siraj-class-10-2
Madhyamik

সিরাজদ্দৌল্লা – দ্বিতীয় পর্ব

বাংলা দশম শ্রেনি – সিরাজদ্দৌল্লা (নাটাংশ্য) – দ্বিতীয় পর্ব

দশম শ্রেণির পাঠ্য ‘সিরাজদ্দৌল্লা নাটাংশ্যটি তিনটি পর্বে আলোচিত হবে। এই লেখাটি দ্বিতীয় পর্ব। এই পর্বে উক্ত নাটাংশ্যটির মঁসিয়ে লা-র প্রস্থান থেকে সভাসদদের প্রস্থান অবধি আলোচিত হয়েছে।

এই লেখার প্রথম পর্ব পড়া না থাকলে, এই লিঙ্কে ক্লিক করে পড়ুন।

প্রধান চরিত্রগুলির পরিচয়

মীরজাফর

নবাব সিরাজদ্দৌল্লার সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি (সিপাহসলার) ছিলেন মীরজাফর। তার সম্পূর্ণ নাম ছিল সৈয়দ মীর জাফর আলী খান অনুমান করা হয় যে তিনি সিরাজের আত্মীয় ছিলেন যদিও এই নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। মীরজাফর, নবাব সিরাজদ্দৌল্লাকে সিংহাসনচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন।

Mir_Jafar_and_his_son_Miran_delivering_the_Treaty_of_1757_to_William_Watts
শিল্পীর কল্পনায় ব্রিটিশ প্রতিনিধি ওয়াটস এর সাথে ষড়যন্ত্রী মীরজাফর ও তাঁর পুত্র মীরন

তিনি পলাশীর যুদ্ধের আগেই ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়ে ছিলেন, যদিও নবাব মীরজাফরের এই পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না, নবাব তাঁকে বিশ্বাস করেছিলেন। এরফল স্বরূপ নবাবের জীবনে মৃত্যুর করালগ্রাস নেমে আসে।পলাশীর যুদ্ধে মীরজাফরের অধীনস্থ সেনাবাহিনী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে এবং মীরজাফরের সিরাজকে দেওয়া ভুল পরামর্শের জন্য সিরাজের পরাজয় ঘটে। সিরাজের মৃত্যুর পরে বাংলার নবাব হন মীরজাফর, যদিও তিনি ছিলেন ইংরেজদের হাতের পুতুল।

মোহনলাল

নবাব সিরাজদ্দৌল্লার একজন বিশ্বস্ত সেনাপতি ছিলেন মোহনলাল। তিনি সিরাজের ভাই শওকত জঙ্গের সাথে যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ফলস্বরূপ সিরাজ, মোহনলালকে পূর্ণিয়ার শাসনভার অর্পণ করেন। পলাশীর যুদ্ধে যে দুজন সিরাজের পক্ষে যুদ্ধ লড়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে মোহনলাল ছিলেন অন্যতম।

মীরমদন

নবাব সিরাজদ্দৌল্লার একজন গোলন্দাজ বাহিনির সেনাপতি ছিলেন মীরমদন। তিনি সিরাজের অনুগত ছিলেন এবং আমৃত্যু সিরাজের হয়ে যুদ্ধ লড়েছিলেন। পলাশীর যুদ্ধের প্রথম পর্বে মূলত মীরমদনের গোলন্দাজ বাহিনীর দাপটে ইংরেজরা পিছু হটতে থাকে কিন্তু কিছু পরে বৃষ্টির কারণে সিরাজের গোলন্দাজ বাহিনীর বারুদ ভিজে গেলে যুদ্ধের রাশ ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়। কামানের গোলায় মীরমদনের মৃত্যু হয়।

রায়দুর্ল্লভ

নবাব সিরাজ সিরাজদ্দৌল্লার বাহিনির আর এক সেনাপতি ছিলেন রায়দুর্লভ। এই অভিজ্ঞ সেনানী, যুদ্ধে সিরাজের বিপক্ষে যান এবং মীরজাফরের ষড়যন্ত্রে যোগ দেন। রায়দুর্ল্লভ উড়িষ্যার শাসনকর্তা ছিলেন।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবন বিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

রাজবল্লভ

ঢাকার রাজা (এখানে রাজা অর্থে উপাধি, শাসক রাজা নয়) ছিলেন রাজবল্লভ। বিত্তশালী এই মানুষটি সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অন্যতম অংশীদার। রাজবল্লভ ইংরেজদের সাথে যোগাযোগ রেখে চলতেন। শুধু তাই নয়, ঘসেটি বেগমের অন্যতম প্রিয়পাত্র ছিলেন এই রাজবল্লভ। শোনা যায় যে রাজবল্লভ সিরাজের বহু অর্থ আত্মসাৎ করেছিলেন।

জগৎশেঠ

বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যাক্তি ছিলেন ‘জগৎশেঠ’ মহাতাব চাঁদ বা স্বরূপ চাঁদ। প্রসঙ্গত, জগৎশেঠ একটি উপাধী মাত্র। বিপুল সম্পত্তির অধিকারী এই মানুষটি কার্যত মুর্শিদাবাদের ট্যাঁকশাল নিয়ন্ত্রন করতেন। শোনা যায় যে শুধু বাংলার নবাব নয়, দিল্লীর বাদশার রাজ্যপাঠেও ভূমিকা নিতেন এই জগৎশেঠ। সিরাজের অপমানের শিকার হয়ে, জগৎশেঠ ষড়যন্ত্রে যোগ দেন।

গোলাম হোসেন

সিরাজের বিশ্বস্ত কর্মচারী ও পার্শ্বসহচর ছিলেন গোলাম হোসেন। যুদ্ধে পরাজয়ের পরে, সিরাজ, সিরাজের স্ত্রী ও শিশুকন্যার সাথে গোলাম হোসেনও পলায়ন করেন।

সিরাজদ্দৌল্লা নাট্যাংশের দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা শুনুন। ↓

বিষয় সংক্ষেপ

[এই পর্বে মঁসিয়ে লা-র প্রস্থান থেকে সৈন্যাধ্যক্ষগন এবং সভাসদদের প্রস্থান অবধি আলোচনা করা হয়েছে]

প্রথম পর্বে আমরা দেখেছি যে নবাব সিরাজ ব্রিটিশদের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ব্রিটিশ প্রতিনিধি ওয়াটসকে সভা থেকে বহিষ্কার করেন। আমরা আগের আলোচনায় এটাও জেনেছি যে সিরাজের পরিবার এবং তাঁর প্রধান অমাত্যরা সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করার লক্ষ্যে সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন এবং গোপনে ইংরেজদের সাথে আঁতাতে লিপ্ত হন।

তাই নবাব যখন ওয়াটসকে সভা থেকে বহিষ্কার করলেন তখন ষড়যন্ত্রী অমাত্যরা স্বভাবতই তাঁর বিরোধিতা করেন। রাজা রাজবল্লভ নবাবকে সরাসরি ওয়াটসকে বহিষ্কারের বিরোধিতা করেন। নবাব অমাত্যদের বিরোধিতাকে প্রাধান্য না দিয়ে  তাঁদের নিজেদের কথা ভাবার জন্য অনুরোধ করেন। জগৎশেঠ জানান যে সময় থাকতে সিরাজ তাঁদের প্রাধান্য দেন নি, তাঁদের অপমান করেছেন আজ যখন সিরাজ নিজে বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন তখন তারা সিরাজকে কেন সাহায্য করবেন।

এর উত্তরে ব্যথিত সিরাজ সকলকে জানান যে তিনি অপরাধ করেছেন এবং তা স্বীকারও করেছেন। কিন্তু একই বিষয় নিয়ে তাঁকে কতবার হেয় হতে হবে?


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

সিরাজের কথাতেও অমাত্যদের রাগ কমে না, রাজবল্লভ সিরাজকে বলেন যে ‘পাপ কখনও চাপা থাকে না’ এর উত্তরে সিরাজ হোসেনকুলির প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন।

প্রসঙ্গত, হোসেন কুলি খাঁ ছিলেন সিরাজের মাসি ঘসেটি বেগমের স্বামী নওয়াজিশ মুহাম্মদ-এর সভার একজন কর্মকর্তা। হোসেন কুলি খাঁ নওয়াজিশ মুহাম্মদ-এর হয়ে ঢাকা পরিচালনা করতেন। এই সময়ে হোসেন কুলি খাঁ-এর সাথে সিরাজের মা আমিনা বেগম ও মাসি ঘসেটি বেগমের গুপ্ত প্রণয়ের কথা প্রকাশ পেলে, সিরাজ হোসেন কুলি খাঁ-কে হত্যা করেন।

jump magazine plus

অমাত্যদের অপমানের প্রসঙ্গ তুলে মীরজাফর নবাবের পক্ষ ত্যাগ করার কথা ঘোষণা করলে অপর দুই সেনাপতি মীরমদন ও মোহনলাল নবাবের পক্ষ নেন। সভা মধ্যে বিবাদ চরমে পৌঁছালে সভ্যরা সভা ত্যাগ করতে উদ্যত হয়। এই অবস্থায় সিরাজ তাদের সভা ত্যাগ করতে মানা করেন এবং ওয়াটস দ্বারা মীরজাফরকে প্রেরিত একটি চিঠি সবাইকে দেখান।

