দশম শ্রেণি | বিষয়: ভূগোল । অধ্যায়:বহির্জাত প্রক্রিয়া ও সৃষ্ট ভূমিরূপ (পর্ব -5)
আগের পর্বগুলিতে আমরা নদী দ্বারা সৃষ্ট বিভিন্ন ভূমিরূপ সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এই পর্বে আমরা হিমবাহের কাজের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ সম্পর্কে আলোচনা করবো।
হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ:
করি বা সার্ক (Cirque)
পার্বত্য অঞ্চলে দিনের বেলা বরফ গলা জল পর্বতগাত্রে অবস্থিত ফাটলে প্রবেশ করে। রাতের বেলা তাপমাত্রা কমে গেলে ওই জল জমে বরফে পরিণত হয় এবং আয়তনে বৃদ্ধি পায়। এই জমাট বাঁধা বরফ পাথরের ফাটলটিকে ক্রমশ বড় করে তোলে। সময়ের সাথে সাথে ফাটলটি খুব খাড়া ঢাল যুক্ত অর্ধ গোলাকার গর্তের সৃষ্টি করে, অনেকটা হাতল-ওয়ালা চেয়ারের মত দেখতে হয়। এই অর্ধ গোলাকার গর্তকে ফরাসি ভাষায় সার্ক (Cirque) এবং স্কটল্যান্ডে করি বলা হয়। সার্কের মধ্যে বরফ গলা জল জমে যে হ্রদ সৃষ্টি হয়, তাকে করি হ্রদ বা টার্ন বলা হয়।
পৃথিবীর গভীরতম সার্কটি হল ওয়ালকট সার্ক (3000 মি)।
এরিটি (Arete)
পাশাপাশি অবস্থিত দুটি সার্কের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত উঁচু খাড়া তীক্ষ্ণ শীর্ষ বিশিষ্ট শৈলশিরাকে এরিটি বা অ্যারেট বলা হয়। এরিটির শীর্ষ দেশ করাতের মত এবড়ো খেবড়ো আকৃতির হয়ে থাকে। পাশাপাশি অবস্থিত দুটি সার্ক যখন মস্তক ক্ষয়ের মাধ্যমে প্রসারিত হয় তখন এরিটি গঠিত হয়।
উদাহরণ – হিমালয়ের কারাকোরাম পর্বতে অনেক এরিটি লক্ষ্য করা যায়।
পিরামিড শৃঙ্গ
চারদিক থেকে যখন অনেকগুলো সার্ক মস্তক ক্ষয়ের মাধ্যমে একটি বিন্দুতে মিলিত হয় তখন সেই বিন্দুতে যে শীর্ষ তৈরি হয় হয়, তাকে পিরামিড শৃঙ্গ বলা হয়।
উদাহরণস্বরূপ: নেপালের মাকালু, আল্পসের ম্যাটারহর্ন, বদ্রিনাথের নীলকন্ঠ ইত্যাদি।
কর্তিত স্পার (Truncated Spur)
হিমবাহ যখন পার্বত্য উপত্যকা দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন উভয় পাশের পর্বতের অবক্ষিপ্ত অংশ বা স্পারের সামনের অংশগুলি কেটে উপত্যকাকে আরো চওড়া করে তোলে। এই পল কাটা স্পারগুলোকেই কর্তিত স্পার বলা হয়।
ঝুলন্ত উপত্যকা
কোনো মূল বা বড় হিমবাহের উপর অপেক্ষাকৃত ছোট হিমবাহ গুলি এসে মেসে। এই অবস্থায় মূল হিমবাহটি বেশি শক্তিশালী হওয়ায়, এর উপত্যকাটি অপেক্ষাকৃত নিচে অবস্থান করে এবং উপ-হিমবাহগুলির উপত্যকাগুলি মূল হিমবাহের উপত্যকা থেকে উঁচুতে অবস্থান করে। হিমবাহ অপসারিত হলে এই উপত্যকাগুলিকে মূল উপত্যকার উপর ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে বলে মনে হয়। এদের ঝুলন্ত উপত্যকা বলা হয়। হিমবাহ গলে গেলে এই ঝুলন্ত অগভীর উপত্যকাগুলির মধ্যে দিয়ে নদী প্রবাহিত হয় এবং মূল হিমবাহ উপত্যকার মিলিত হওয়ার বিন্দুতে জলপ্রপাত এর সৃষ্টি করে। রোটাং পাসের কাছে এরকম অনেক ঝুলন্ত উপত্যকা দেখা যায়।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
U আকৃতির উপত্যকা বা হিমদ্রোণি
পার্বত্য অঞ্চলে উপত্যকা দিয়ে হিমবাহ প্রবাহিত হওয়ার সময় নিম্ন ক্ষয় ও পার্শ্ব ক্ষয় সমান ভাবে করতে থাকে, ফলে U আকৃতির উপত্যকা সৃষ্টি হয়। একেই U আকৃতি বিশিষ্ট উপত্যকা বা হিমদ্রোণি বলে। এই উপত্যকার দুই পাশ খাড়া এবং মাঝের অংশ অনেক চওড়া হয়ে থাকে। এই উপত্যকার তলদেশের পাশে সিঁড়ির মত ধাপ দেখা যায়। একে হিম ধাপ বলা হয়। হিম ধাপের নিচের অংশে বরফ গলে যে হ্রদ সৃষ্টি হয় তাকে প্যাটারনস্টার হ্রদ বলা হয়।
হিমবাহের কাজের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপগুলি এই ভিডিও থেকে ভালো ভাবে বুঝে নাও।
রসে মতানে (Roche moutonnée)
হিমবাহের প্রবাহ পথে কোনো শিলা খন্ড, ঢিবির আকারে অবস্থান করলে হিমবাহের প্রবাহ পথের দিকটি হিমবাহ দ্বারা ঘর্ষণের ফলে মসৃণ হয়ে ওঠে ও অন্য দিকটা অমসৃণ ও এবড়ো খেবড়ো ভাবে অবস্থান করে। সম্পূর্ণ ভূমিরূপটি অপ্রতিসম হয়ে থাকে। একেই রসে মতানে বলা হয়।
এরকম অনেক রসে মতানে নরওয়ের টলমট্রিনজেন পর্বতে দেখা যায়।
ক্রাগ অ্যান্ড টেল (crag and tail)
হিমবাহের প্রবাহ পথে কোন কঠিন শিলা খন্ডের উপস্থিতি থাকলে তা হিমবাহের ক্ষয় থেকে পিছনের কোমল শিলাকে রক্ষা করে। এর ফলে কঠিন শীলা খন্ডটির পিছনে কোমল শিলা ক্ষয় প্রাপ্ত না হয়ে লেজের আকারে অবস্থান করে ও কঠিন শীলা খন্ডটি উচু ঢিপির মতো অবস্থান করে। এই ঢিপির মত অংশ টিকে ক্র্যাগ ও পিছনের লেজের মত অংশটিকে টেল বলা হয়। স্কটল্যান্ডে এরকম অনেক ভূমিরূপ দেখা যায়।
ফিয়র্ড (Fiord)
হিমবাহ দ্বারা কর্তিত উপত্যকা যখন সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়ে যায়, তখন থাকে ফিয়র্ড বা ফিয়ার্ড বলা হয়। উচ্চ অক্ষাংশতে হিমবাহ উপত্যকাকে গভীরভাবে ক্ষয় করে, সমুদ্র পৃষ্ঠের নিচে অব্দি ক্ষয়কার্য করে থাকে। হিমবাহ যখন উপত্যকা থেকে অপসারিত হয় তখন এই উপত্যকা গুলি জলে ভরে যায়। এই নিমজ্জিত উপত্যকাগুলিই ফিয়র্ড বা ফিয়ার্ড সৃষ্টি করে। ছোটগুলি ফিয়ার্ড ও বড় উপত্যকাগুলি ফিয়র্ড নামে পরিচিত। ফিয়র্ডের গভীরতা প্রায় 300 মিটার অব্দি হয়ে থাকে। নরওয়েতে এরকম অনেক ফিয়র্ড দেখা যায়, তাই নরওয়েকে ফিয়র্ডের দেশ বলা হয়।
হিমবাহের সঞ্চয় কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ
গ্রাবরেখা (Moraine)
হিমবাহের প্রবাহ পথের পাশে হিমবাহ দ্বারা বাহিত নুড়ি, কাঁকর, বালি, কাদা হিমবাহের গলনের কারণে হিমবাহের প্রবাহ পথের বিভিন্ন অংশে অসংলগ্ন ভাবে সঞ্চিত হলে, তাকে গ্রাবরেখা বা মোরেন বলা হয়। গ্রাবরেখাকে তার অবস্থান অনুযায়ী চার ভাগে ভাগ করা যায়।
- হিমবাহের দুই পাশে অবস্থিত গ্রাবরেখাকে পার্শ্ব গ্রাবরেখা বলা হয়।
- হিমবাহ দ্বারা বাহিত পদার্থ হিমবাহের অগ্রভাগে সঞ্চিত হলে তাকে প্রান্ত গ্রাবরেখা বলা হয়।
- দুটি হিমবাহ পাশাপাশি মিলিত হলে তাদের মাঝে অবস্থিত সরু গ্রাবরেখাকে মধ্য গ্রাবরেখা বলা হয়।
- হিমবাহের তলদেশে বরফ গলে সঞ্চিত পদার্থ যে গ্রাবরেখা সৃষ্টি করে তাকে ভূমি গ্রাবরেখা বলা হয়।
এরকম অনেক গ্রাবরেখা নরওয়ে, সুইডেন, উত্তর পশ্চিম ইউরোপ, পোল্যান্ড ও কানাডায় দেখা যায়।
ড্রামলিন (Drumlin)
হিমবাহ দ্বারা বাহিত পাথর, কাঁকর, বালি, কাদা সারিবদ্ধ ভাবে উল্টানো চামচের মতো সঞ্চিত হলে, তাকে ড্রামলিন বলা হয়। ড্রামলিন এর হিমবাহের দিকের অংশ মসৃণ ও বিপরীত দিকটা অমসৃণ হয়ে থাকে। একসাথে অনেকগুলো ড্রামলিন অবস্থান করলে ডিম ভর্তি ঝুড়ির মত দেখতে লাগে। তাই একে ডিমের ঝুড়ি ভূমিরূপও বলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরভাগ আয়ারল্যান্ড এর উত্তরভাগে এই রকম ভূমিরূপ দেখা যায়।
রসে মতানে ও ড্রামলিন দেখতে অনেকটা একই রকম হলেও দুটি ভিন্ন উপায়ে সৃষ্টি হয়। রসে মতানে ক্ষয়ের ফলেও ড্রামলিন সঞ্চয়ের ফলে সৃষ্টি হয়। রসেমতানে পার্বত্য অঞ্চলে গঠিত হয় ও ড্রামলিন পর্বতের পাদদেশে সৃষ্টি হয়।
হিমবাহ ও জলধারার মিলিত সঞ্চয় কাজের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ
হিমরেখার নিচে হিমবাহ গলে গিয়ে অনেক ছোট ছোট জলধারা সৃষ্টি হয়, যার ফলে হিমবাহ দ্বারা বাহিত পদার্থ গুলি অনেক দূর বিস্তৃত হয়। একেই হিমবাহ ও জলধারার মিলিত সঞ্চয় কার্য বলা হয়। এই মিলিত সঞ্চয় কার্যের ফলে গঠিত ভূমিরূপগুলি নিম্নে আলোচিত হল।
কেম (Kame)
হিমবাহ গলতে শুরু করলে উপত্যকার নিচের অংশের মাঝখানে হিমবাহ বাহিত পদার্থগুলি সঞ্চিত হয়ে উচু নিচু ঢিবির সারি সৃষ্টি হয় কেম বলা হয়। কেম দেখতে ত্রিকোণাকার হয়। কেম পরস্পর যুক্ত হয়ে সোপান-এর মত ভূমিরূপ এর সৃষ্টি করে একে কেম সোপান বলা হয়। আমেরিকার উচ্চ অক্ষাংশতে এরকম অনেক ভূমিরূপ দেখা যায়।
এসকার (Esker)
পর্বতের পাদদেশে হিমবাহ বাহিত পদার্থ স্তরায়িত হয়ে যে আঁকাবাঁকা শৈলশিরা সৃষ্টি করে তাকে এসকার বলা হয়। সুইডেন ও ফিনল্যান্ডে এরকম অনেক এসকার দেখা যায়। এগুলো লম্বায় 400 কিমি, চওড়ায় 3কিমি ও উচ্চতায় 200 মিটার হতে পারে।
বহিঃবিধৌত সমভূমি (Out-Wash-Plain)
পর্বতের পাদদেশে হিমবাহ গলে হিমবাহ বাহিত পদার্থ যেমন – পাথর, কাঁকর, বালি, কাদা নিচু স্থানগুলো ভরাট করে যে সমভূমি গড়ে তোলে, তাকে বহিঃবিধৌত সমভূমি বলা হয়। আইসল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডে এরকম সমভূমি দেখা যায়।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
কেটল
বহিঃবিধৌত সমভূমি অঞ্চলে বরফের চাঁই চাপা পড়ে যায়, পরে ওই বরফ গলে সেই ফাঁকা অংশে গর্তের সৃষ্টি করে। একেই কেটল বলা হয়। এই গর্তে জল জমে হ্রদ সৃষ্টি হলে তাকে কেটল হ্রদ বলা হয়। কেটলের তলদেশে পলি সঞ্চিত হলে, তাকে ভার্ব বলা হয়।
পঞ্চম পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → বায়ুর কাজের ধারণা
লেখিকা পরিচিতি
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রাক্তনী শ্রেয়সী বিশ্বাস। পড়াশোনা এবং লেখালিখির পাশাপাশি, ছবি আঁকা এবং বাগান পরিচর্যাতেও শ্রেয়সী সমান উৎসাহী।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X-Geo-1-e