nepolion
WB-Class-9

নেপোলিয়নের উত্থান (প্রথম পর্ব)

ইতিহাসনবম শ্রেণি – বিপ্লবী আদর্শ, নেপোলিয়নীয় সাম্রাজ্য ও জাতীয়তাবাদ (প্রথম পর্ব)


আগের অধ্যায়ের আলোচনায় আমরা জেনেছি যে, রোব্‌সপিয়ারের মৃত্যুর সাথে সাথে ফ্রান্সে সন্ত্রাসের শাসনের অবসান ঘটে এবং ফ্রান্সের শাসনভার জ্যাকবিনদের হাত থেকে চলে যায়।

এর পরে ফ্রান্সে শুরু হয় ‘ডাইরেক্টরির’ শাসনব্যবস্থা।

Time-table-nepolion-1

‘ডাইরেক্টরির’ শাসনব্যবস্থা কি?

ফ্রান্সের নবনিযুক্ত গণতন্ত্র প্রথমে একক ব্যাক্তির (রোব্‌সপিয়ারের) উপরে তার শাসনক্ষমতা অর্পণ করেছিল, কিন্তু এর ফলে ফ্রান্সের আভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থা তার স্থিতাবস্থা হারায় এবং মানুষের স্বাধীনতা এক বিরাট প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন হয়। সন্ত্রাসের শাসনের অবসান হবার পরে, ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের জাতীয় সভা এক নতুন শাসনব্যাবস্থার প্রণয়ন করেন; এর নাম ছিল ‘ডাইরেক্টরির’ (Directory) শাসন। এই ব্যবস্থায় পাঁচজন ডিরেক্টরকে নিয়ে একটি কার্যনির্বাহক ডাইরেক্টরি গঠন করা হয়, এই ডাইরেক্টরির দ্বারাই দেশ পরিচালিত হতে শুরু হয়।

মনে রাখতে হবে এই সময়ে দাঁড়িয়ে ফ্রান্স তখনও আভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক সংকটের মোকাবিলা করছিল। কারণ একধারে যেমন দেশের অভ্যন্তরে দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থা ও অপরিণত শাসনব্যবস্থায় দেশের মানুষ জর্জরিত ছিল, অপরপ্রান্তে সঠিক পররাষ্ট্রনীতির অভাবে ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলি ক্রমেই ফ্রান্সকে কোণঠাসা করা শুরু করেছিল।

ডাইরেক্টরির শাসন কালে দেশের আভ্যন্তরীণ পরিকাঠামো পরিবর্তিত না হলেও, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ফ্রান্স ব্যাপক উন্নতি করে।

এই উন্নতির মূল কারণ ছিলেন এক অসাধারণ সামরিক কারিগর নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।

নেপোলিয়নের উত্থান পর্বের পাঠ শুনুন এই লিঙ্ক থেকে। ↓

নেপোলিয়ান বোনাপার্ট কে ছিলেন?

ফ্রান্সের ইতিহাসের এক জ্বলজ্বলে নক্ষত্র হলেন এই মানুষটি।

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট একটি সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও, শুধুমাত্র তার সামরিক দক্ষতা এবং কূটনৈতিক বুদ্ধিকে হাতিয়ার করে ফ্রান্সের সম্রাট হয়েছিলেন। কেবল ফ্রান্সের ইতিহাসেই নয়, সারা বিশ্ব যত রাষ্ট্রনায়ক জন্ম নিয়েছেন, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট তাঁদের মধ্যে একজন অগ্রগণ্য মনীষী।

নেপোলিয়ন_বোনাপার্ট

গোড়ার কথা।

কর্সিকা দ্বীপের এক অতি সাধারণ পরিবারে নেপোলিয়ন জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র নয় বছর বয়সে তিনি সামরিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন এবং মাত্র ষোল বছর বয়সেই তিনি সেনাবাহিনীতে লেফট্যানেন্ট পদে যোগ দেন। ১৭৯৩ সালে তিনি ইংরেজ বাহিনীর হাত থেকে তুঁলো (Toulon) বন্দর উদ্ধার করেন। তার এই কৃতিত্বের জন্য তাকে সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়।

Destruction_of_the_French_Fleet_at_Toulon_18th_December_1793
তুঁলো বন্দর দখল।

১৭৯৫ সালে ক্ষিপ্ত জনতা কনভেনশন হাউস আক্রমণ করলে, নেপোলিয়ন একক দক্ষতায় তা রক্ষা করেন। এই অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য তাঁকে ফ্রান্সের প্রধাণ সেনাপতি পদে নিযুক্ত করা হয়। এই ঘটনাটি ছিল নেপোলিয়ানের সামরিক জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এর পর থেকেই তাঁর সেনানায়ক রূপে উত্থান শুরু হয়।

13Vendémiaire
ক্ষিপ্ত জনতার কনভেনশন হাউস আক্রমণ

সেনানায়ক রূপে ইতালি অভিযান।

নেপোলিয়নের একটি উদ্দেশ্য ছিল ইতালি থেকে অস্ট্রিয়ার (সেই সময়কার অন্যতম শক্তিশালী দেশ ছিল এই অস্ট্রিয়া) শক্তি খর্ব করা। সেনানায়ক হবার প্রথমেই তিনি এই ব্যাপারে মনোযোগ দেন। মনে রাখতে হবে এই সময়ে ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া এবং সার্ডিনিয়া (বর্তমানে ইতালির অন্তর্গত) একযোগে ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধ লড়ছে।

সর্বপ্রথমে নেপোলিয়ন ‘মন্তোভির’ যুদ্ধে সার্ডিনিয়াকে পরাজিত করেন। এর ফলে পার্মা, মডেনা এবং নেপল্‌স্‌ (এগুলি বর্তমানে ইতালির অন্তর্গত) এর শাসকরাও ফ্রান্সের কাছে পরাজয় স্বীকার করেন। এর পরে নেপোলিয়ন মিলান অর্থাৎ পোপের রাজ্য আক্রমণ করলে, পোপ ফ্রান্সের সাথে টলেন্টিনোর সন্ধি (Treaty of Tolentino) সাক্ষরে বাধ্য হন।

Bonaparte_reçoit_les_prisonniers_sur_le_champ_de_bataille,_1797
নেপোলিয়নের ইতালি অভিযান।

প্রবল আত্মবিশ্বাসী নেপোলিয়নের বাহিনী অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় পৌছালে, অস্ট্রিয়ার সম্রাট ‘ক্যাম্পো ফর্মিওর’ সন্ধি সাক্ষর করেন। এটি ছিল নেপোলিয়নের একটি চমকপ্রদ সাফল্য। এই চুক্তির ফলে সমগ্র ইউরোপে ফ্রান্সের সম্মান বৃদ্ধি হয়।

‘ক্যাম্পো ফর্মিওর’ সন্ধি

আমরা আগেই জেনেছি যে, তৎকালীন সময়ে অস্ট্রিয়া ছিল একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র। ফ্রান্সের সাথে অষ্ট্রিয়ার এই ‘ক্যাম্পো ফর্মিওর চুক্তি ইউরোপের অভ্যন্তরে অষ্ট্রিয়ার ক্ষমতা অনেকটাই খর্ব করে।

এই চুক্তির ফলে ফ্রান্সের অনেকগুলি লাভ হয়।

  • ফ্রান্সের সীমানা বৃদ্ধি পায়
  • ইতালি অস্ট্রিয়ার কবল থেকে মুক্ত হয়
  • ইতালির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পোপের একক অধিপত্য খর্ব হয়
  • ইতালিতে বেশ কিছু অংশে প্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয় (সিস আলপাইন এবং লাইগুরিয়ান প্রজাতন্ত্র)

