ভৌতবিজ্ঞান – নবম শ্রেণি – অধ্যায়: পদার্থঃ গঠন ও ধর্ম (দ্বিতীয় পর্ব)
‘পদার্থের গঠন ও ধর্ম’ অধ্যায়ের প্রথম পর্বের আলোচনায় আমরা প্রবাহীর চাপ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এই লেখার দ্বিতীয় পর্বে আমরা ব্যরোমিটার ও সাইফন নিয়ে আলোচনা করবো। এই পর্বটি পড়ার আগে আমরা পাঠকদের আগের পর্বটি পড়ে নেবার অনুরোধ জানাবো।
টরিসেলীর পরীক্ষা
ষোড়শ শতকে ইতালীয় বিজ্ঞানী ইভান গেলিস্তা টরিসেলী প্রবাহীর চাপ সংক্রান্ত একটি বাস্তব সমস্যার সমাধান করেন এবং বায়ুচাপের দ্বারা 34 ft পর্য্যন্ত জল স্তম্ভকে তোলা যায় তাও তিনি প্রথম নির্ণয় করেন। এছাড়া এই 34 ft পর্য্যন্ত জল স্তম্ভের সমতুল্য 76 c.m পারদ স্তম্ভের চাপও তিনিই প্রথম একটি পরীক্ষার সাহায্যে দেখান।
পরীক্ষাটি হল-
(ক) কাচ নলের খোলা মুখ বৃদ্ধাঙ্গষ্ঠ দ্বারা ধরে রাখা আছে যাতে পারদ কাচনল থেকে বেরিয়ে না যায়।
(খ) পারদ পূর্ণ কাচ নলটি আগের চিত্রে দেখানো অবস্থাতেই হাত সহ একটি পারদ পূর্ণ পাত্রের মধ্যে নিমজ্জিত করে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি সরিয়ে নেওয়া হল এবং কাঁচনলটি যাতে অনুভূমিকের সাথে লম্বভাবে থাকে সে ব্যবস্থাও করা হল ।
(গ) এর পর দেখা গেল যে 1 মিটার যে কাচনল টিকে পারদ পূর্ণ পাত্রের মধ্যে খাড়াভাবে রাখা হয়েছিল তাতে আর 1 মিটার উচ্চতা পর্য্যন্ত পারদ রইল না তার উচ্চতা কমে 76 c.m / 760 mm হয়ে গেল।
তবে উল্লেখ্য যে, এই পারদ স্তম্ভের 76 c.m উচ্চতা কাঁচ নলের প্রান্ত A থেকে নয় উচ্চতা হল পারদপূর্ণ কাঁচ পাত্রের পারদ পৃষ্ঠ (B) থেকে। অর্থাৎ চিত্রানুযায়ী BC = 76 c.m।
টরেসেলী ঘটনাটির নিম্নরূপ ব্যাখ্যা দেন।
বায়ু পারদ পূর্ণ কাচ পাত্রের উপরি পৃষ্ঠ চাপ দেয় যা তরল পারদ কর্ত্তৃক সঞ্চরিত হয় নিমজ্জিত কাচ নলের খোলা মূখ প্রান্ত A তে। এই চাপই কাচ নলের পারদকে 76 c.m উচ্চতা পর্য্যন্ত ধরে রাখে।
আমরা টরিসেলীর পরীক্ষার ব্যাখ্যাটা একটু ভাল করে খেয়াল করলে দেখব যে বায়ুর চাপ কাজ করছে বড় কাঁচের পাত্রে রাখা পারদ পৃষ্ঠের উপর।
সেই চাপ তরল পারদের মধ্যে দিয়ে সঞ্চরিত হচ্ছে কাচ নলের খোলা মুখে (A) এই ধরনের ঘটনা কেবল পারদ নয়, অন্যান্য তরল বা গ্যাসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এটিই হল পাস্কালের সূত্র।
অর্থাৎ পাস্কালের সূত্রানুসারে, কোন তরলের যে কোন অংশে চাপ প্রয়োগ করলে তা ঐ তরলের সমস্ত অংশেই সমান ভাবে সঞ্চরিত হয় এবং তরলের প্রত্যেক পৃষ্ঠ তলের সাথে লম্বভাবে ক্রিয়া করে।
আমরা আবার টরিসেলীর পরীক্ষা ও সেই সংক্রান্ত আলোচনায় ফিরে আসি।
টরেসেলীর পরীক্ষা থেকে এতক্ষনে এটা নিশ্চয়ই পরিষ্কার যে পরীক্ষাটি সম্পূর্ণ ভাবেই বায়ুর চাপের উপর নির্ভরশীল।
বায়ুর যে চাপ আছে তা আমরা আরও কতকগুলি সহজ পরীক্ষার সাহায্যে বুঝতে পারি।
যেমন, একটা খালি টিনের কৌটোর ঢাকনা খুলে তা আংশিক জলপূর্ণ করে বেশ কিছুক্ষণ গরম করা হল। এর পর ঐ টিনের কৌটকে ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করে ঠান্ডা হতে দিলে দেখব যে তার আকৃতির পরিবর্তন ঘটে গেছে।
আসলে টিনের পাত্রটিকে জল ভরে যখন গরম করা হচ্ছিল সে যে সময় জলীয় বাস্পের সাথে বায়ুও কিছুটা নির্গত হয়ে গিয়েছিল। এখন ঐ টিনের কৌটোকে বন্ধ করে ঠান্ডা হতে দিলে বায়ু আবার তার স্ব স্থানে ফিরে আস্তে চায়, যা না পেরে টিনের কৌটোটির আকৃতির পরিবর্তন করে। এইরূপ আরও অনেক প্রাকৃতিক ঘটনাও আমরা লক্ষ্য করে থাকব। কিন্তু সব কিছুর থেকেই একটা ব্যাপার নিশ্চিত যে বায়ুর চাপ আছে।
সুতরাং চাপের সমীকরণ (P = h × d × g) অনুসারে যদি ‘h’ এর পরিবর্তন হয় বা ‘d’ এর পরিবর্তন হয় তবে বায়ুর চাপের মানও ভূ – পৃষ্ঠে পরিবর্ত্তিত হবে।
এখন ‘h’ এর মানের পরিবর্তন হওয়া সম্ভব যদি আমরা পর্বত শৃঙ্গে বা কোন উঁচু স্থানে উঠি।
আবার ‘d’ বা বায়ুর ঘনত্ব বিভিন্ন কারনে পরিবর্ত্তন হতে পারে। যেমন –
(i) বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমান বৃদ্ধি পেলে
(ii) বায়ুর উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলে ইত্যাদি।
সুতরাং বায়ুর ঘনত্ব অনুযায়ীও চাপের পরিবর্ত্তন হয় যা অনেকাংশেই বায়ুর মধ্যে থাকা জলীয় বাষ্প বা উষ্ণতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
আবার বায়ুতে থাকা জলীয় বাষ্প বা উষ্ণতার সাথে যেহেতু আবহাওয়া নির্ভরশীল সুতরাং টরিসেলীর বায়ুচাপ জনিত পারদ স্তম্ভটির পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা দৈনন্দিন আবহাওয়া সম্পর্কেও ধারণা লাভ করতে পারি।
আমরা তাই টরিসেলীর পরীক্ষণ সংস্থাটিকে একটা সরল ব্যারোমিটার রূপে কল্পনা করতেই পারি।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
ব্যারোমিটারের সাহায্যে কোন স্থানের উচ্চতা নির্ণয়
আমরা জানি যে উচ্চতা বৃদ্ধিতে বায়ুর ঘনত্ব হ্রাস পায়। ফলে বায়ুর চাপ যেহেতু ঘনত্বের সাথে সমানুপাতিক তাই উচ্চতা বৃদ্ধিতে বায়ুর চাপও হ্রাস পায়। তাই উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যারোমিটারের পারদস্তম্ভের উচ্চতাও হ্রাস পেতে থাকে।
সুতরাং ব্যারোমিটারের পারদস্তম্ভের হ্রাসের পরিমাণের ভিত্তিতে আমরা কোন স্থানের উচ্চতা সম্পর্কে ধারণা করতে পারি।
ব্যারমিটারের সাহায্যে আবহাওয়ার পূর্বাভাস
কোন স্থানের বায়ু যদি উত্তপ্ত হয়ে যায় বা বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমান বৃদ্ধি পায় তবে ঐ স্থানের বায়ুর ঘনত্ব হ্রাস পায়। ফলে ঐ স্থানের বায়ুর চাপও হ্রাস পায়।
অর্থাৎ যদি দেখা যায় যে ব্যারমিটার পারদস্তম্ভের উচ্চতার হঠাৎ পতন ঘটেছে তবে বুঝতে হবে যে ঐ স্থানের বায়ুর উষ্ণতা বা বায়ুতে থাকা জলীয় বাষ্পের পরিমান হঠাৎ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে ঐ স্থানের বায়ু হাল্কা হয়ে উপরে উঠে যায় এবং ঐ শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য চারপাশ থেকে শীতল বায়ু ছুটে আসে যা ঝড়-বৃষ্টির সৃষ্টি করে। সুতরাং ব্যারমিটার পারদস্তম্ভ উচ্চতার হঠাৎ পতন ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস দেয়।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
আবার পারদস্তম্ভের ধীরে ধীরে উচ্চতা বৃদ্ধি ঘটলে বুঝতে হবে যে ঐ স্থানের বায়ুর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে যা স্বাভাবিক রৌদ্রকরোজ্জ্বল আবহাওয়ার নির্দেশক।
বায়ুর চাপের আরও একটি ব্যবহার হল সাইফন ক্রিয়ার প্রয়োগ
সাইফন আসলে একটি পাইপ যার সাহায্যে আমরা তরল একপাত্র থেকে অন্যপাত্রে স্থানান্তর করতে পারি। তবে এক্ষেত্রে একটি শর্ত আছে। সেটা হল যে পাত্র থেকে তরলকে স্থানান্তর করা হবে সেই পাত্রে তরল তলের উচ্চতা দ্বিতীয় পাত্র (যে পাত্রে স্থানান্তরিত করা হবে) অপেক্ষা বেশি হবে হবে।
উপরের চিত্র T চিহ্নিত নলটি সাইফন হিসাবে ক্রিয়া করে। এক্ষেত্রে A চিহ্নিত পাত্র থেকে B চিহ্নিত পাত্রে তরলকে স্থানান্তরণ করা হবে। তাই A পাত্রটিকে B পাত্র অপেক্ষা অধিক উচ্চতায় রাখা হয়েছে।
এখন ভূমি থেকে A পাত্রের তরল পৃষ্ঠের উচ্চতা h1এবং B পাত্রের তরল পৃষ্ঠের উচ্চতা h2। সুতরাং A পাত্রে তরলের চাপ P1=h1dg এবং B পাত্রে ঐ চাপ P2 = h2dg
শর্তানুসারে P1>P2 হলে সাইফন ক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।
আমরা আগেই জেনেছি যে স্থির তরলের উপরিতলের প্রতিটি বিন্দুতে চাপ সমান।
তাই P1 = P2 হলেই h1dg = h2dg হবে। বা, h1 = h2হবে। অর্থাৎ উভয় পাত্রে তরল তল সমান উচ্চতায় আসবে। ফলে উভয় পাত্রের তরলের মধ্যে কোন প্রবাহ ঘটবে না ফলে সাইফন ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে। তবে এক্ষেত্রে আরও একটি শর্ত উল্লেখ্য যে সাইফন ক্রিয়ার জন্য বায়ু চাপও অত্যাবশ্যক কারন। সাইফন ক্রিয়ার শুরুতে T নলটির একপ্রান্ত A পাত্রের ত্রলে ডুবিয়ে ওপর প্রান্ত দিয়ে তরল টিকে টানা হয়। ফলে T পাইপে তরলটির একটি নিরবচ্ছিন্ন স্তম্ভ গঠিত হয়।
এই অবস্থায় A পাতের তরল পৃষ্ঠে বায়ু চাপের কারনে তরল T নল দিয়ে B পাত্রে প্রবাহিত হতে থাকে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যে এক্ষেত্রে T নলের মাধ্যমে যে নিরবচ্ছিন্ন জলের স্তম্ভ গঠিত হয় তা যেন একটি নিরবচ্ছিন্ন লোহার শিকলের মত ব্যবহার করে। এই লোহার শিকলটিকে একটি কপিকল বা পুলির একদুকে কিমি. ওপর দিকে বেশি করে ঝুলিয়ে দিলে শিকলটি নিজে থেকেই অভিকর্ষের টানে বেশি ভরের দিকে পড়ে যায় একই ভাবে তরল ও নিচে থাকা ‘B’ পাত্রে পড়তে থাকে।
দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব – আর্কিমিডিসের সূত্র
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
IX-PSc-3b