nodir-kaj-3
Madhyamik

নদীর মধ্য ও নিম্ন গতিতে সৃষ্ট ভূমিরূপ

দশম শ্রেণি | বিষয়: ভূগোল । অধ্যায়:বহির্জাত প্রক্রিয়া ও সৃষ্ট ভূমিরূপ (পর্ব – ৩)

আগের পর্বে আমরা উচ্চ গতিতে সৃষ্ট নদীর বিভিন্ন ভূমিরূপ সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এই পর্বে আমরা মধ্য এবং নিম্ন গতিতে নদী দ্বারা সৃষ্ট বিভিন্ন ভূমিরূপ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

পার্বত্য প্রবাহ থেকে অপেক্ষাকৃত সমতল ভূমিতে আসার ফলে হঠাৎ ভূমি ঢালের পরিবর্তন ও নদীর ‘বোঝা’ বৃদ্ধি হওয়ায় মধ্য ও নিম্নগতিতে নদীর ক্ষয় কাজ অপেক্ষা সঞ্চয় কাজের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। সেই জন্য মধ্য ও নিম্ন গতিতে নদীতে সঞ্চয়জাত ভূমিরূপ গঠনের প্রবণতা দেখা যায়।

মধ্য ও নিম্ন গতিতে সৃষ্ট ভূমিরূপগুলি নিচে আলোচনা করা হল।

পলল শঙ্কু ও পলল ব্যজনী

উচ্চ গতি বা পার্বত্য প্রবাহের শেষে এবং মধ্যগতির শুরুতে হঠাৎ ভূমি ঢাল হ্রাস পায়। এর ফলে পার্বত্য অঞ্চল থেকে বয়ে আনা নুড়ি, পাথর ও পলিরাশি সমভূমির শুরুতে পর্বতের পাদদেশে সঞ্চিত হয়ে যে ত্রিকোণাকৃতি ভূমিরূপের সৃষ্টি করে তাকেই পলল শঙ্কু বলা হয়। আবার, অনেকগুলো পলল শঙ্কু একসাথে মিশে যে হাত পাখার মতো যে ভূমিরূপ তৈরি করে, তাকেই পলল ব্যজনি বলে।

উদাহরণ – পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে এরকম অনেক পলল ব্যজনি দেখা যায়।

হঠাৎ ভূমি ঢালের পরিবর্তন এবং নদীর বহন ক্ষমতার হ্রাসই হল এই প্রকার ভূমিরূপ সৃষ্টির কারণ।

নদী বাঁক বা মিয়েন্ডার

মধ্য গতি ও নিম্নগতিতে ভূমি ঢাল হঠাৎ হ্রাস পেলে নদীর গতিবেগ হ্রাস পায়। এর ফলে নদী নিজের গতিপথের মধ্যে কোনো কারণে বাধা পেলে, সেই বাধা এড়ানোর জন্য বাধাগুলি এড়িয়ে এঁকে বেঁকে প্রবাহিত হয়। নদীর এই আঁকা বাঁকা অংশ গুলোকেই নদী বাঁক বা মিয়েন্ডার বলা হয়। তুরস্কের মিয়েন্ডারেস নদীর নাম অনুসারে মিয়েন্ডার কথাটির উৎপত্তি হয়েছে।

নদী বাঁকের বাইরের ঢালে জল বেশি জোরে আঘাত করে ফলে বাইরের দিকের ঢালের ক্ষয়ের পরিমাণ বেশি হয়। ফলে এই দিকে নদীর পাড় খুব খাড়া হয়, যাকে খাড়া পাড় বলা হয়। নদীর ভিতরের দিকের পাড়ে স্রোতের পরিমাণ কম থাকে ফলে ক্ষয় কম হয় এবং এই অংশে ক্রমে ক্রমে পলি সঞ্চিত হয়ে মৃদু ঢাল বিশিষ্ট পাড় গঠিত হয়, যাকে slip of slope ও বলে। নদীর দ্বারা এই সঞ্চয়কে বিন্দুবার বলা হয়।

উদাহরণ – গঙ্গা নদীতে অগ্রদীপের কাছে এরকম বহু নদী বাঁক দেখা যায়।

কর্তিত নদী বাঁক

হঠাৎ ভূভাগের পুনর্যৌবনের ফলে নদীর ক্ষয় কার্যের শক্তি বৃদ্ধি পায়, ফলে নদী তার খাত আরো বেশি ক্ষয় করতে থাকে ও নদী খাত আরো গভীর হয়ে ওঠে ও দুপাশে খাড়া ঢাল তৈরি করে। এই ভূমিরূপকে কর্তিত নদী বাঁক বলা হয়।

অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ এবং মিয়েন্ডার
অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ এবং মিয়েন্ডার

অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ

সমভূমির উপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার সময় মাঝে মাঝে নিজের বক্র গতিপথ পরিবর্তন করে সোজা পথে প্রবাহিত হয়। এর ফলে নদীর বক্র গতিপথের মুখটি আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায় এবং ওই অংশটা মূল প্রবাহমান নদী থেকে আলাদা হয়ে অবস্থান করে। এই অংশটি দেখতে অনেকটা ঘোড়ার ক্ষুরের মত হওয়ায় একে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ বলা হয়। মূল নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াতে এই হ্রদ নদীর জলের যোগান থেকেও সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

উদাহরণ – ভাগীরথী হুগলী নদীর প্লাবনভূমিতে কাটোয়া ও কালনার মাঝে এরকম অনেক অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ দেখা যায়।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

এই অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের সৃষ্টির পিছনে কিছু কারণ বা শর্ত বর্তমান।

  • নদীর বাইরের দিকের ঢাল অর্থাৎ অবতল অংশটি ক্রমাগত ক্ষয় এবং নদীর ভিতরের দিকের ঢালের অত্যাধিক সঞ্চয়ের ফলে নদীর বাঁক অত্যন্ত বক্র হয়ে যায়। ফলে নদী বেকে প্রবাহিত হয়।
  • নদীর এই রকম দুটো বাঁক খুব কাছাকাছি চলে আসলে বাঁক দুটির মধ্যবর্তী সরু ভূমিতে ক্ষয় প্রাপ্ত হলে বাঁক দুটি পরস্পরের সাথে মিশে যায়। ফলে নদী ওই বক্র পথ আর অনুসরণ না করলে সোজা পথে বইতে শুরু করে।
  • কালক্রমে পরিত্যক্ত বক্র অংশটির দুই মুখে বালি কাদা ও পলি সঞ্চয় হয়ে মূল নদী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে অর্ধচন্দ্র আকৃতি বিশিষ্ট একটি হ্রদের সৃষ্টি করে, যা অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ নামে পরিচিতি লাভ করে।

প্লাবনভূমি

নদীর নিম্নগতিতে অবস্থিত নদীর দ্বারা প্লাবিত উপত্যকার শেষ সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত সমভূমিকে প্লাবন ভূমি বলা হয়। প্লাবনভূমি নদীর দুই পাড় থেকে শুরু হয়ে বন্যার জল যতটুকু অঞ্চল প্লাবিত করে সেই সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। 

উদাহরণ – ভারতে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, সিন্ধু এরকম বহু নদীর নিম্নগতিতে বিস্তীর্ণ প্লাবনভূমি দেখা যায়।

স্বাভাবিক বাঁধ ও প্লাবনভূমি

প্লাবনভূমি সৃষ্টির কতগুলো কারণ বর্তমান।

আমরা জানি নদীর মধ্য ও নিম্ন প্রবাহে ভূমি ঢাল কম হওয়ায় নদীতে জলস্রোত কমে যায়। বন্যার সময় নদী প্রচুর পরিমাণ পলি ও জল বহন করে, কিন্তু যথাযথ গভীরতা না থাকার ফলে নদীর পক্ষে সেই অতিরিক্ত জল ও পলি বহন করা সম্ভব হয়না। তাই অতিরিক্ত পলি মিশ্রিত জল নদীর দুকূল ছাপিয়ে উপত্যকাকে প্লাবিত করে। সেই পলি মিশ্রিত জল আস্তে আস্তে থিতিয়ে পড়ে পলির আস্তরণ তৈরি করে। এভাবে বছরের পর বছর পলির স্তর জমে প্লাবনভূমি গঠিত হয়। 

