে। এই প্লাবন খাল বন্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে জল নিকাশিতে বিশেষ ভূমিকা নেয় কিন্তু কৃষিকার্যে এর গুরুত্ব কম।
তামিলনাড়ুতে প্লাবন খাল এর মাধ্যমে জলসেচ করা হয়।

ভারতের দীর্ঘতম প্লাবন খাল হল উচ্চ গঙ্গা খাল।

জলসেচের গুনাগুন

ভৌমজলের অতিরিক্ত ব্যবহারের প্রভাব

● মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি

অতিরিক্ত জল উত্তোলন করলে ভূগর্ভের ভৌম জলে লবণের পরিমাণ বেড়ে যায়। এই লবণাক্ত জল মাটির উপরে উঠে আসে এবং মাটিতে লবণের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে মাটি অনুর্বর করে তোলে।

● জলবাহী স্তরের বিনাশ

ভৌম জলের অতিরিক্ত ব্যবহার করলে মাটির নিচের জলবাহী স্তর গুলি শুকিয়ে যায়।

● ভৌম জলতলের পতন

অতিরিক্ত ভৌম জলের উত্তোলনের ফলে ভৌম জলতল অনেক নিচে নেমে। যায় ফলে শুকিয়ে যায় এবং নলকূপ গুলি থেকে জল ওঠা বন্ধ হয়ে যায়।

● ভূভাগের অবনমন

অত্যধিক জল তুললে ভূগর্ভে যে ফাঁকা স্থানে সৃষ্টি হয় সেখানে উপরের মাটি ধসে ভূমি ভাগের অবনমন সৃষ্টি করে এর ফলে শহরাঞ্চলে অনেক ঘরবাড়ি বসে যায়।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

● সামাজিক সমস্যা

ভৌম জলের অতিরিক্ত উত্তোলনে জলতলের দ্রুত পতন ঘটে ফলে পানীয় জলের সংকট শুরু হয়।

● আর্সেনিকের প্রকোপ

আর্সেনিক প্রবণ অঞ্চলে অতিরিক্ত ভৌমজল উত্তোলনের ফলে জলে আর্সেনিকের পরিমাণ বেড়ে যায় যা পানীয় জলের সাথে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন রোগব্যাধি সৃষ্টি করে।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → ভারতের বহুমুখী নদী পরিকল্পনা ও জল সংরক্ষণ


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখিকা পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রাক্তনী শ্রেয়সী বিশ্বাস। পড়াশোনা এবং লেখালিখির পাশাপাশি, ছবি আঁকা এবং বাগান পরিচর্যাতেও শ্রেয়সী সমান উৎসাহী।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –