Congress-of-Vienna
WB-Class-9

ভিয়েনা সম্মেলন (১৮১৫)

ইতিহাসনবম শ্রেণি – উনবিংশ শতকের ইউরোপ – রাজতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী সংঘাত(প্রথম পর্ব)

ফরাসী বিপ্লব এবং প্রায় অর্ধ ইউরোপ জুড়ে নেপোলিয়নের শাসন কাল।

এই দুটি ঘটনায় পৃথিবী জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ফরাসী বিপ্লবের মাধ্যমে আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম গণতন্ত্র অর্থাৎ কোনো বংশানুক্রমিক রাজা নয়, রাষ্ট্রের শাসক হবেন জনগণ দ্বারা নির্বাচিত ব্যাক্তিমণ্ডলী।

নেপোলিয়নের সামরিক শাসনকালে ইউরোপের জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল জাতীয়তাবাদী ভাবধারা।

ফ্রান্সে নেপোলিয়নের পতনের পরে ধীরে ধীরে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে এই জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সাথে প্রাচীনপন্থী রাজতন্ত্রের সংঘাত শুরু হয়। এই অধ্যায়ে আমরা ইউরোপের উল্লেখযোগ্য দেশগুলিতে কিভাবে এই সংঘাতের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছিল তা নিয়ে আলোচনা করবো। তবে মূল প্রসঙ্গে যাবার আগে আমরা জাতীয়তাবাদী ভাবধারা সম্পর্কে আরো একটু বোঝার চেষ্টা করবো।

whats-app subscrition_jump-mag

জাতীয়তাবাদী ভাবধারা – জাতি ও রাষ্ট্র

প্রথমে আমরা বুঝে নেব জাতি বলতে আমরা কি বুঝি।

একটি বিশেষ ভৌগলিক ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী, যারা একই ধরনের সংস্কৃতি, ভাষা ও ইতিহাস বহন করে তাদের জাতি বলা হয়। যেমন বাঙালি একটি জাতি, ফরাসী একটি জাতি ইত্যাদি।

এবার আমরা দেখবো রাষ্ট্র কাকে বলে?

সহজ ভাষায় বলতে গেলে রাষ্ট্র হল একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনসমাজ, যারা একটি সরকার দ্বারা পরিচালিত হয় এবং আইনত সেই জনসমাজ ঐ সরকারের আদেশ পালনে বিধিবদ্ধ হয়। যেমন ভারত একটি রাষ্ট্র, ফ্রান্স একটি রাষ্ট্র ইত্যাদি।


এই অধ্যায়ের ভিডিও ক্লাস ↓

এবার আমরা জাতি – রাষ্ট্রের ধারণা বুঝবো।

যখন একই সংস্কৃতি ও ভাষার মানুষজন (অর্থাৎ একই জাতি) একটি ভূখণ্ডের মধ্যে স্বাধীন ও সার্বভৌম ভাবে বাস করে (অর্থাৎ রাষ্ট্র) তখন তাকে জাতি – রাষ্ট্র বলা হয়। এই জাতি – রাষ্ট্রের ধারণার সুত্রপাত হয় ষোড়শ শতাব্দী থেকে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে মাত্র দুটি জাতি – রাষ্ট্র (ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স) ছিল।

প্রসঙ্গত, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এই ধারণা ব্যাপক প্রসারলাভ করলেও, বিংশ শতাব্দীতে এই ধারণা ধীরে ধীরে অচল হয়ে পড়ে।

জাতীয়তাবাদী ভাবধারা বলতে কি বুঝবো?

যখন এক বা একাধিক কারণে কোন জনসমাজের মধ্যে একাত্মবোধের সৃষ্টি হয় এবং এই একাত্মবোধের কারণে জনসমাজ নিজের স্বার্থ উপেক্ষা করে সমগ্রজাতির সুখ – দুঃখ, ন্যায় – অন্যায়ের অংশীদার বলে বলে মনে করে তাকে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা বলা হয়।

পৃথিবীতে প্রায় সকল আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি হল এই জাতীয়তাবাদ।

একটা উদাহরণ দিলে এটা আরো ভালোভাবে বোঝা যাবে। পরাধীন ভারতে লক্ষ লক্ষ বিপ্লবীরা নিজের স্বার্থ উপেক্ষা করে ভারতের গ্লানি মুক্তির জন্য ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিপ্লব – আন্দোলন করেছিল।

whats-app subscrition_jump-mag

আমরা আবার অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফিরে যাই।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপের প্রধান দেশগুলি মূলত শাসিত হত দৈব রাজতন্ত্র দ্বারা। অর্থাৎ বংশানুক্রমিক ভাবে রাজা একটি রাষ্ট্রের শাসক হতেন।

ফরাসী বিপ্লব সর্বপ্রথম এই ধারণায় ছেদ টানে। ১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দে বুরবোঁ রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এর নানা ঘাত – প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে যাবার পরে নেপোলিয়নের সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

নেপোলিয়ন ফ্রান্সের জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সৃষ্টি করেছিলেন। শুধু তাই নয়, নেপোলিয়ন ইউরোপের যে পুনর্গঠন করেছিলেন তার ফলেও ঐ দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সৃষ্টি হয় ।

নেপোলিয়নের পতনের পরে এই জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ গণতন্ত্র ধাক্কা খায়, এবং প্রাচীনপন্থী রাজতন্ত্র আবার শক্তিশালী হয়। এই রাজতন্ত্রের পুনরুত্থান ঘটে ভিয়েনা সম্মেলন থেকে।

ভিয়েনা সম্মেলন (১৮১৫)

আমরা জানি যে নেপোলিয়ন তাঁর শাসনকালে গোটা ইউরোপ জুড়ে ব্যাপক রদবদল করেছিলেন। এই ব্যাপারে আমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।

নেপোলিয়নের পতনের পরে আবার ইউরোপের পুনর্গঠনের লক্ষ্যে বিজয়ী মিত্রশক্তি অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা শহরে একটি সম্মেলনের আয়োজন করেন। শুধুমাত্র পোপ এবং তুরস্কের সুলতান ব্যাতিত সমগ্র ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শাসকরা এই সম্মেলনে যোগ দেন। প্রকৃতপক্ষে এই ভিয়েনা সম্মেলন ছিল পৃথিবীর প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন।

ভিয়েনা সন্মেলনের প্রতিনিধিরা [চিত্রসৌজন্য – britannica.com]
নেপোলিয়নের পতনের মূলে ছিল প্রধানত চারটি দেশ, ইংল্যান্ড, অষ্ট্রিয়া, রাশিয়া ও প্রাশিয়া। ফলে ভিয়েনা সম্মেলনে এই চার দেশের প্রভাব ছিল সর্বাধিক। এঁদের মধ্যে অষ্ট্রিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মেটারনিক ছিলেন এই সম্মেলনের সভাপতি এবং মূল নিয়ন্ত্রক।

সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য

এই সম্মেলনের প্রতিনিধিদের সামনে প্রধান সমস্যাগুলি ছিল নিম্নরূপ।

প্রথমত, নেপোলিয়নের পুনর্গঠন করা ইউরোপের রাজনৈতিক সীমানার কাঠামো পরিবর্তন।

দ্বিতীয়ত, নেপোলিয়ন যে সকল রাজবংশ উচ্ছেদ করেছিলেন, তাঁদের পুনর্বাসন দেওয়া।

তৃতীয়ত, ফ্রান্সের শক্তি স্তিমিত করা, যাতে পরবর্তীকালে ফ্রান্স ইউরোপের শান্তি বিঘ্নিত না করতে পারে।

চতুর্থত, নেপোলিয়নের সাথে যুদ্ধের ফলে বিজয়ী রাষ্ট্রগুলি যে অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল, তার ক্ষতিপূরণ করা।

পঞ্চমত, ভবিষ্যতে ইউরোপের শক্তিসাম্য সুনিশ্চিত করা।

ভিয়েনা সম্মেলনের মূলনীতি

বিস্তারিত আলোচনার পরে এই সম্মেলন থেকে তিনটি নীতি গৃহীত হয়।

ন্যায্য অধিকার নীতি

বিপ্লবপূর্বে ইউরোপে যা অবস্থা ছিল তা ফিরিয়ে আনাই ছিল এই নীতির মূল লক্ষ্য। এর ফলে ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে রাজতন্ত্র ফিরে আসে।

  • ফ্রান্সে বুরবোঁ রাজতন্ত্র রাজত্ব ফিরে পায়,অষ্টাদশ লুই সিংহাসন লাভ করেন।
  • স্পেন, সিসিলি, ন্যপলস্‌ –এ বুরবোঁ রাজতন্ত্রের আর একটি শাখা রাজত্ব ফিরে পায়।
  • মধ্য ইতালিতে পোপ তাঁর কর্তৃত্ব ফিরে পান।
  • হল্যান্ড অরেঞ্জ বংশের শাসকদের কাছে ফিরে আসে।
  • সার্ডিনিয়া ও পিডমন্টে স্যাভয় বংশের শাসন পুনপ্রতিষ্ঠা পায়।
  • whats-app subscrition_jump-mag

একটা ব্যাপার বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য, এই নীতি কিন্তু সব স্থানে নিরপেক্ষ ছিল না।

জার্মান রাজ্যগুলি কিন্তু তাদের শাসন আর ফিরে পায়নি। বরং সেখানে অস্ট্রিয়ার প্রতিনিধিত্বে 36টি রাজ্য নিয়ে একটি সমবায় রাজ্য বা ‘বুন্দ’ গঠন করা হয়। আবার বেলজিয়ামকে জোর করে হল্যান্ডের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়।

ভিয়েনা সম্মেলনের ফলে রাষ্ট্রগুলির নব নির্মিত সীমানা

 ক্ষতিপূরণ নীতি

নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রধানত চারটি দেশ ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। ভিয়েনা সম্মেলনের ক্ষতিপূরণ নীতির সাহায্যে ইউরোপের বেশ কিছু অঞ্চল তারা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়।

  • অস্ট্রিয়া, উত্তর ইতালির লাম্বার্ডি ও ভেনেশিয়া এবং পোলান্ডের কিছু অংশ অধিকার করে। এছাড়া মধ্য ইতালির পার্মা, মডেনা ও টাস্কেনিতে অষ্ট্রিয়ার শাসকদের প্রত্যাবর্তনের ফলে এই অংশে অস্ট্রিয়ায় প্রভাব বিস্তার লাভ করে।
  • প্রাশিয়া, স্যাক্সনির উত্তরাংশ, পোজেন, থর্ন, ডানজিগ, রাইন অঞ্চল অধিকার করে।
  • রাশিয়া, ফিনল্যান্ড, বেসারাবিয়া এবং পোল্যান্ডের মূল অংশ অধিকার করে। এবং এর ফলে ইউরোপে রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি পায়।
  • ইংল্যান্ড, ইউরোপের বাইরে সামরিক ও বাণিজ্যকেন্দ্র লাভ করে।

শক্তিসাম্য

এই নীতির মূল লক্ষ্য ছিল ফ্রান্স অথবা বিজয়ী কোন দেশ যাতে ভবিষ্যতে শক্তিশালী হয়ে ইউরোপে শান্তিভঙ্গ না করতে পারে। এই নীতি অনুসারে ফ্রান্সের সীমানাকে বিপ্লব পূর্বের অবস্থানে ঠেলে দেওয়া হয়। ফ্রান্সের সৈন্যদল ভেঙে পাঁচ বছরের জন্য মিত্রপক্ষের সেনাদল মোতায়েন করা হয়। এছাড়া ফ্রান্সের চারপাশে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রবেষ্টনী গড়ে তোলা হয়।


নবম শ্রেণির অন্যান্য বিভাগগুলি দেখো –

নবম শ্রেণি – বাংলা | নবম শ্রেণি – ইতিহাস | নবম শ্রেণি – ভূগোল | নবম শ্রেণি – ভৌত বিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – জীবন বিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – গণিত


পরিশেষ

ভিয়েনা সম্মেলন বিশ্বের ইতিহাসে একটি উল্লখযোগ্য ঘটনা। কিন্তু এর নীতি এবং কার্যপ্রণালী ত্রুটিমুক্ত ও নিরপেক্ষ ছিল না।

প্রথমত, এখানে যে নীতিগুলি গৃহীত হয়েছিল সেগুলি মূলত পাঁচটি দেশ যথা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া, প্রাশিয়া এবং অষ্ট্রিয়ার কথা ভেবে নেওয়া হয়েছিল। এতে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলির লাভ হয় নি।

দ্বিতীয়ত, এই নীতিগুলির ক্ষেত্রে বিল্পব বা বিপ্লব পরবর্তী সময়ের আবেগের কথা মাথায় রাখা হয়নি। প্রতিনিধিরা বিপ্লব পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যাবার আপ্রান চেষ্টা করেছিলেন। এটা ছিল সময় বিরুদ্ধ একটি কাজ। এর ফলে ইউরোপজুড়ে পরবর্তী সময়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জন্ম নিয়েছিল।

প্রথম পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → মেটারনিকতন্ত্র এবং ফ্রান্সের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

IX-His-3A