nobo-nobo-sristi
WB-Class-9

নব নব সৃষ্টি – প্রথম পর্ব

বাংলানবম শ্রেনি – নব নব সৃষ্টি (প্রথম পর্ব)


সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘নব নব সৃষ্টি’ প্রবন্ধ দুটি পর্বে আলোচিত হল।

লেখক পরিচিতি

আমাদের আলোচ্য পাঠ্যাংশটি একটি প্রবন্ধ এবং এই প্রবন্ধের লেখক হলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী। অবিভক্ত বাংলাদেশের শ্রীহট্ট জেলার করিমগঞ্জে ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের ১৩ সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রাথমিক পড়াশনা শুরু হয়েছিল সিলেট গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে। সে সময় ভারতে গান্ধিজীর নেতৃত্বে যে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল, তাতে তিনি যোগ দেন এবং স্কুলের পড়াশোনায় ছেদ পড়ে। পরে যদিও শান্তিনিকেতনে তিনি পড়াশোনা সমাপ্ত করেন। সেই সুবাদে বিশ্বভারতী এবং গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ ঘটেছিল তাঁর।

কাবুলের শিক্ষাবিভাগে তিনি ফরাসি ও ইংরেজি ভাষাশিক্ষার অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৩২ সালে জার্মানি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে দেশে ফিরে আসেন। সমগ্র বিশ্বের মধ্যে ইউরোপ, জেরুজালেম, দামাস্কাস, কায়রো সহ আরো নানা দেশে ঘোরার অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। ফলে তাঁর সাহিত্যেও এর প্রভাব পড়েছে। আমাদের মনে রাখতেই হবে সৈয়দ মুজতবা আলীর বিখ্যাত ভ্রমণ কাহিনিগুলি যার মধ্যে ‘দেশে বিদেশে’ বইটি অন্যতম জনপ্রিয়। ১৯৫০ সালে মুজতবা আলী আকাশবাণীর কেন্দ্র পরিচালকের দায়িত্ব পান। বাংলা, ইংরেজি ছাড়াও তিনি মোট ১৫টি ভাষা জানতেন যার মধ্যে আরবি, ফার্সি, জার্মানি, উর্দু, মারাঠি অন্যতম।

ভ্রমণ সাহিত্যের পাশাপাশি তাঁর রম্যরচনাও বাঙালি পাঠকের কাছে বড়োই আস্বাদ্য। তাঁর লেখা ‘ধূপছায়া’, ‘পঞ্চতন্ত্র’, ‘ভবঘুরে’ ইত্যাদি রম্যরচনাগুলি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এছাড়া ছোটোগল্প এবং উপন্যাস রচনার জগতেও তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল। তাঁর অন্যতম বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ হল ‘চাচাকাহিনি’ যার মধ্যে আমরা একই সঙ্গে রম্যরচনা ও ছোটগল্পের গুণ দেখতে পাই। ‘স্বয়ংবরা’, ‘মা-জননী’, ‘কাফে দে-জেনি’, ‘পাদটীকা’, ‘পুনশ্চ’ ইত্যাদি গল্পগুলি ঐ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। মুজতবা আলীর লেখা উপন্যাসের মধ্যে ‘অবিশ্বাস্য’, ‘শবনম্’, ‘শহর ইয়ার’ অত্যন্ত জনপ্রিয় ও বহুল পঠিত সাহিত্য। এসবের বাইরে মুজতবা আলীর একটি পৃথক পরিচয় গড়ে উঠেছিল প্রাবন্ধিক হিসেবে। তাঁর রচনার শৈলীতে, লঘুতা ভরা গাম্ভীর্যে, এমনকি শব্দ প্রয়োগের মুন্সিয়ানায় তাঁর প্রবন্ধগুলি বেশ সুখপাঠ্য। ‘চতুরঙ্গ’, ‘টুনিমেম’, ‘রাজা-উজীর’, ‘হিটলার’, ‘গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন’ ইত্যাদি প্রবন্ধগুলির নাম অনায়াসে স্মরণে রাখা যায়। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি ভাষাশিল্পী এই মহান সাহিত্যিকের মৃত্যু হয়।


আরো পড়ো → নব নব সৃষ্টি প্রবন্ধের নামকরণের সার্থকতা

উৎস

পাঠ্যাংশের ‘নব নব সৃষ্টি’ রচনাটি ‘সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনাবলী’ বইটি থেকে সংকলিত হয়েছে। তবে সম্পূর্ণ প্রবন্ধটি তোমাদের পাঠ্য নয়, বরং সমগ্র প্রবন্ধটির একটি সংক্ষেপিত ও সম্পাদিত রূপ পাঠ্য হিসেবে নেওয়া হয়েছে। 

বিষয়সংক্ষেপ  (প্রথম অংশ)

এই প্রবন্ধে লেখক মূলত বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার এবং বিদেশি শব্দের ব্যবহার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তবে মাতৃভাষা ও অন্যান্য ভাষার সমস্যা, বিপন্নতা তাঁর প্রবন্ধের শুরুতে আলোচিত হয়েছে যা পাঠ্যাংশে নেই। অন্য ভাষার সঙ্গে তুলনায় আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ঠিক কোন অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে তা সম্পর্কে প্রাবন্ধিক বুদ্ধিদীপ্ত ও যুক্তিগ্রাহ্য মত প্রকাশ করেছেন। সব মিলিয়ে এই রচনায় একইসঙ্গে লেখকের ভাষাজ্ঞান ও পাণ্ডিত্য এবং প্রাঞ্জল রচনাশৈলী ফুটে উঠেছে।


নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবন বিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

প্রবন্ধের শুরুতেই লেখক বলছেন সংস্কৃত ভাষা আত্মনির্ভর ভাষা। এই সংস্কৃত ভাষার শব্দভাণ্ডার এত সমৃদ্ধ যে নতুন নতুন অনুভূতি প্রকাশের জন্য তাকে অন্য ভাষার কাছে ধার করতে হয় না, নিজের ভাণ্ডারের শব্দকে উলটে পালটে নিয়েই তার কাজ চলে যায়। এই সংস্কৃত ভাষার পাশাপাশি লেখক বলছেন প্রাচীন যুগের আরবি ভাষাও স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষা। 

অর্থাৎ এ সকল ভাষায় কোনো বিদেশি শব্দের উপস্থিতি নেই, সমস্ত শব্দই খাঁটি মৌলিক শব্দ। ঠিক এর বিপরীতে লেখক রাখছেন বাংলা ও ইংরেজি ভাষাকে। বাংলা ও ইংরেজি মোটেই আত্মনির্ভরশীল ভাষা নয় কারণ প্রয়োজনের তাগিদে এই দুই ভাষায় বহুল বিদেশি শব্দের প্রবেশ ঘটেছে, বহু বিদেশি ভাষা থেকে ঋণ করতে হয়েছে শব্দ। শাসনকার্য পরিচালনা, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনে বিদেশি ভাষার প্রভাব পড়েছে বাংলা-ইংরেজির মধ্যে। এই বিদেশি শব্দের প্রবেশ ক্রমাগত চলেছে এবং এই ধারা অসীম-অনন্ত, ভবিষ্যতেও চলবে। ‘নব নব সৃষ্টি’ প্রবন্ধটি তাই একটি বস্তুনিষ্ঠ প্রবন্ধ যেখানে ভাষার আলোচনা, জাতির আলোচনা, সংস্কৃতির আলোচনা রয়েছে। বাংলা ভাষার সঙ্গে সংস্কৃত, আরবি-ফার্সি ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষা ও বিদেশি ভাষার সম্পর্ক বিষয়ে লেখকের সুললিত বক্তব্য আমাদের কাছে পরিস্কার হয়ে যায়।


নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

সংস্কৃতের কথা বলতে বলতে প্রশ্ন এসেই যায় সংস্কৃতের প্রভাব কীভাবে বাংলায় পড়লো? 

উত্তরে লেখক আমাদের জানাচ্ছেন যে সংস্কৃত চর্চা একসময় এদেশে ছিল। বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও শব্দভাণ্ডারের বেশ অনেকটাই সংস্কৃত থেকে ধার নেওয়া। তবে এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার সংস্কৃত কিন্তু বাংলা ভাষার জননী নয়। লোকসমাজে প্রচলিত আছে যে বাংলা ভাষা সংস্কৃত থেকে সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু এই তথ্যটি আদ্যন্ত ভুল।

এই কথার উত্তর দিতে গেলে আমাদের জেনে নিতে হবে বাংলা ভাষার জন্মবৃত্তান্ত। আধুনিককালের পৃথিবীতে যে সকল ভাষা মানুষ ব্যবহার করে থাকেন সেগুলির আদি উৎস ছিল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ যার উত্তরসূরি হল আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা থেকে দীর্ঘ প্রায় তিন-সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে বিবর্তনের ফলে বহু ভাষার পাশাপাশি বাংলার জন্ম হয়েছে। প্রথমে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাটি দশটি উপভাষায় বিভক্ত হয়ে যায় যেমন – ইন্দো-ইরানীয়, বালতো-স্লাবিক, আর্মেনীয়, আলবানীয়, গ্রিক, জার্মানিক, ইতালিক, কেলতিক, তুখারীয় ও হিত্তীয়। আসলে এই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় যারা কথা বলতো সেই ভাষাগোষ্ঠীটি রাশিয়ার ইউরাল পর্বতমালার পাদদেশে কিরঘিজ তৃণভূমি অঞ্চল থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে, সেজন্যই এত বৈচিত্র্য- এত বিভাজন হয়ে গেল ভাষাগোষ্ঠীতে। এখন এদের মধ্যে ইন্দো-ইরানীয় ভাষাটি ভারতে ও ইরানে প্রবেশ করে। যে ভাষাগোষ্ঠীটি ভারতে প্রবেশ করেছিল সেখান থেকে সৃষ্টি হয়েছিল প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা, এই ভাষায় ঋগবেদ্‌ লেখা হয়েছিল। এরপরে এই প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা থেকে কীভাবে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলার জন্ম হল তা আমরা একটি রেখা-তালিকার মাধ্যমে দেখে নেবো।

তাহলে আশা করি এই তালিকাটি থেকে তোমরা খুব সহজেই বাংলা ভাষার জন্মবৃত্তান্ত বুঝতে পারলে এবং কতটা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আজকের বাংলার উৎপত্তি তার একটা ধারণা তোমাদের হল। একটা জিনিস লক্ষ করে দেখো এই তালিকায় কোথাও কিন্তু সংস্কৃতের স্থান নেই। তাই এটা প্রমাণিত হল যে বাংলা ভাষার সৃষ্টি সংস্কৃত থেকে হয়নি।

দেখে নাও নব নব সৃষ্টি প্রবন্ধের সম্পূর্ণ আলোচনা↓

পরবর্তী পর্ব – নব নব সৃষ্টি (দ্বিতীয় পর্ব)

পর্ব সমাপ্ত।


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –