mousumi-bayu-bharoter-ritu-boicitryo
Madhyamik

মৌসুমী বায়ু ও ভারতের ঋতু বৈচিত্র্য

ভূগোলদশম শ্রেণি – আঞ্চলিক ভূগোল (একাদশ পর্ব)

আগের পর্বে আমরা ভারতের জলবায়ু সম্পর্কে আলোচনা করেছি এই পর্বে আমরা মৌসুমী বায়ু ও ভারতের ঋতু বৈচিত্র্য সম্পর্কে জেনে নেবো।

বিখ্যাত বিজ্ঞানী এডমন্ড হ্যালি 1833 সালে সর্বপ্রথম মৌসুমী শব্দটি ব্যবহার করেন মৌসুমী শব্দটি আরবি শব্দ ‘মৌসম’ বা মালায়ালাম শব্দ ‘মনসীন’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে এই শব্দের অর্থ হল ‘ঋতু ‘।

মৌসুমী বায়ু কাকে বলে?

বায়ুর উষ্ণতা ও চাপের পার্থক্যের ফলে শীত-গ্রীষ্ম ঋতুভেদে দিক পরিবর্তনকারী নিয়মিত ও ধারাবাহিকভাবে প্রবাহিত সাময়িক বায়ুকে মৌসুমী বায়ু বলা হয়। মৌসুমী বায়ু সমুদ্র বায়ু ও স্থলবায়ুর বৃহত্তর সংস্করণ।

ভারতের জলবায়ুতে মৌসুমি বায়ুর প্রভাব দেখা যায় বলে, ভারতকে মৌসুমী বায়ুর দেশ বলা হয়।



Join JUMP Magazine Telegram


ভারতের ঋতু বৈচিত্র্য

ঋতু বলতে বোঝায় কোনো দেশ বা কোনো অঞ্চলের বছরের বিভিন্ন সময়ে (মাস ও দিনের হিসাব) আবহাওয়া পরিবর্তন জনিত বিভাগ সমূহ।

ভারতের জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ঋতুর পরিবর্তন ভারতে 4টি ঋতু স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, সেগুলি হল – গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও শীত।

এই কারণে আবহাওয়া ও জলবায়ুবিদগণ মৌসুমী বায়ুর আগমন ও প্রত্যাগমনের উপর ভিত্তি করে ভারতের জলবায়ুকে চারটি ঋতুতে ভাগ করেছেন।


jump magazine smart note book


ক. গ্রীষ্মকাল (প্রাক মৌসুমি)

সময়কাল

মার্চ থেকে মে মাস।

উষ্ণতা:

21 মার্চ এর পর থেকে সূর্য রশ্মি নিরক্ষরেখা থেকে ক্রমশ উত্তর দিকে অর্থাৎ উত্তর গোলার্ধে লম্বভাবে পড়তে থাকে। ফলে সূর্যের উত্তর গোলার্ধে অবস্থানের জন্য ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে উষ্ণতা ক্রমশ বাড়তে থাকে।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

দাক্ষিণাত্য মালভূমির দক্ষিণাংশে মার্চ মাসে হয় 38°- 40°C সেন্টিগ্রেড, রাজস্থানের মরু অঞ্চলে মে মাসে 48°-49°C ও পাঞ্জাব হরিয়ানা 48°C উষ্ণতা উঠে যায়। তবে এই সময়ে উত্তর ভারতের থেকে দক্ষিণ ভারতের উষ্ণতা কম থাকে। কারণ দক্ষিণ ভারতের সমুদ্রের প্রভাবে এই অঞ্চলের উষ্ণতা কিছুটা সমভাবাপন্ন হয়।

বায়ুচাপ ক্ষেত্র ও বায়ুপ্রবাহ

গ্রীষ্মকালে উত্তর ভারতের উষ্ণতা ক্রমশ বাড়তে থাকে ফলে উত্তর ভারতে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বায়ুর চাপ কমতে থাকে ও গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের সৃষ্টি হয়। এই সময়ে বেশ কিছু স্থানীয় বায়ুর প্রভাব এই জলবায়ুতে কার্যকরী হয়। সেগুলি হল – উত্তর-পশ্চিম ভারতের লু, আঁধি ও পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কালবৈশাখী, আসামে বরদৈছিলা ইত্যাদি।

বৃষ্টিপাত

ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়, এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের কালবৈশাখীর আবির্ভাব হয়। কালবৈশাখীর প্রভাবে হঠাৎ বৃষ্টিপাতের জন্য উষ্ণতা 10° থেকে 15° সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত নেমে যায়। কালবৈশাখীর প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গে 15 থেকে 40 সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। কেরালা ও কর্ণাটক উপকূলে নিম্নচাপ কেন্দ্র জনিত কারণে 10 থেকে 25 সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত হয়, যা আম্রবৃষ্টি (আমের ফলন বৃদ্ধিকারক) নামে পরিচিত।

কর্ণাটকের বৃষ্টির ফলে কফি চাষের সুবিধা হয়, তাই এটিকে ‘Cherry Blossom’ বৃষ্টিপাত বলা হয়। তামিলনাড়ুতে এই বৃষ্টিকে কফি বৃষ্টি বা coffee rain ও বলা হয়।

খ. বর্ষাকাল (মৌসুমী বায়ুর আগমন কাল)

সময়কাল

জুন থেকে সেপ্টেম্বর। মৌসুমী বায়ুর আগমনের ফলে ভারতে বর্ষাকালের সূত্রপাত হয়। এই জন্যই বর্ষাকালকে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আগমন কাল বলা হয়।

উষ্ণতা

উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে বর্ষাকালে গড় উষ্ণতা থাকে প্রায় 20°-30° সেলসিয়াস।

বায়ুচাপ, বায়ুর প্রবাহ ও বৃষ্টিপাত

উত্তর ভারতে নিম্নচাপ কেন্দ্র অবস্থান করায় দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে সমুদ্রের জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু ভারতে প্রবেশ করতে থাকে। এই জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু মালাবার উপকূলে পশ্চিমঘাট পর্বতের পশ্চিম ঢালে প্রথমে বাধা পেয়ে প্রবল শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত ঘটায়। একেই মৌসুমি বিস্ফোরণ বা burst of monsoon বলা হয়।

মৌসুমী বায়ু সাধারণত দুইটি ভাগে ভাগ হয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। যথা – i) আরব সাগরীয় শাখা ও ii) বঙ্গোপসাগরীয় শাখা

i. আরব সাগরীয় শাখা

এই আরব সাগরীয় শাখাটি আবার তিনটি উপশাখায় বিভক্ত হয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে।

ক) এই তিনটি শাখার মধ্যে একটি শাখা পশ্চিমঘাট পর্বতের পশ্চিম ঢালে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং 350 থেকে 500 সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত ঘটায়। কিন্তু এই বায়ু যখন পশ্চিমঘাট পর্বতের পশ্চিম ঢাল অতিক্রম করে এর পূর্ব ঢালে গিয়ে পৌঁছায় তখন সেই বায়ুতে আর জলীয় বাষ্প থাকে না, ফলে এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হয়। এর ফলে পশ্চিমঘাট পর্বতের পূর্ব ঢালে বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল সৃষ্টি হয়েছে; যেখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ থাকে 70 থেকে 75 সেন্টিমিটার।

খ) দ্বিতীয় শাখাটি প্রথমে মহারাষ্ট্রে প্রবেশ করে এবং সেখানে সামান্য বৃষ্টিপাত ঘটায় (60 থেকে 70 সেন্টিমিটার)।

গ) তৃতীয় শাখাটি আরো উত্তরে আরাবল্লী পর্বতের সমান্তরালে প্রবাহিত হয় এবং মাত্র (25 থেকে 50 সেন্টিমিটার) বৃষ্টিপাত ঘটায়।

ii. বঙ্গোপসাগরীয় শাখা

বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর দুটি উপশাখা ভারতে প্রবেশ করে।

ক) প্রথম শাখাটি মেঘালয় রাজ্যের গারো, খাসি, জয়ন্তিয়া পর্বতের দক্ষিণ ঢালে ব্যাপক শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত ঘটায়। মেঘালয় চেরাপুঞ্জিতে গড়ে 1000 সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত হয়।

মেঘালয়ের মৌসিনরাম হল পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা বেশি বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চল (1350 সেন্টিমিটার)।

উত্তর দিকে অবস্থিত শিলং বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলের মধ্যে পড়ায় এইখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই কম মাত্র 200 সেন্টিমিটার।

খ) দ্বিতীয় শাখাটি উত্তর পূর্ব হিমালয় পর্বতে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং হিমালয়ের সমান্তরালে ক্রমশ পশ্চিম দিকে বৃষ্টিপাত ঘটাতে ঘটাতে অগ্রসর হয়। এই কারণে ভারতের পশ্চিম দিকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ক্রমশ কমতে থাকে। রাজস্থানের পৌঁছানোর আগেই এই বায়ুতে অবস্থিত জলীয়বাষ্প প্রায় শেষ হয়ে যায়, ফলে এই অঞ্চলে আর বৃষ্টিপাত হয় না।


মৌসুমী বায়ু ও ভারতের ঋতু বৈচিত্র্য বুঝে নাও এই ভিডিও ক্লাস থেকে↓

গ. শরৎকাল (মৌসুমী বায়ুর প্রত্যাবর্তন কাল)

সময়কাল

অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর। মোটামুটি সেপ্টেম্বরের শেষ এবং অক্টোবরে শুরু থেকেই মৌসুমী বায়ুর প্রত্যাবর্তন শুরু হয়। এই সময়কে শরৎকাল তথা মৌসুমী বায়ুর প্রত্যাবর্তন কাল হিসাবে অভিহিত করা হয়।

উষ্ণতা

মৌসুমী বায়ুর প্রত্যাবর্তনের ফলে আকাশ পরিষ্কার থাকে এবং বৃষ্টির সম্ভাবনা হ্রাস পায়। অক্টোবর মাসের শুরু থেকে উষ্ণতা ক্রমশ কমতে থাকে। দিনের উষ্ণতার থেকে রাতের উষ্ণতা কম থাকায় এই সময়ে আবহাওয়া আরামদায়ক হয়।

বায়ুচাপ ও বায়ুপ্রবাহ

এই সময় সূর্যের দক্ষিণায়ন শুরু হয়, ফলে সূর্য দক্ষিণ গোলার্ধের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সূর্যের দক্ষিণায়নের ফলে দক্ষিণ গোলার্ধে উষ্ণতা ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং উত্তর গোলার্ধে উষ্ণতা কমতে থাকে। উত্তর গোলার্ধে বায়ুর উচ্চচাপ এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বায়ুর নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়।এই ঘটনার ফলে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে প্রত্যাবর্তন করতে শুরু করে।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

তামিলনাড়ু উপকূলে বছরে দুবার বৃষ্টিপাত হয় কেন?

এই সময় উত্তর ভারতে বৃষ্টিপাত হয় না, তবে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রত্যাবর্তনের সময় বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার ফলে প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করে এবং করমন্ডল উপকূলে পৌঁছে পূর্বঘাট পর্বতের করমন্ডল উপকূলে বৃষ্টিপাত ঘটায়। এই কারণে তামিলনাড়ু উপকূলে বছরে দুবার বৃষ্টিপাত হয়। বঙ্গোপসাগরের উপকূল অঞ্চলে এই সময় ঝড়-ঝঞ্ঝা ও ঘূর্ণবাতের সৃষ্টি হয়। একে আশ্বিনের ঝড় বলা হয়।


jump magazine smart note book


ঘ. শীতকাল

সময়কাল

জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি।

উষ্ণতা

শীতকালে সূর্য মকরক্রান্তি রেখার উপর অবস্থান করায় উত্তর গোলার্ধে শীতকাল ও দক্ষিণ গোলার্ধে গ্রীষ্মকালের শুরু হয়। এই সময় ভারতবর্ষের উষ্ণতা আস্তে আস্তে কমতে থাকে।


বায়ুর চাপ ও বায়ু প্রবাহ

এই সময়ের মধ্য এশিয়ার উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে আগত মৌসুমী বায়ু উত্তর-পূর্ব দিক থেকে ভারতে প্রবেশ করে। একে উত্তর পূর্ব মৌসুমি বায়ু বলা হয়। কিন্তু বরফ ঢাকা স্থলভাগের উপর দিয়ে আসার ফলে এই বায়ু শুষ্ক ও শীতল হয়। ভারতের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় এই বায়ু তাপমাত্রা কমিয়ে দেয়।

বৃষ্টিপাত

উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ু শুষ্ক হওয়ার কারণে এই সময়ে ভারতে বৃষ্টিপাত হয় না। তবে বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে বয়ে আসা উত্তর-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে করমন্ডল উপকূলে বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। শীতকালে পশ্চিমের ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে আসা পশ্চিমীঝঞ্ঝার জন্য উত্তর পশ্চিম ভারতে বৃষ্টিপাত হয় এবং হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে তুষারপাত হয়ে থাকে।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → ভারতের মৃত্তিকা


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X-geo-5-a-11