mughal-samrajyer-patan-ancolik-shoktir- utthan
WB-Class-8

মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ও আঞ্চলিক শক্তির উত্থান

শ্রেণিঃ অষ্টম | বিষয়: ইতিহাস । অধ্যায় – আঞ্চলিক শক্তির উত্থান (দ্বিতীয় অধ্যায়)


প্রাচীনকাল থেকেই বহু বৈদেশিক জাতি ভারতবর্ষে এসেছে। কেউ লুঠ করেছে আবার কেউ ভালবেসে থেকে গিয়ে দেশ শাসন করেছে। আজ তোমাদের এরকমই একটা গল্প বলব। ইংরেজ বা ব্রিটিশদের ভারতে আসার গল্প।

তবে তার আগে আরো একবার মনে করাই সেই মুঘলদের কথা। তোমরা আগের ক্লাসেই পড়ে এসেছ মুঘল জাতি কি ভাবে ভারতে এসে প্রায় ২০০ বছর ধরে শাসন করেছে। কিন্তু এই রকম একটা এতো শক্তিশালী জাতির হঠাৎ কিভাবে পতন (শেষ বা অন্তিম) ঘটলো, তা নিশ্চয়ই তোমাদের জানতে ইচ্ছা করে, তাহলে এসো জেনে নিই।

মুঘল সাম্রাজ্যের চিত্র

তোমরা সকলেই জানো মুঘল শেষ শক্তিশালী সম্রাট ঔরঙ্গজেব মারা যান 1707 সালে। আর ঠিক এরপর থেকেই মুঘল শক্তির পতন শুরু হয়।

মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ

ঔরঙ্গজেবের পরবর্তী সময়ে যে সমস্ত শাসকরা রাজত্ব করেছিল, তারা খুবই অদক্ষ ছিল। সামরিক শক্তি অর্থাৎ সৈন্য দলকেও তারা শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে পারেননি। দেশের মধ্যেই অদক্ষ শাসন ব্যবস্থার দরুণ বহু বিক্ষিপ্ত বিদ্রোহ শুরু হয়ে গিয়েছিল। তার সাথেই ছিল ছত্রপতি শিবাজি ও মারাঠাদের আক্রমণ।

এতো গেল ঘরের কথা, এরপর শুরু হয় বৈদেশিক শক্তির আক্রমণ। একদিকে নাদির শাহ (1739 খ্রিঃ) অন্যদিকে আহম্মদ শাহ আবদালি (1756 খ্রিঃ)। এছাড়াও সেই সময় থেকেই ইউরোপীয় জাতিগুলি ভারতে আসতে শুরু করেছে। এই সব কিছুর মাঝে মুঘল সাম্রাজ্যের অদক্ষ শাসকদের ঠিক কি করুণ অবস্থা হয়েছিল বুঝতেই পারছ নিশ্চয়ই।

পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য তাজমহল

এরপরেই বলতে হয় অতিরিক্ত ব্যয়, তাজমহলের কথা তোমরা প্রায় সবাই শুনেছ কিন্তু জানো কি, এই ধরণের ব্যয়বহুল স্থাপত্যগুলি বানাতে শাহজাহানের আমলে প্রচুর খরচ হয়েছিল। এরপর থেকেই ধীরে ধীরে অবক্ষয় শুরু হয়। সেই সময় শাহজাহান বা ঔরঙ্গজেবের আমলে শাসন কাঠামো ধীরে ধীরে নষ্ট হতে শুরু করে। যা পরবর্তী শাসকরা সামাল দিতে পারেননি।


অষ্টম শ্রেণির অন্য বিভাগ – বাংলা | ইংরেজি | ভূগোল

এছাড়া দুর্বল অনুন্নত কৃষি, জায়গীরদারি, মনসবদারী প্রথাগুলি শুরুর দিকে সংকটমুক্ত থাকলেও পরবর্তীকালে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়।
এইসব কারণেই প্রায় ২০০ বছরের সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে ভেঙ্গে পড়ে। এই সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের মাঝেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কিছু আঞ্চলিক শক্তির উত্থান হয়।

চল শুরু করা যাক সেই আলোচনা।

সেই সময় তিনটি মূল শক্তি কেন্দ্র ছিল।
হায়দ্রাবাদ, অযোধ্যা এবং বাংলা।

চলো এবার এই তিনটি রাজনৈতিক শক্তি কেন্দ্র নিয়ে আলোচনা শুরু করি।

হায়দ্রাবাদ

হায়দ্রাবাদের নাম তো তোমাদের সকলেরই জানা। কিন্তু জানো কি হায়দ্রাবাদ কিভাবে তৈরি হয়েছিল?
মুঘল শাসক ঔরঙ্গজেবের সভাকক্ষে একজন অভিজাত ছিলেন তার নাম ছিল মির কামার উদ্দিন খান সিদ্দিকি।

ঔরঙ্গজেব এনাকে চিনক্লিচ খাঁ উপাধি দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ফারুখশিয়ার তাঁকে নিজাম উল মূলক এবং মহম্মদ শাহ তাঁকে আসফ ঝা উপাধি দেন।

এই এতো এতো উপাধি নিয়ে তিনি 1724 সালে প্রতিষ্ঠা করেন হায়দ্রাবাদ। [সব নামগুলো মনে রাখতে হবে কিন্তু।]

কিন্তু, হায়দ্রাবাদে তো তখন শাসন করছেন মুবারিজ খান, তো কি! আসফ খান মুবারিজ খানকে পরাস্ত করে 1740 খ্রিঃ এবং দাক্ষিণাত্যের সুবেদার হিসাবে নিজাম নামে স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা শুরু করেন।


অষ্টম শ্রেণির অন্য বিভাগ – গণিত | বিজ্ঞান | ইতিহাস

মুঘল শাসকদের নামাঙ্কিত মুদ্রা ব্যবহার থেকে শুরু করে মুঘল সম্রাটের নামে খুৎবা পাঠ হলেও, আর কোনো ক্ষেত্রেই মুঘল শাসকদের মতামত নেওয়া হত না। বলা ভাল তারা মূলত স্বাধীন রাজ্যের মতই শাসন পরিচালনা করতেন।

অযোধ্যা

এরপরে চলে আসি অযোধ্যায়। 1722 সালে সাদাৎ খান নামে এক মুঘল প্রশাসক অযোধ্যায় স্থানীয় প্রশাসকদের বিদ্রোহ দমনে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি সেই কাজে সফল হওয়ায় মুঘল সম্রাট সাদাৎ খানকে বুরহান-উল-মুলক উপাধি দেন। এখন এই সাদাৎ খান তার জামাতা সফদর জং-কে মুঘল সম্রাটের অনুমতিতেই অযোধ্যার প্রশাসক হিসাবে নিযুক্ত করেন। অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে এই ক্ষেত্রেও মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে থেকেও স্বাধীন রাজ্যের মতই অযোধ্যা শাসিত হত। 1754 সালে সফদর জং মারা গেলে তার পুত্র সুজা উদ-দৌলা বক্সারের যুদ্ধের (1764 খ্রিঃ) আগে অবধি অযোধ্যার শাসনভার পরিচালনা করেন।

বাংলা

এরপরেই চলে আসি সেই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা, বাংলায়। শুরুতেই বলেছিলাম ব্রিটিশ শাসন কিভাবে ভারতে শুরু হয়েছিল সেই গল্প বলব। তার জন্য আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় ৩০০ বছর। সালটা 1717, মুঘল সম্রাট ফারুখশিয়ার মুর্শিদকুলি খানকে বাংলার দেওয়ান এর দায়িত্বের পাশাপাশি নাজিম পদেও অধিষ্ঠিত করেন। এরপর থেকে বাংলায় মুঘলদের অধীনে মুর্শিদকুলি খানের শাসন শুরু হয়।

ভারতবর্ষে যেকটি আঞ্চলিক শক্তি সেই সময় ছিল তাদের মধ্যে বাংলা ছিল অন্যতম। মুর্শিদকুলি খানের আমলে বাংলা ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যপক উন্নতি করে। মূলত হিন্দু, মুসলমান ও আর্মেনীয় ব্যবসায়ীরাই বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। এদের মধ্যে খোদা ওয়াজিদ, উমিচাঁদ ও জগত শেঠ প্রমুখ ব্যাক্তি ভীষণ উল্লেখযোগ্য।

[বিঃ দ্রঃ এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখতে চাই জগত শেঠ কিন্তু কোনো একজন ব্যাক্তি নয়। এটি একটি উপাধি মাত্র। জনৈক ব্যবসায়ী ফতেহচাঁদ মুঘল সম্রাটের থেকে “জগতের শেঠ” বা, “জগত শেঠ” উপাধি পেয়েছিলেন। সেই উপাধি বংশানুক্রমিকভাবে ঐ পরিবারে চলতে শুরু করে।]

মুর্শিদকুলি খানের সাথে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ মুঘল শাসকদের ভাল থাকলেও 1727 খ্রিঃ তাঁর মৃত্যুর পর সেনাপতি আলিবর্দি খান শাসনভার গ্রহণ করলে সেই সম্পর্কের অবনতি শুরু হয়। হায়দ্রাবাদ ও অযোধ্যার ক্ষেত্রে আমরা যে ছবি দেখেছি এক্ষেত্রেও সেটাই হয়। এমনকি নিয়মিত রাজস্ব পাঠানোর যে রীতি তাও বন্ধ হয়ে যায়। 1756 খ্রিঃ আলিবর্দি খানের মৃত্যুর সময়ে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা স্বশাসিত রাজ্য হিসাবে শাসিত হত। এরপর তার নাতি সিরাজ-উদ-দ্দৌল্লা শাসনভার গ্রহণ করেন এবং এই সময় থেকেই ব্রিটিশ কোম্পানির সাথে বাংলার শাসক সিরাজের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু হয়।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → বাংলা ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পর্ক


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখিকা পরিচিতিঃ

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত প্রত্যুষা মুখোপাধ্যায়। বিভিন্ন বিষয় চর্চার পাশাপাশি নাচ,গান, নাটকেও প্রত্যুষা সমান উৎসাহী।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করতে ভুলো না।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –

VIII_His_2a