তিনি এই ঘটনার দ্বারা সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে সিরাজের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র রচনা করা হচ্ছে তা তিনি জানেন। নবাবের বিরুদ্ধাচরণ করা স্বত্ত্বেও নিজের স্বার্থত্যাগ করে, বাংলার স্বার্থে তিনি সভাসদদের বলেন –

“আজ বিচারের দিন নয়, সৌহার্দ্য স্থাপনের দিন। অন্যায় আমিও করেছি, আপনারাও করেছেন, খোদাতালার কাছে কে বেশি অপরাধী তা তিনি বিচার করবেন। আজ আপনাদের কাছে এই ভিক্ষা যে, আমাকে শুধু এই আশ্বাস দিন যে, বাংলার দুর্দিনে আমাকে ত্যাগ করবেন না”।

কিন্তু সভাসদরা বাংলার এই দুর্দিনের জন্য নবাবকেই দায়ী করেন, তারা বলেন যে নবাব কলিকাতা আক্রমণ না করলে ইংরেজরা প্রত্যাঘাত করতো না। তাঁরা বার বার নবাবকে বোঝাতে থাকেন যে নবাবের উচিৎ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে চুক্তি করে নেওয়া। নবাব সভাসদদের সাথে একমত না হয়ে বলেন

“আপনারা ওয়াটস এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেও কি আপনারা তাদের মনোভাব বুঝতে পারেননি?”

নবাব ইংরেজদের সর্বগ্রাসী মনোভাবের কথা সভায় তুলে ধরেন। তিনি সবাইকে বলেন যে ইংরেজরা শান্তির পথের পথিক নয়। তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে বাংলার এই যুদ্ধে সবাইকে সম্মিলিতভাবে লড়াই করার কথা বলেন, এমনকি তিনি এটাও বলেন যুদ্ধের যে পরে যদি মন্ত্রি – অমাত্যরা চায়, সেক্ষেত্রে তিনি নবাবের পদ থেকে ইস্তফা দিতেও প্রস্তুত আছেন।

যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি অর্থাৎ সিপাহসালারের ভূমিকা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে নবাব, মীরজাফরকে বলেন এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে বলেন। নবাব বলেন হয়তো মীরজাফর সাময়িক লোভের বশে কিছু ভুল হঠকারি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কিন্তু এই সময়ে মীরজাফরের উচিৎ কর্তব্যের আহ্বানে লোভ, মোহ জয় করে, মেরুদন্ড সোজা করে বাংলার পাশে দাঁড়ানো।

সিরাজ তাঁর হিন্দু অমাত্যদের বলেছেন যে এই সংকটের সময়ে তারা যেন ধর্মীয় কারণ দেখিয়ে পিছনে না থাকেন, তারা যেন এই সময়ে তাদের সর্বশক্তি নিয়ে নবাবকে সাহায্য করার কাজে অংশগ্রহণ করেন।

নবাবের এই কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মীরজাফর ও অন্যান্য সেনাপতিরা যুদ্ধে সিরাজকে সর্বক্ষেত্রে সাহায্যের অঙ্গীকার করেন।

নবাব এই অঙ্গীকারে প্রসন্ন হয়ে ওঠেন। নবাবের উপদেষ্টা গোলাম হোসেন নবাবকে পলাশির কথা মনে করিয়ে দেন। সেই প্রসঙ্গে নবাব তার প্রধান সেনাপতি মীরজাফরকে বলেন যে ব্রিটিশ সেনাপতি লর্ড ক্লাইভ তাঁর সৈন্য নিয়ে পলাশির দিকে এগিয়ে আসছেন, তাই প্রধান সেনাপতি যেন তার অন্যান্য সেনাপতি ও সৈন্যবাহিনী নিয়ে পলাশিতে জমায়েত হন। এই বলে নবাব সভাসদদের পলাশির উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে বলেন।


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → সিরাজদ্দৌল্লা তৃতীয় পর্ব


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –