বাংলা – একাদশ শ্রেণি – বাঙালির শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি (তৃতীয় অধ্যায়)
এর আগে বৈষ্ণব পদাবলী সম্পর্কে আলোচনা করেছি, এই পর্বে আমরা চৈতন্যদেবঃ বাঙালি সমাজ ও সাহিত্যে চৈতন্যপ্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করবো।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আলোচনার একেবারে শুরুর দিকে বলেছিলাম একটা কথা বলেছিলাম বন্ধুরা মনে আছে? কী কথা? এটাই বলেছিলাম যে, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস জানতে হলে বা পড়তে হলে দুটি মৃত্যু খুব গুরুত্ব সহকারে মনে রাখতে হবে।
প্রথমত ভারতচন্দ্রের মৃত্যু আর দ্বিতীয়ত শ্রীচৈতন্যদেবের মৃত্যু।
ভারতচন্দ্রকে নিয়ে আলোচনার সময় তাঁর মৃত্যু ঠিক কেন অর্থবহ সে কথা বলেছিলাম। এবারে আমরা আজকের ক্লাসে সম্পূর্ণটাই আলোচনা করবো শ্রীচৈতন্যকে নিয়ে। নিশ্চয়ই ভাবছো যে চৈতন্য তো আদ্যন্ত একজন আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ, ফলে সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসে তাঁর গুরুত্বই বা কী? আসলে চৈতন্যের অবদান শুধু ধর্মীয় ভাবান্দোলনের সঙ্গে যে জড়িয়ে আছে তা নয়। এমন একটা যুগসন্ধিক্ষণে তাঁর আবির্ভাব আর প্রয়াণ ঘটেছিল যে তা বাংলার মধ্যযুগীয় সমাজকে অনেকাংশে বদলে দিতে সহায়তা করেছিল।
চৈতন্যদেবের চিন্তা-চেতনা, সমাজকে একসূত্রে গ্রথিত করার ভাবনা এবং চিত্তশুদ্ধির পথ দেখানোর মধ্য দিয়ে সামাজিক ভেদাভেদ, সংকীর্ণতা ক্রমে ক্রমে দূর হয়ে যাচ্ছিল। আর চৈতন্যদেবের প্রয়াণের পর তো সমাজের চেহারা যেমন বদলালো, সাহিত্যের গতিপথও খানিক বদলে গিয়েছিল। বলা ভালো বাংলা সাহিত্যের ধারায় এক নতুন সংযোজন হয়েছিল যাকে বলা হয় চৈতন্য-জীবনী কাব্য।
আজকের আলোচনায় এইসব নিয়েই আমরা আরো বিস্তারে জানবো। তাহলে চলো আজকের ক্লাস শুরু করা যাক।
একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল
শুরুতেই বলে রাখি। সমগ্র আলোচনাটিকে আমরা তিনটি ভাগে ভাগ করে নেবো।
প্রথমত আমরা জেনে নেবো শ্রীচৈতন্যদেবের সংক্ষিপ্ত জীবনী, তারপর বাংলা সমাজ-সংস্কৃতিতে তাঁর আবির্ভাবের প্রভাব সম্পর্কে দু-চার কথা জানবো এবং সবার শেষে থাকবে বাংলা সাহিত্যে তাঁর আবির্ভাবের প্রভাব ঠিক কেমন ছিল তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা।
প্রথমে আমরা জেনে নিই শ্রীচৈতন্যের জীবনী।
শ্রীচৈতন্যদেবের সংক্ষিপ্ত জীবনী
১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে (বাংলা ৮৯২ সাল) নদীয়া জেলার নবদ্বীপে চৈতন্যের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম ছিল জগন্নাথ মিশ্র এবং মায়ের নাম ছিল শচীদেবী। বাল্যকালে তাঁর ডাকনাম ছিল গোরা, গৌরাঙ্গ তথা গৌরহরি।
তাঁর উজ্জ্বল গায়ের রঙ দেখেই তাঁর মা শচীদেবী এই নাম রেখেছিলেন। আবার একটি নিম গাছের নিচে শচীদেবীর কোলে চৈতন্যের জন্ম হয়েছিল বলে তাঁকে নিমাই বলেও ডাকা হত। যদিও তাঁর আসল নাম ছিল বিশ্বম্ভর মিশ্র।
চৈতন্যের জীবনীকার জয়ানন্দের মতে, জগন্নাথ মিশ্রের পূর্বপুরুষরা উড়িষ্যার জাজপুরের অধিবাসী ছিলেন এবং সেখানে রাজরোষে পড়ে বাধ্য হয়ে স্থান ত্যাগ করে তাঁরা এসে ওঠেন শ্রীহট্টে। কিন্তু তুর্কি আক্রমণের পরে দুর্ভিক্ষ, মড়ক, অনাবৃষ্টির কারণে শ্রীহট্টের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। ফলে তাঁরা আবার সেই স্থান ত্যাগ করে নবদ্বীপে চলে আসেন। কিন্তু অনেকেই এই মত মানতে চান না।
বলা ভালো চৈতন্যকে কেন্দ্র করে আজও সমগ্র বাংলায় বহু বিতর্ক দানা বেঁধে আছে। শ্রীচৈতন্যের দাদা বিশ্বরূপ পড়তেন অদ্বৈত আচার্যের টোলে এবং সেখানে অধ্যয়ন করে সংসারের মায়া ত্যাগ করে তিনি গৃহত্যাগ করেন। নিমাইও যাতে এভাবে সংসার ত্যাগ করে চলে যেতে না পারেন, তাই জগন্নাথ মিশ্র তাঁকে টোলে পাঠাতেই চাননি। কিন্তু পড়াশোনা করার অদম্য জেদ ছিল নিমাইয়ের। আর অন্যদিকে শচীদেবীর অনুরোধে-উপরোধে নিমাইকে ভর্তি করা হয় গঙ্গাদাসের টোলে।
বাল্যকালে নিমাই ছিলেন অত্যন্ত দুরন্ত। নবদ্বীপবাসীরা তাঁর দুরন্তপনায় অস্থির হয়ে শচীদেবীর কাছে এসে নালিশ জানাতেন। কিন্তু অন্যদিকে নিমাই ছোটবেলা থেকেই খুবই মেধাবীও ছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই নিমাই নানা শাস্ত্রে জ্ঞান লাভ করে মহাপণ্ডিত হয়ে ওঠেন এবং মাঝে-মধ্যেই তিনি নবদ্বীপের নানা ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতদের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হতেন আর বেশিরভাগ সময় তর্কে জিততেন নিমাই। নিজের বিদ্যাশিক্ষা সম্পূর্ণ করে তিনি নবদ্বীপে একটি চতুষ্পাঠী খুলে বসেন।
একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer
দেশ-দেশান্তর থেকে তাঁর কাছে আগ্রহী শিক্ষার্থীরা পড়তে আসেন। সেকালের বিখ্যাত তার্কিক কেশব কাশ্মীরকেও নিমাই পরাস্ত করেন। ইতিমধ্যে তাঁর বাবা জগন্নাথ মিশ্র মারা যান এবং বল্লভাচার্যের কন্যা লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। কিছুদিনের মধ্যেই সর্প দংশনে লক্ষ্মীদেবীর মৃত্যু হয়। মা শচীদেবীর অনুরোধে দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন নিমাই। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী।
কিন্তু সংসারে আর মন ছিল না তাঁর। গয়াধামে বাবার পিণ্ডদান করতে গিয়ে ঈশ্বরপুরীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তাঁর কাছেই গোপাল-মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে নবদ্বীপে ফিরে আসেন নিমাই পণ্ডিত। নবদ্বীপে ফিরে এসে টোল-চতুষ্পাঠী সব ছেড়ে দিয়ে নিমাই হরিভক্তদের নিয়ে কৃষ্ণনাম সংকীর্তনে মেতে ওঠেন। ক্রমেই আধ্যাত্মিক ভাব প্রগাঢ় হয়ে ওঠে তাঁর জীবনে।
কাটোয়ার কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষা নিয়ে সংসারের মায়া ত্যাগ করেন নিমাই। এই সময় তাঁর নতুন নাম হয় শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য।
শান্তিপুরে সন্ন্যাস নেওয়ার পরে কিছুদিন থেকে চারজন সঙ্গী নিয়ে চৈতন্য যাত্রা করেন পবিত্র পুরী ধামের দিকে। তাঁর দুই শিষ্য অদ্বৈত আচার্য এবং নিত্যানন্দের উপর চৈতন্য সমগ্র বাংলায় বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের দায়িত্ব অর্পণ করেন। ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে পুরীতেই মৃত্যু হয় চৈতন্যদেবের। তবে আজ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি।
এবারে আমরা চলে আসি বাংলার সমাজ ও সাহিত্যে শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাব বিষয়ে আলোচনায়। প্রথমে দেখা যাক চৈতন্যদেবের আবির্ভাব ও কর্মকাণ্ডের ফলে বাংলার সমাজে কী কী পরিবর্তন এসেছিল এবং বাংলার সংস্কৃতিতেই বা কী বদল এসেছিল।
বাংলার সমাজ-সংস্কৃতিতে শ্রীচৈতন্যের প্রভাব
• একদিকে তুর্কী আক্রমণের পরবর্তী সময়ে ইসলামি প্রভাবে আচ্ছন্ন বাংলায় হিন্দু-পুনর্জাগরণের এক নতুন অধ্যায় সূচিত করেছিলেন শ্রীচৈতন্য।
• হিন্দু সমাজে সুপ্রাচীন যে অস্পৃশ্যতা, সংকীর্ণতার আবহ ছিল, তা থেকে শ্রীচৈতন্য সমস্ত বাংলার মানুষকে মুক্তির পথ দেখান। ‘চণ্ডালোহপি দ্বিজশ্রেষ্ঠ হরিভক্তিপরায়ণঃ’, এই বার্তা নিয়ে নিম্নবর্ণের মানুষদের সঙ্গে উচ্চবর্ণের মানুষদের বিভেদ ঘুচিয়ে দেন তিনি। সমাজতত্ত্বের ভাষায় একেই ‘বর্গ সম্মিলন’ বলা চলে।
• ভিন্ন ধর্ম বা সম্প্রদায়ের প্রতি মমত্ববোধ ও সহিষ্ণুতার শিক্ষা দিয়েছিলেন তিনি।
• অসাম্য, বিভেদ, অনাচার, কুসংস্কারের বেড়াজালকে ছিন্ন করে শ্রীচৈতন্য এক সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন।
• বাঙালি সমাজে ভক্তি আন্দোলনের প্রথম উদ্গাতা বলা হয় শ্রীচৈতন্যদেবকে। মানবতা আর প্রেমের বাণী প্রচারের মধ্য দিয়ে বিচ্ছিন্ন বাঙালি সমাজকে একসূত্রে গ্রথিত করেছিলেন তিনি।
একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি
বাংলা সাহিত্যে শ্রীচৈতন্যের প্রভাব
চৈতন্যদেব নিজে কেবলমাত্র রচনা করেছিলেন ‘শিক্ষাষ্টক’ নামের একটি গ্রন্থ, কিন্তু তাঁর আবির্ভাব বাংলা সাহিত্যের দিকনির্দেশ আমূল বদলে দিয়েছিল।
• চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের ফলে বাংলার বৈষ্ণব সাহিত্য তথা বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের অঙ্গনে এক পরিবর্তন ঘটে। চৈতন্য-পূর্ব বৈষ্ণব কবিদের রচনায় কৃষ্ণ-রাধার প্রেমলীলার বর্ণনা থাকলেও তা বৈষ্ণবীয় তত্ত্বের আধারে গড়ে ওঠেনি। চৈতন্যের আবির্ভাবের ফলেই তৈরি হয় বৈষ্ণবীয় তত্ত্ব যাকে ভক্তিরসতত্ত্ব বলা হয় আর এই তত্ত্বের প্রভাব পড়ে চৈতন্যের পরবর্তী বৈষ্ণব কবিদের রচনাতেও। সে কারণেই চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতির রচনার থেকে জ্ঞানদাস, বলরামদাস কিংবা গোবিন্দদাসের পদগুলির মাহাত্ম্য অন্যতর।
• চৈতন্যের আবির্ভাব না ঘটলে বাংলা সাহিত্যে ‘গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ’ কিংবা ‘গৌরচন্দ্রিকা’ নামক ধারাটির উদ্ভবই ঘটতো না।
• তাঁর আবির্ভাবের কারণেই বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য-জীবনী কাব্যের এক নতুন ধারা গড়ে ওঠে। বৃন্দাবনদাসের ‘শ্রীচৈতন্যভাগবত’, লোচনদাসের ‘চৈতন্যমঙ্গল’, কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ ইত্যাদি জীবনী-কাব্য লেখা হয় তাঁর মৃত্যুর পরে।
• অনুবাদ কাব্য, মঙ্গলকাব্য, শাক্ত পদাবলী ইত্যাদি সাহিত্যের সমস্ত ধারাতেই তাঁর মৃত্যুর পর থেকে বৈষ্ণবীয় প্রেমভাবনার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়।
পর্ব সমাপ্ত।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লেখক পরিচিতি
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
XI_Beng_modhyojug_Somaj_sahityo_13