বাংলা – নবম শ্রেনি – ভাঙার গান (পদ্য)
কবি পরিচিতি
১৮৯৯ সালের ২৪ মে বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম হয় কাজী নজরুল ইসলামের। তাঁর পিতা কাজী ফকির আহমেদ এবং মাতা জাহেদা খাতুন। গ্রামের মক্তবে দশ বছর বয়স পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও বেশিদূর পড়া হয়নি তাঁর। আর্থিক দুরবস্থার জন্য একটি রুটির দোকানে কাজ করতে হয় তাঁকে। অষ্টম শ্রেণি পাশ করে বাঙালি পল্টন হিসেবে করাচিতে সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। ১৯১৭ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত তাঁর সৈনিকের জীবন কাটে।
১৯২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি রাজদ্রোহের অভিযোগে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন নজরুল। এরই পাশাপাশি ‘নবযুগ’ পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক হন তিনি। এরপর নজরুলের সম্পাদনায় প্রকাশ পায় বিখ্যাত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা যেখানে রবীন্দ্রনাথ আশীর্বাণী লিখে দিয়েছিলেন। তিনি ‘লাঙল’ নামে আরো একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। শুরু হয় তাঁর সাহিত্যচর্চা। তাঁর প্রথম কবিতা মুক্তি প্রকাশ পায় ১৩২৬ বঙ্গাব্দে। ‘লাঙল’, ‘ধূমকেতু’, ‘প্রবাসী’, ‘মোসলেম ভারত’, ‘শনিবারের চিঠি’, ‘বিজলী’ ইত্যাদি সাময়িক পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। কাজী নজরুলের অন্যতম প্রধান কাব্যগ্রন্থগুলি হল – ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘ফণিমনসা’, ‘চক্রবাক’, ‘সাম্যবাদী’, ‘সঞ্চিতা’, ‘দোলনচাঁপা’, ‘ছায়ানট’, ‘সর্বহারা’ ইত্যাদি। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশ পাওয়ার পরে বাংলা সাহিত্য জগতে আলোড়ন তৈরি হয়েছিল যা আজও মানুষের স্মৃতিতে অমলিন। এছাড়া তিনি লিখেছেন শতাধিক গান।
তাঁর লেখা শ্যামাসঙ্গীত বাংলা গানের ইতিহাসে এক মাইলফলক হয়ে আছে। এছাড়াও তিনি লিখেছেন তিনটি উপন্যাস, কিছু নাটক আর ছোটদের জন্য ছড়া। ১৯৭৬ সালে দুরারোগ্য পিক্স রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।
ভাঙার গান কবিতার বিস্তারিত আলোচনা দেখে নাও এই ভিডিও থেকে↓
ভাঙার গান – সারাংশ
‘ভাঙার গান’ মূলত একটি গান।
যদিও নজরুলের বেশিরভাগ কবিতাতেই গীতিধর্মিতা বর্তমান। ১৯২৪ সালে প্রকাশিত নজরুলের ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত প্রথম কবিতা। পরাধীন ভারতবর্ষের বীর বিপ্লবীরা ব্রিটিশের অত্যাচার-শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করতে আন্দোলন গড়ে তুলছে দিকে দিকে। সুদিন আর বেশি দেরি নেই। দেশের শাসক ব্রিটিশ সরকারের নিপীড়নে যেখানেই গর্জে উঠেছে প্রতিবাদ-স্বাধীনতার স্লোগান, কণ্ঠরোধ করে দেওয়া হচ্ছে তাদের। বিপ্লবীদের বন্দী করে পাঠানো হচ্ছে কালাপানি পেরিয়ে আন্দামানের জেলে। পুরো দেশটাই যেন পরিণত হয়েছে কারাগারে। ‘ভাঙার গান’ আসলে সেই বন্দিশালা ভাঙার আহ্বানমন্ত্র।
কবি বন্দি বিপ্লবীদের আহ্বান জানিয়েছেন ভীমকারার লোহার কপাট ভেঙে ফেলতে। ভারতমাতার কোলে আজ নিহত বিপ্লবী সন্তানের রক্ত জমাট হয়ে এছে, দেবতার পাষাণবেদি ভেসে গেছে রক্তে। সেই পাষাণবেদিতে প্রলয় এসে সমস্ত শিকল ছিন্ন করে দেশ স্বাধীন হবে এই স্বপ্ন কবি দেখাতে চেয়েছেন তরুণদের। তরুণরা যেন শিবের সংহারক রূপ। কবি স্বপ্ন দেখেন বৈষম্যহীন সমাজের – সমস্ত ভেদাভেদের সীমারেখা ভেঙে ফেলতে তাই ডাক দিয়েছেন নজরুল। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা – মানুষের অধিকার। সেই স্বাধীনতার আন্দোলনকে কেউ দণ্ডিত করতে পারে না। ফাঁসির সাজা দিয়ে কোনো বিপ্লব দমিয়ে রাখা যায় না। কবি ‘পাগলা ভোলা’কে আহ্বান করেছেন যেন তিনি প্রলয়ের টানে সব গারদের আগল ভেঙে দেন। জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে বন্দি বিপ্লবীরা যেন সমস্ত কারাগারের তালা লাথি মেরে ভেঙে ফেলেন তিনি এমনই কবির ইচ্ছা।
