ভূগোল – দশম শ্রেণি – বারিমণ্ডল (প্রথম পর্ব)
সমুদ্রস্রোতের ধারণা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা দেখে নাও এই ভিডিও থেকে↓
আজকের পর্বে উষ্ণতা ও বৃষ্টিপাত লেখচিত্রের সাহায্যে জলবায়ু ও গোলার্ধ শনাক্তকরণ আমরা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
প্রাচীনকালে সমুদ্র পথে যাতায়াতের ক্ষেত্রে পালতোলা জাহাজ ছিল একমাত্র ভরসা। পালতোলা জাহাজগুলি বায়ুপ্রবাহ এবং সমুদ্রস্রোতের প্রবাহ পথ বরাবর বিশ্বে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেত। সমুদ্রের জলের এই প্রকার অনুভূমিক চলন বা স্থানান্তরকে সমুদ্রস্রোত বলা হয়।
সমুদ্রস্রোতের সংজ্ঞা
সমুদ্র জলের বিভিন্ন ভৌত ধর্ম অর্থাৎ উষ্ণতা, ঘনত্ব এবং লবনতার এবং পৃথিবীর গতি, বায়ুপ্রবাহ, মহাদেশের আকৃতি প্রভৃতি কারণে সমুদ্রের জলরাশির আনুভূমিক চলন ঘটে অর্থাৎ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তর হয়। সমুদ্র জলের এই ভাবে প্রবাহকে সমুদ্রস্রোত বলা হয়।
সমুদ্রস্রোতের বৈশিষ্ট্য
• সমুদ্রস্রোত নিয়মিত, সুনির্দিষ্ট এবং ধারাবাহিক।
• সমুদ্রস্রোত উষ্ণ এবং শীতল দুই প্রকৃতির হতে পারে।
• বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমুদ্র স্রোত নিয়ত বায়ু প্রবাহের উপর নির্ভরশীল।
• সমুদ্রস্রোত উপকূল অঞ্চলের জলবায়ুর নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে এবং মানব জীবনের কর্মধারায় প্রভাব ফেলে।
সমুদ্র স্রোতের প্রকারভেদ
সমুদ্র স্রোতকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
• উষ্ণ সমুদ্র স্রোত এবং
• শীতল সমুদ্র স্রোত
উষ্ণ সমুদ্র স্রোত
উষ্ণ সমুদ্র স্রোত উষ্ণ মন্ডল থেকে উৎপন্ন হয়। এই সমুদ্র স্রোত উষ্ণ এবং হালকা জলস্রোত হিসেবে সমুদ্র পৃষ্ঠের উপরের অংশ দিয়ে মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়। এই উষ্ণ স্রোত গুলি সমুদ্রপৃষ্ঠের উপরের অংশ প্রায় 100 থেকে 200 মিটার গভীরতার মধ্যে এবং স্থান বিশেষে 1000 মিটার গভীরতায় প্রবাহিত হয় বলে একে বহি:স্রোত বা পৃষ্ঠ স্রোত বলা হয়।
কয়েকটি প্রধান উষ্ণ স্রোতের নাম হল উপসাগরীয় স্রোত, ব্রাজিল স্রোত, জাপান স্রোত, মোজাম্বিক স্রোত, আগুলহাস স্রোত, মৌসুমী স্রোত ইত্যাদি।
শীতল সমুদ্র স্রোত
উষ্ণ মন্ডলের জলরাশি যখন পৃষ্ঠ স্রোত হিসেবে মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয় তখন উষ্ণমন্ডল এ সেই জলের অভাব পূরণ করার জন্য মেরু অঞ্চল থেকে শীতল স্রোত সমুদ্রের নিচের অংশ দিয়ে উষ্ণমন্ডল এর দিকে প্রবাহিত হয় একে শীতল স্রোত বা অন্ত স্রোত বলা হয়।
কয়েকটি প্রধান শীতল স্রোত হল ল্যাব্রাডর স্রোত, বেঙ্গুয়েলা স্রোত, ক্যানারি স্রোত, পেরু স্রোত বা হামবোল্ড স্রোত, ক্যালিফোর্নিয়া স্রোত, পশ্চিম অস্ট্রেলীয় স্রোত এবং কুমেরু স্রোত।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবন বিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির কারণ
ক। পৃথিবীর আবর্তন গতি: পৃথিবীর আবর্তন গতির জন্য সৃষ্টি হয় কোরিওলিস বলের। যায় প্রভাবে সমুদ্র স্রোতের দিক বিক্ষেপ ঘটে থাকে।
ফেরেলের সূত্র অনুযায়ী কোরিওলিস বলের প্রভাবে সমুদ্রস্রোত উত্তর গোলার্ধে ডান দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বাম দিকে বেঁকে যায়।
খ। বায়ু প্রবাহ: আমরা জানি নিয়ত বায়ুপ্রবাহ অর্থাৎ আয়ন বায়ু, মেরু বায়ু ও পশ্চিমা বায়ু একটি নির্দিষ্ট বেগে নির্দিষ্ট দিকে সারা বছর ধরে প্রবাহিত হয়। এই নিয়ত বায়ুপ্রবাহ গুলি যখন সমুদ্র পৃষ্ঠের উপর থেকে প্রবাহিত হয় তখন সমুদ্রের জলরাশিকে তাদের নিজের গতিপথের দিকে চালিত করে এরফলে সৃষ্টি হয় সমুদ্র স্রোতের।
গ। সমুদ্র জলের উষ্ণতার তারতম্য: নিরক্ষীয় অঞ্চলে উষ্ণতা বেশি হওয়ার কারণে এই অঞ্চলের সমুদ্রের জল উষ্ণ এবং হালকা হয়ে পৃষ্ঠ স্রোত রূপে শীতল মেরু প্রদেশের দিকে প্রবাহিত হয়। আবার শীতল মেরু অঞ্চল থেকে শীতল ও ভারী সমুদ্র স্রোত অন্ত:স্রোত রূপে নিরক্ষীয় অঞ্চলের দিকে জলের ঘাটতি পূরণের উদ্দেশ্যে প্রবাহিত হয়।
ঘ। সমুদ্র জলের লবনতা ও ঘনত্বের তারতম্য: সমুদ্র জলের লবনতা পরিমাণ সর্বত্র সমান হয় না। এই লবনতা তারতম্যের জন্য সমুদ্র জলের ঘনত্বের তারতম্যের সৃষ্টি হয় যার ফলে সমুদ্র স্রোতের সৃষ্টি হয়। কম লবনতা অর্থাৎ কম ঘনত্ব যুক্ত হালকা জল পৃষ্ঠ স্রোত হিসেবে অধিক লবণাক্ত জলের দিকে প্রবাহিত হয় ফলে সেখানে জলের শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এই জলশূন্যতা পূরণের জন্য আবার অধিক লবণাক্ত ও অধিক ঘনত্ব যুক্ত ভারী জল অন্ত:স্রোত রূপে প্রবাহিত হয়।
ঙ। বরফের গলন: পৃথিবীর মেরু সংলগ্ন অঞ্চলে বরফের গলনের ফলে বিশাল পরিমাণে জল সমুদ্র জলরাশিতে অন্তর্ভুক্ত হয়। নোনা জলের সাথে স্বাদু জলের এই সংযোজনের ফলে সমুদ্রের জলের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং লবণের পরিমাণ হ্রাস পায়। এই লবনতা তারতম্যের জন্য সমুদ্রস্রোত সৃষ্টি হয়। যেমন- আটলান্টিকের পূর্ব গ্রিনল্যান্ড স্রোত।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
চ। উপকূলের আকৃতি: অনেক সময় উপকূলের আকৃতির উপরেও সমুদ্র স্রোতের সৃষ্টি নির্ভর করে। কিছু কিছু সময় সমুদ্রস্রোত মহাদেশীয় উপকূলে বাধা পেয়ে বিভিন্ন শাখায় ভাগ হয়ে যায় এবং উপকূলের আকৃতিকে অনুসরণ করে প্রবাহিত হয়। এই মহাদেশীয় উপকূলের অবস্থানের কারণে বিভিন্ন জায়গায় সৃষ্টি হয়। যেমন- আটলান্টিক মহাসাগরের দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোত পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে ব্রাজিলের সেন্টরক অন্তরীপে বাধা পায় এবং দুটি শাখায় ভাগ হয় প্রবাহিত হয়।
ছ। ঋতুভেদ: ঋতুভেদে উষ্ণতা ও বৃষ্টিপাত এর তারতম্য এবং বায়ু প্রবাহের দিক পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে গ্রীষ্ম এবং শীতকালে উষ্ণতার তারতম্যের কারণে সমুদ্র জলের ঘনত্ব এবং লবনতা তারতম্য ঘটে। বৃষ্টিপাতের ফলে সমুদ্র জলের লবনতা ও ঘনত্বের তারতম্য ঘটে থাকে। সমুদ্রের উষ্ণতা, লবনতা এবং ঘনত্বের এই তারতম্যের ফলে সৃষ্টি হয় সমুদ্র স্রোত। ভারত মহাসাগরে মৌসুমী স্রোত মৌসুমী বায়ু প্রবাহের দিক পরিবর্তন এর উপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল।
সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → পৃথিবীব্যাপী সমুদ্রস্রোতের প্রভাব
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –
-
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X-geo-3-a