[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – বাংলা | নবম শ্রেণি – ইতিহাস | নবম শ্রেণি – ভূগোল]

নেপোলিয়নের মিশর অভিযান

ইতালির বিজয়ের পরের বছর নেপোলিয়ন ফ্রান্সের অপর এক শত্রু ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অধিনায়কত্ব করেন। এই অভিযানের প্রথম যুদ্ধ; ‘পিরামিডের যুদ্ধে’ ফ্রান্স জয়লাভ করলেও, পরবর্তী যুদ্ধ ‘নীলনদের যুদ্ধে’ নেপোলিয়ান বাধার সম্মুখীন হন।

ইংরেজ সেনানায়ক নেলসনের প্রতিনিধিত্বে শক্তিশালী নৌবাহিনী ফ্রান্সের নৌবাহিনীকে পরাজিত করে, এর ফলে ফ্রান্সের সাথে নেপোলিয়নের বাহিনীর যোগাযোগ, রসদ সংযোগ ছিন্ন হয়।

Bonaparte_ante_la_Esfinge,_por_Jean-Léon_Gérôme
শিল্পীর কল্পনায় গিজার পিরামিডের সামনে নেপোলিয়ন

কিন্তু পরাজয়ের খবর ফ্রান্সে এসে পৌছনোর আগেই নেপোলিয়ন ফ্রান্সে ফিরে আসেন। ফ্রান্সের দুই প্রধান শত্রু দমন এবং বৈদেশিক নীতিতে ব্যাপক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য নেপোলিয়ান দেশের মানুষের কাছে ভীষণভাবে সমাদৃত হন।


[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – ভৌত বিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – জীবন বিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – গণিত ]

নেপোলিয়ানের ক্ষমতা দখল

নেপোলিয়ানের মিশর অভিযানের পরবর্তী সময়টা ছিল ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ।

একদিকে ‘ডাইরেক্টারির’ অদক্ষ শাসনে দেশের মানুষ ক্রমশ বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠছিলেন, আর অপরদিকে সেনানায়ক নেপোলিয়নের দক্ষ সামরিক কৃতিত্বে গোটা ইউরোপে ফ্রান্সের গৌরব বৃদ্ধি হচ্ছিল।

ফ্রান্সের জনমত ক্রমশ ‘ডাইরেক্টারির’ কুশাসন ছেড়ে নেপোলিয়নের নেতৃত্বাধীন একটি সুশাসনের দিকে ঝুঁকতে শুরু করলে, নেপোলিয়ন জনগনের এই ভাবনা অনুমান করেন। ব্যারাস ও অ্যাবিসিয়েস নামক দুইজন ডাইরেক্টের সাহায্যে, সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ডাইরেক্টারির শাসনের অবসান ঘটান।

Bouchot_-_Le_general_Bonaparte_au_Conseil_des_Cinq-Cents
সেনা অভ্যুত্থান

১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দের ৯ই নভেম্বর নেপোলিয়ন কনসুলেট নামক নতুন শাসনব্যাবস্থার প্রবর্তন করেন। এর সাথেই ফ্রান্সে শুরু হয় নেপোলিয়নের যুগ (Age of Napoleon)।

প্রথম পর্ব সমাপ্ত।

তোমার মনে হতেই পারে যে, ফ্রান্সের একজন সেনানায়ক, যিনি তার দেশের অগ্রগতির জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর কথা আমি একজন ভারতীয় হয়ে কেন জানবো?

তোমার মনের এই প্রশ্ন আসা সঠিক, কিন্তু আমরা আশা করছি এই অধ্যায়ের আলোচনা শেষে তুমি নিশ্চয় তোমার প্রশ্নের উত্তর পাবে এবং পৃথিবীর ইতিহাসে নেপোলিয়ানের গুরুত্ব বুঝতে পারবে।

পরবর্তী পর্ব → কোড নেপোলিয়ন


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –