ouponibeshik-varoter-poribohon-bybostha
WB-Class-8

ঔপনিবেশিক অর্থনীতির চরিত্র | পরিবহণ ব্যবস্থা | অষ্টম শ্রেণি চতুর্থ অধ্যায় – তৃতীয় পর্ব

শ্রেণিঃ অষ্টম | বিষয়: ইতিহাস । অধ্যায় – ঔপনিবেশিক অর্থনীতির চরিত্র (চতুর্থ অধ্যায়)

আগের পর্বে আমরা আলোচনা করেছিলাম, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কি ভাবে ঔপনিবেশিক রাজস্ব ব্যবস্থাকে দক্ষ হাতে গড়ে তুলেছিল। আজকের পর্বে আমরা জানব সেই সময় ভারতে শিল্প ও বাণিজ্যের কি অবস্থা ঘটেছিল।

ভারতের পরিবহণ ব্যবস্থায় আধুনিকীকরণ যে ব্রিটিশদের হাত ধরে হয়েছিল, সেই বিষয়ে যেমন কোনো সন্দেহ নেই তেমনই এই পরিবহণ ব্যবস্থার মধ্যে দিয়েই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পৌঁছে গিয়েছিল দেশের সর্বত্র।

ভারতের পরিবহণ ব্যবস্থার কথা আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই আসে রেলব্যবস্থার কথা।

1853 খ্রিষ্টাব্দে লর্ড ডালহৌসির সময়ে ভারতে বোম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত রেললাইন বসানো হয়।

তবে তোমাদের মনে হতে পারে, যে বাহ্‌ ইংরেজরা খুব ভালো তো, কি সুন্দর আমাদের দেশের উন্নতির জন্য রেলব্যবস্থা শুরু করেছিল।
কিন্তু বিষয়টা এতটা সরল নয়।

শাসক ইংরেজরা মোটেই এদেশের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধির জন্য এটা করেনি, করেছিল বেশ কিছু স্বার্থসিদ্ধি করতে, চলো জেনে নিই,

প্রথমত, দেশের ভিতরে সব জায়গায় তারা পৌঁছতে, যাতে তারা সেই সব স্থানে ইংল্যান্ডে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারে, অর্থাৎ আরো সোজা ভাষায় বলতে গেলে দেশীয় বাজার গ্রাস করার জন্য।
দ্বিতীয়ত, ভারত বিশাল দেশ। কোনো এক স্থান থেকে সমগ্র দেশ শাসন করা সম্ভব নয়। তাই রেলপথের বিস্তার গোটা ভারতবর্ষে তাদের শাসন বিস্তারে এবং শাসনকার্য পরিচালনা করতে সহায়তা করবে।
তৃতীয়ত, দেশের বিভিন্ন স্থানে সেনা প্রেরণ করার জন্য দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন ছিল।

রেলব্যবস্থার প্রভাব

এই রেলপথ বিস্তারের মাধ্যমে একদিকে যেমন ইংল্যান্ডে উৎপাদিত পণ্য এদেশে খুব কম দামে বিক্রি করা হত, আবার অন্যদিকে বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানি যারা রেলপথ নির্মাণের সাথে যুক্ত ছিল তাদেরকেও রাজস্বের একটা মোটা অর্থ দেওয়া হত। এইভাবে উভয় দিক দিয়ে এই রেলব্যবস্থা প্রাথমিকভাবে ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক ক্ষতি করেছিল। 1858 থেকে 1859 এর মধ্যে প্রায় ৭ কোটি পাউন্ডের বেশি মূলধন এই রেলপথ নির্মাণে খরচ হয়েছিল।

ভারতীয় রেলব্যবস্থা

তবে এই কথা স্বীকার করতেই হয়, ব্রিটিশদের এই উদ্যোগ বৃহত্তর দিক থেকে ভারতীয়দের সাহায্যই করেছিল। ভারত বিশাল দেশ, এক প্রান্তের মানুষের খবর অন্য প্রান্তে সেই অর্থে পৌঁছতো না, কিন্তু এই রেলপথের সূচনা ভারতবাসীর মধ্যেকার এই দুরত্বের তফাৎ মুছে দিয়েছিল। ভারতীয়রা ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে, জাতীয়তাবাদী চেতনা, বৈপ্লবিক ভাবনা, শিক্ষা সংস্কৃতির আদান-প্রদানের দ্বারা দেশবাসী সমৃদ্ধ হয়, যা ব্রিটিশ শাসনের উৎখাতে বিশেষ সহায়তা করেছিল।

টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার বিকাশ

উনবিংশ শতকে রেলপথের সূচনার পাশাপাশি টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার বিকাশ, যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরো আধুনিক ও সুবিধাজনক করে তুলেছিল। ভারতে মূলত ডাকহরকরারা (রানার-রা) দ্রুত গতিতে ছুটে ছুটে একস্থান থেকে অন্যস্থানে সংবাদ, চিঠি ইত্যাদি পৌঁছে দিত।

1851 খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ভারতে টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা চালু হয়।

কিছু মাইল অঞ্চল জুড়ে সেই সময় এই টেলিগ্রাফ যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। কিন্তু এরপর মাত্র ৪-৫ বছরের মধ্যে 1856 সালে এই টেলিগ্রাফের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৬। কলকাতা, আগ্রা, বোম্বাই, মাদ্রাজ প্রভৃতি শহরগুলি প্রাথমিকভাবে এর আওতায় এসেছিল।

টেলিগ্রাফের প্রভাব

টেলিগ্রাফ আবিস্কারের ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারে বেশ কিছু সুবিধা হয়েছিল,
যেমন, এই টেলিগ্রাফের মাধ্যমে দ্রুত খবর প্রেরণ করা যেত, যার ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কোথাও কোনো সমস্যা হলেই ব্রিটিশরা দ্রুত জানতে পারত এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সিপাহি বিদ্রোহ দমনে এই টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা অনেক সাহায্য করেছিল।

টেলিগ্রাফ

তবে, এইক্ষেত্রেও ব্রিটিশ শাসকরা শাসনকার্য পরিচালনা করার জন্য করার টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার উদ্ভাবন করলেও আধুনিক এই যোগাযোগ ব্যবস্থার সুফল খুব দ্রুতই ভারতীয়দের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। যা ভারতবাসীকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে সাহায্য করেছিল।


অষ্টম শ্রেণির অন্য বিভাগ – বাংলা | ইংরেজি | গণিত | বিজ্ঞান | ভূগোল

সম্পদের বহির্গমন ও অবশিল্পায়ন

ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই অর্থনৈতিক অবস্থার চরম ক্ষতি হতে শুরু করে। উনবিংশ শতকের গোড়া থেকেই ব্রিটিশদের শোষণ নীতির কারণে সম্পদের নির্গমন, অবশিল্পায়ন ও ভারতের দারিদ্র্য-দুর্দশা বাড়তে থাকে।

ভারত ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবে বিরাট ভূমিকা নেয়, ধীরে ধীরে শিল্পবিপ্লবে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল রপ্তানি এবং উৎপাদিত দ্রব্যে বিক্রির বাজার হয়ে ওঠে ভারতবর্ষ। বিদেশি দ্রব্য প্রায় বিনাশুল্কে যেখানে বিক্রি হত, সেখানে ভারতীয় দ্রব্য চড়া শুল্কহারে বিক্রি করা হয়। এইভাবে অসম প্রতিযোগিতায় ভারতীয় দ্রব্যগুলি ক্রমশ পিছিয়ে পড়ে ও একসময় এই দেশীয় শিল্পগুলি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়।

ভারতীয় সম্পদ, শিল্প ইত্যাদিকে ধ্বংস করে ব্রিটিশ শক্তি সাম্রাজ্য বিস্তার করে। বহু অমূল্য রত্ন, সম্পদ, প্রচুর পরিমাণ অর্থ সেই সময় ‘স্পঞ্জের মত’ প্রায় নিংড়ে আহরণ করে নিয়ে ইংল্যান্ডে প্রেরণ করেছিল ব্রিটিশরা।

ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের দারিদ্র্য

ভারতের দারিদ্র্য

ভারতে শুধুমাত্র উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ জুড়ে মোট যতগুলি দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, তাতে প্রায় ৩ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। এমনকি কিছু কিছু ব্রিটিশ আধিকারিকও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, প্রায় চার কোটি ভারতীয় অর্ধাহারে দিন কাটায়।

পর্ব সমাপ্ত।

লেখিকা পরিচিতিঃ
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত প্রত্যুষা মুখোপাধ্যায়। বিভিন্ন বিষয় চর্চার পাশাপাশি নাচ,গান, নাটকেও প্রত্যুষা সমান উৎসাহী।



এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

VIII_His_4c