মিসৌরি নদীর দুইপাশে স্বাভাবিক বাঁধ

স্বাভাবিক বাঁধ

ক্রমাগত নদীর দুই কূল প্লাবিত হওয়ার ফলে নদীর দুই তীরে পলি সঞ্চয় হওয়ার ফলে উচুঁ বাঁধের মতো ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, একেই স্বাভাবিক বাঁধ বা লিভি বলা হয়। প্লাবন ভূমির মত স্বাভাবিক বাঁধ ও একই প্রক্রিয়ায় উৎপত্তি হয়।

বর্ষাকালে বন্যার মাধ্যমে প্রচুর জল ও পলি নদীতে এসে মেশে। কিন্তু নদীর বহন ক্ষমতা কম থাকায় নদী সেই অতিরিক্ত জল ও পলি বহন করে নিয়ে যেতে পারে না। এই অবস্থায় নদীর জল নদীর দুকুল ছাপিয়ে উপত্যকা প্লাবিত করে। কিন্তু নদীর জলে মিশ্রিত বড় দানার পলি বেশি দূর পরিবাহিত হতে পারে না এবং নদীর পাড়ের কাছেই তাড়াতাড়ি থিতিয়ে পড়ে। এভাবে সময়ের সাথে সাথে বার বার প্লাবনের ফলে নদীর দুই পাড়ে পলি জমে উচুঁ হয়ে নদীর পাড় বরাবর বাঁধের মত দেখতে ভূমিরূপ তৈরি হয় যাকে স্বাভাবিক বাঁধ বলা হয়। 

উদাহরণ – ভাগীরথী হুগলী নদীর নিম্নগতিতে এরকম অনেক স্বাভাবিক বাঁধ দেখা যায়।

নদীর কাজের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ নিয়ে আলোচনা শুনুন। ↓

খাঁড়ি বা প্রশস্ত মোহনা

নদী যেখানে সমুদ্রে পতিত হয় সেই অঞ্চলে নদীখাতের আকৃতি ফানেলের মত চওড়া হয়ে থাকে। খাঁড়ির নদীর দিকের অংশটি সরু ও সমুদ্রের দিকের মুখটি চওড়া ফানেলের মত দেখতে হয়। এই সব খাঁড়ির মাধ্যমে সমুদ্রের জোয়ারের নোনাজল নদীতে প্রবেশ করে।

উদাহরণ – সুন্দরবনে এরকম অনেক খাঁড়ি দেখতে পাওয়া যায়। তার মধ্যে দূর্গাদুয়ানি খাঁড়ি উল্লেখ্যযোগ্য।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবন বিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

ব-দ্বীপ

নদী তার গতিপথের শেষ সীমায় প্রচুর শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে সাগরে মিলিত হয়। এই শাখা প্রশাখার মধ্যবর্তী অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে পলি সঞ্চয়ের ফলে বাংলায় মাত্রাহীন ‘ব ‘এর মত বা গ্রীক অক্ষর ∆ (ডেল্টা) এর মত যে ভূভাগ সৃষ্টি হয়, তা ব-দ্বীপ নামে পরিচিত।

উদাহরণ – ভাগীরথী গঙ্গা নদীর মোহনায় এরকম অনেক ব-দ্বীপ দেখতে পাওয়া যায়। পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপটি হল গঙ্গা ব্রহ্মপুত্র ব-দ্বীপ।

types of delta in Bengali

কোনো নদীর ব-দ্বীপ অঞ্চল বিভিন্ন আকৃতির হয়। তবে অধিকাংশ ব-দ্বীপ ত্রিকোণ আকৃতির হয়। আকৃতি অনুযায়ী ব-দ্বীপকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন –

পাখির পায়ের মতো ব-দ্বীপ : মিসিসিপি মিসৌরি নদীর ব-দ্বীপ, কৃষ্ণা নদীর ব-দ্বীপ।

ধনুকাকৃতি ব-দ্বীপ : নীল নদের ব-দ্বীপ, গঙ্গা ব্রহ্মপুত্র নদীর ব-দ্বীপ।

তীক্ষ্ণ অগ্র বিশিষ্ট ব-দ্বীপ বা করাতের দাঁতের মত আকৃতির ব-দ্বীপ : সুবর্ণরেখা নদীর ব-দ্বীপ, টাইবার নদীর ব-দ্বীপ।

আরো পড়ুন – সুন্দরবন অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব।

তৃতীয় পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → হিমবাহের ধারণা


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X-Geo-1C