কবি চান এবার আগুন জ্বলে উঠুক সমস্ত বন্দিশালায়, তবেই স্বদেশের পরাধীনতার জ্বালা ঘুচে গিয়ে সূচিত হবে নতুন ভোর।
প্রেক্ষাপট
‘এক হাতে মম বাঁশের বাঁশরি আর হাতে রণতূর্য’
‘বিদ্রোহী’ কবিতায় এ কথা ঘোষণার মাধ্যমে বাংলা কবিতায় চিরবিদ্রোহের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আগমন নজরুলের। পরাধীনতা থেকে মুক্তির আন্দোলন তাঁর পাথেয়, তাঁর প্রতিটি কবিতাতেই ব্রিটিশ বিরোধিতা এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ফুটে ওঠে। এই লেখাটিও তার ব্যতিক্রম নয়।
তাঁর লেখা আলোচ্য ‘ভাঙার গান’ কবিতাটি প্রথমে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ‘বাংলার কথা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। মুজফ্ফর আহমেদ তাঁর স্মৃতিকথায় জানাচ্ছেন যে দেশবন্ধু কারারুদ্ধ হওয়ার আগে একদিন তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবীর অনুরোধে নজরুল নিজের মেসবাড়িতে তক্তাপোশে বসে থাকা মুজফ্ফর আহমেদের সামনেই লিখেছিলেন এই গানটি। নজরুল নিজে কারাগারে থাকাকালীন গানটিতে সুর দেন। বিশদে আলোচনা করার আগে এর প্রেক্ষাপটটা জেনে নেওয়া জরুরি।
সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর বন্ধু দিলীপকুমার রায়কে এক জায়গায় জানিয়েছেন – ‘জেলে যখন ওয়ার্ডাররা লোহার দরজা বন্ধ করে, তখন মন কী যে আকুলি-বিকুলি করে কী বলব! তখন বারবার মনে পড়ে কাজীর সেই গান – ‘কারার ঐ লৌহ-কপাট…প্রাচীর ভেদি’। পরাধীন ভারতে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, ওয়াহাবি-খিলাফত আন্দোলন, অসহগযোগ আন্দোলন আবার অন্যদিকে ইউরোপে রুশ বিপ্লব, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ- এসব মিলিয়ে সময়টা তখন উত্তাল। দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রতিবাদ-বিদ্রোহ জমে উঠেছে।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবন বিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
নজরুলের চিন্তায়, চেতনায় বিদ্রোহ – ‘ভাঙার গান’ যেন এই বিদ্রোহেরই চরমতম প্রকাশ। প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘নজরুল স্মৃতিমাল্য’ গ্রন্থে জানিয়েছেন যে ব্রিটিশদের কারাগারে বন্দি স্বদেশপ্রেমিক বিপ্লবীরা যখন হাঁফিয়ে উঠতো, বন্দি নজরুল তখন গান ধরতেন – ‘কারার ঐ লৌহ-কপাট / ভেঙে ফেল কররে লোপাট।’ আর এই গান শুনে বন্দিদের জমানো ক্ষোভ গর্জে উঠতো। বিদ্রোহী কবি নজরুল তাঁর কাব্যবাণীকে অগ্নিবীণায় এবং প্রেমের বাঁশিকে বিষের বাঁশিতে রূপান্তরিত করেছিলেন। স্বদেশের স্বাধীনতার ইচ্ছা তাঁর ছিল প্রবল। দেশপ্রেমের আবেগে দেশমাতাকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। স্বাধীনতার জন্মগত অধিকার ব্রিটিশদের থেকে ছিনিয়ে নিতেই ‘ভাঙার গান’-এর মাধ্যমে কবি ভারতের সমস্ত বিপ্লবী বীর সন্তানদের জাগ্রত-উজ্জীবিত করতে চেয়েছেন। নজরুল তাঁর বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতাতে বলেছেন –
‘মহাবিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না।’
ভাঙার গান – সরলার্থ
আলোচ্য কবিতাটিতেও কবির বিদ্রোহী মানসিকতার ছাপ পাওয়া যায়। ভারতের পরাধীনতাকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। যে বিপ্লবী অত্যাচারী ইংরেজ শাসনে পিষ্ট, কারাগারের অন্ধকূপে বন্দি তাদের যেন বিপ্লবের প্রাণমন্ত্রে দীক্ষিত করতেই কবির আহ্বান
‘কারার ঐ লৌহ-কপাট
ভেঙে ফেল, কররে লোপাট
রক্ত জমাট
শিকল-পূজার পাষাণ-বেদী!’
কবি চান এই লৌহ-কঠিন কারাগারের সমস্ত গরাদ-সমস্ত তালা যেন ভেঙে ফেলে বিপ্লবীরা। যেখানে দেবতার পাষাণ-বেদি, সেখানে রক্ত জমাট হয়ে আছে। ভারতের সমস্ত পথে-প্রান্তরে বীর সন্তানদের রক্তে স্বাধীনতার যজ্ঞে আহুতি সম্পন্ন হচ্ছে। ‘শিকল’ পরা পরাধীনতাকে ভারতীয়রা যেন মেনে নিয়েছে, আর এই ‘শিকল-পূজা’ বিপ্লবের পরিপন্থী। অন্য এক কবিতা ‘শিকল ভাঙার গান’-এ নজরুল এই শিকল পরাকে ব্যঞ্জনাময় করে লিখেছেন –
‘শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল পরার ছল
এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল’
নজরুল তাই চান, রুদ্র শিবের প্রলয়ে যেন সমস্ত ধ্বংস হয়ে যাক। তিনি জানেন বন্দি বিপ্লবীরাই তরুণ ‘ঈশান’, তারাই সংহারক মহাদেব। ঈশান মহাদেবেরই অপর নাম। তাই তাঁদের আহ্বান জানিয়েছেন কবি –
‘ওরে ও তরুণ ঈশান
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ!’
সেই বিষাণের ধ্বনিতে ভেঙে যাবে ইংরেজ শাসনের সমস্ত কারাগার, সব বন্দিশালা উন্মুক্ত হবে। মুক্ত হবে বিপ্লবীরা, মুক্ত হবেন বন্দিনী ভারতমাতা। ধ্বংসনিশান উড়িয়ে তরুণরা যেন এই বিষাণের ধ্বনিতে সূচনা করবে নতুন দিনের।
আসলে এই ধ্বংসের মধ্য দিয়েই নতুন সৃষ্টি সম্ভব বলে কবি বিশ্বাস করেন।
কবি আহ্বান করেছেন সেই ‘পাগলা ভোলা’কে যিনি আসলে রুদ্র মহাদেব। শিবের দুই সনাতন রূপ –রক্ষকমূর্তি এবং সংহারকমূর্তি। ইংরেজদের কারাগারে বন্দি বিপ্লবী তরুণরাই আসলে স্বয়ং রুদ্র মহেশ্বর। উন্মত্ত দেবাদিদেব যেমন প্রলয় নাচনে ধ্বংস করেন, পুরাতনকে ধূলিসাৎ করেন; তেমনই ভারতমাতার তরুণ মহাবিপ্লবী সন্তানেরাও পারে প্রলয় ঘটাতে। তাই তাদের উজ্জীবিত করতে কবি যেন সোচ্চারে ডাক দেন –
‘দেরে দেখি
ভীম কারার ওই ভিত্তি নাড়ি!’
কালবৈশাখির প্রলয়নাচন শুরু হয়ে গেছে, এখন বিলম্ব করা সাজে না। ভীম কারার ভিত্তিভূমি একেবারে উপড়ে ফেলতে এখনই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। লাথি মেরে তালা ভেঙে কবি চান সমস্ত বন্দিশালায় আগুন জ্বালিয়ে দিতে। এ যেন প্রত্যক্ষ যুদ্ধের সূচনা। আর কোনো আপোস নয়, এবার সক্রিয় আন্দোলনে-তীব্র সংঘাতে সর্বনাশের ঘন্টা বাজিয়ে ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। আকাঙ্ক্ষিত এই স্বাধীনতার যজ্ঞে বিপ্লবী তরুণ বীরদের যেন একটাই বাণী হওয়া উচিত বলে কবি মনে করেন –
‘ জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন’
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
মূল বক্তব্য
পরাধীন ভারতে ইংরেজদের কারাগারে বন্দি অসংখ্য বীর বিপ্লবীদের স্বাধীনতার মন্ত্রে, বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত করতে নজরুল লেখেন এই গানটি। তরুণ ঈশান বিপ্লবীদের আহ্বান জানান কবি, তারা যেন প্রলয় বিষাণ বাজিয়ে সমস্ত কারাগারের তালায় লাথি মেরে উপড়ে ফেলেন বন্দিশালা। বন্দিশালায় আগুন জ্বলে উঠুক কবি চান। সমস্ত ধ্বংসের মধ্য দিয়েই আবার নূতনের শুভসূচনা ঘটবে বলে কবির বিশ্বাস।
পরবর্তী আলোচনা → আমরা কবিতার বিস্তারিত আলোচনা
লেখক পরিচিতি
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
IX-Beng-Vangar-gan