যদি তোমাকে বলা হয়, কাল সকালে উঠে তুমি দেখো, তুমি এমন কিছু একটা করে ফেলেছো নিজের অজান্তে, লোকে তোমাকে ডেকে নোবেল প্রাইজ দিচ্ছে, তোমার কাছে সেটা স্বপ্নের মতন ঠেকবে; তাই না!
ভেবে দেখো সত্যি সত্যি এইরকম হওয়ার সম্ভাবনা কতটা?
এর উত্তর – কয়েক শো কোটিতে একবার; ভাবছো এতো নিশ্চিত হয়ে কীভাবে বলছি?
কারণ, এই সম্ভাবনার অঙ্কটা আমরা জানি। এইরকম ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে; গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে, সুইডেনের স্টকহল্মে, এক জার্মান সাহেবের সাথে।
একটি ঘটনা
বাচ্চা জার্মান ছেলেটির আজ পাঁচ বছরের জন্মদিন। এই খুশির দিনে সে যেন আজ অভিভূত। তার এই বিষ্ময়কর অবস্থার জন্য দায়ী তার বাবার দেওয়া উপহার। জার্মানির বাসিন্দা হেরমান তাঁর ছেলেকে জন্মদিনে উপহার দিয়েছেন একটি চুম্বক কম্পাস। তার তাতেই অবাক ছোট্ট ছেলেটি; উপহারটা হাতে পাওয়া থেকেই সে ভেবে চলেছে এই কাঁটা ঘুরছে কিভাবে! কি শক্তি কাজ করছে এর পেছনে?
আরো একটি ঘটনা
সেই তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হতে মাত্র এক মাস বাকি। কেউ কল্পনাও করতে পারছে না আগামী 30 দিনে কি পরিবর্তন হতে চলেছে। আমেরিকা বেশ মজায় আছে, তারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় অংশ না নিয়েও যুদ্ধের লাভের বখরার অধিকাংশ গ্রহণ করেছে তারা।
ইতিমধ্যে মার্কিন রাজনীতিতে রিপাবলিকান দলের একচেটিয়া রাজনীতির অবসান ঘটে পালাবদল হয়েছে। লোকে দলে দলে ইউরোপ ছেড়ে আমেরিকায় পালিয়ে যাচ্ছে। ততদিনে বাচ্চা জার্মান ছেলেটি পুরদস্তুর সাহেব হয়ে গেছেন এবং স্বদেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছেন আমেরিকায়।
একদিন সেই জার্মান সাহেবের একটি চিঠি পেয়ে নড়েচড়ে বসলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। নিজের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ব্যক্তিকে ডেকে বললেন “Pa! this requires action!” শতাব্দীর সেরা নির্দেশ।আর শতাব্দীর সবথেকে বিখ্যাত আবিষ্কার যজ্ঞ শুরু হলো তারপর। মজার বিষয়, সেই জার্মান সাহেবেরই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে সেই আবিষ্কার, আর সেই জার্মান সাহেবই হলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি আমেরিকার মাটিতে উপস্থিত থেকেও সেই আবিষ্কারের আবিষ্কর্তার দলে অনুপস্থিত।
হ্যাঁ, এই গল্পটি সেই জার্মান সাহেবের। সেই জার্মান সাহেব, যার কাছে প্রকৃতির গঠন মানেই গণিতের গঠন। মাত্র 12 বছর বয়সেই তিনি রপ্ত করে ফেলেছিলেন আলজেব্রা আর ইউক্লিডের জ্যামিতি। পিথাগোরাসের উপপাদ্যের প্রমাণ দেখা ছাড়াই মৌলিকভাবে তিনি সেটার প্রমাণ করেছিলেন সেই 12 বছর বয়সে। আর দু বছরের মধ্যে ক্যালকুলাস চলে আসে তার নখদর্পণে (কোন সাহায্য ছাড়াই)।
এই জার্মান সাহেবের আমাদের কাছে একটি অতি পরিচিত নাম। আমাদের মধ্যে অনেকই হয়তো বিজ্ঞানের ছাত্র নয় বা ওনার কাজের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ হয়নি কিন্তু ওনার ঋষি তুল্য ছবি দেখেননি বা ওনার আবিষ্কৃত ভর – শক্তির নিত্যতা সুত্র E= mC2 এই সূত্রটি জীবনে শোনেননি এইরকম মানুষ বোধহয় পাওয়া খুবই দুস্কর।
হ্যাঁ। ইনিই অ্যালবার্ট আইনস্টাইন।
এঁর জন্য নোবেল পুরষ্কার কম পড়েছিল।
এঁর জন্য নিউটনের প্রায় সমস্ত আবিষ্কার মিথ্যে হয়ে গিয়েছিলো একঝটকায়।
ভাবছেন কি ভাবে?
১৯০৫ সালে তাঁর প্রকাশিত চারটি পেপারের একটি ছিল আলো নিয়ে। এখানে তিনিই প্রথবার আলোকে তরঙ্গ নয়, কণা বলে প্রমাণ করেন। পরে তিনি দেখান যে আলো সরলরেখায় চলে না, ভারী জিনিসের কাছে গেলেই বেঁকে যায়। আর সেই সঙ্গে এটাও প্রমাণ করেন গ্র্যাভিটি কোনো বল নয়, ক্ষেত্র মাত্র।
আর দুটি বস্তু পরষ্পরকে আকর্ষণ করে না, তাদের ভরের জন্য গ্র্যাভিটি ক্ষেত্রের চাদরে বাঁকের সৃষ্টি হয়, তাতেই এক বস্তু অন্য বস্তুর দিকে ধেয়ে আসে। এই সব কটি প্রমাণ তৎকালীন বৈজ্ঞানিকদের ভিত নাড়িয়ে দেয়।
প্রথম দিকের কথা
অসামান্য মেধার অধিকারী আইনস্টাইন সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় মোটেও পারদর্শী ছিলেন না। জুরিখ পলিটেকনিক থেকে ডিগ্রি পেয়ে আইনস্টাইন প্রায় দুই বছর শিক্ষকতা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোন রকমভাবে সুবিধা না করতে পেরে কাজ নেন পেটেন্ট অফিসের ক্লার্ক হিসাবে সেখানে কাজ করতে করতেই তিনি Capillari Action এর ওপর তাঁর প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। শোরগোল পড়ে যায় সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানী মহলে। এরপর 1905 সালে তিনি Moleculer Dimension এর ওপর থিসিস জমা করেন, যার জন্য তাঁকে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করে জুরিখ ইউনিভার্সিটি।
আমরা আগেই বলেছিলাম সেই বছরেই তার চারটি যুগান্তকারী আবিষ্কার প্রকাশিত হয়।
১. আলোর কণাধর্ম বর্তমান, সেও ইলেকট্রনকে লাথি মেরে তাড়াতে পারে (ভরবেগের নিত্যতা সূত্র অগ্রাহ্য)
২. ব্রাউনিয়ান গতি
৩. ভর ও শক্তির নিত্যতা সূত্র (বিখ্যাত E= mC2)
৪. বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ (যেখান থেকে তিনি আলোর গতির ধারণা দেন)।
এরপর 1916-17য় তিনি আরও আবিষ্কার করেন সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ ও অণুর গতিতত্ত্বের অংশবিশেষ। বিখ্যাত ভারতীয় বৈজ্ঞানিক সত্যেন বোসকে সাথে করে আবিষ্কার করে ‘বসেন’ বোস সংখ্যায়ন, তখন যার নাম ছিল বোস আইনস্টাইন সংখ্যায়ন।
[আরো পড়ুন – সত্যেন্দ্র নাথ বসু]
1933 সালে হিটলারের অত্যাচারী জার্মানি থেকে চলে যান আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াতে, California Institute of Technology তে প্রফেসরের চাকরির জন্য। সেখানে থাকতেই তিনি বুঝতে পারেন হিটলারের ভয়ানক উচ্চকাঙ্খার কথা। তাঁকে রিফিউজি ঘোষণা করে রুজভেল্টের আমেরিকা সরকার।
ইউরোপের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোরালো হতে থাকে, আর বিজ্ঞানও সেই সময় তালে তালে এগোতে থাকে। জার্মান বিজ্ঞানী অটো হান বিদীর্ণ করেন পরমাণুর হৃদয়, কৃত্রিম তেজষ্ক্রিয়তার সাহায্যে। আর সেখান থেকে ভর নষ্ট হয়ে যে শক্তি উদ্ভূত হয়, তা প্রমাণ করে তার সেই বিখ্যাত বিখ্যাত E= mC2।
বিজ্ঞানীমহলের ধারণা হয় হিটলার এবার পরমাণু বোমা বানাতে চলেছেন।
লিও ৎজিলার্ড নামে একজন হাঙ্গেরিয়ান বিজ্ঞানী আইনস্টাইনকে অনুরোধ করেন আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে একটা চিঠি লিখতে যাতে তিনি এর জন্য একটা বিশেষ প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেন। আইনস্টাইন তখন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে একটা চিঠি লেখেন যা আইনস্টাইন-ৎজিলার্ড পত্র নামে খ্যাত। জন্ম হয় প্রজেক্ট Manhattan এর, জন্ম হয় পরমাণু বোমার। জন্ম হয় মানব সভ্যতার সবচেয়ে ভয়ংকর মারণাস্ত্রের।
কিন্তু পৃথিবী কি আইনস্টাইনকে শুধু পরমাণু বোমার জন্য মনে রেখেছে?
এর উত্তর হল – না।
বিখ্যাত পত্রিকা টাইমস এবং বহু বিজ্ঞানীর মতে আইনস্টাইন হলেন গত শতাব্দীর সেরা বিজ্ঞানী। গত শতাব্দীর বহু বরেণ্য বৈজ্ঞানিক থাকা সত্ত্বেও আইনস্টাইন তাদের মধ্যে স্বতন্ত্র।
তিনি ছিলেন কল্পবিলাসী একজন মানুষ যিনি তাঁর কল্পনাকে অঙ্কের রূপে রূপান্তরিত করার ম্যাজিক করায়ত্ব করেছিলেন।
তিনি ছিলেন এক ছক ভাঙ্গা মানুষ।
যিনি ভারতের মতো একটা পরাধীন দেশের একজন অখ্যাত মানুষের লেখা চিঠিকে অনায়াসে পৃথিবীর দর্পণে মুক্তো হিসাবে তুলে ধরতে পারেন। যিনি অনায়াসে ভায়োলিনের ছড়ে সুরের ঝড় তুলতে পারেন। যিনি সমাজের তথা রাজনীতির কথা বেপরোয়া ভাবে বলতে পারেন, আবার তিনি অসামান্য দক্ষতায় সময়ের পথ বাঁকিয়ে দিতে পারেন। তাই তিনি শুধু একজন বৈজ্ঞানিক নন, তিনি বিজ্ঞানের একটি প্রতীক।
বিজ্ঞানের ইতিহাস বিভাগের অন্যান্য লেখাগুলি পড়ুন।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা